অনেক প্রত্যাশার ২০২৫ : নতুন বছরে অনিশ্চয়তা কেটে সুখ, শান্তি সমৃদ্ধি ফিরে আসুক, দেশ গণতন্ত্রে ফিরে আসুক

নিউজ ডেক্স : কালের পরিক্রমায় ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ সমাপ্ত। এর সঙ্গে শেষ হলো অত্যন্ত ঘটনাবহুল একটি বছরের। পূর্ব দিগন্তে উঠেছে নতুন সূর্য। নতুন প্রত্যাশায় যাত্রা শুরু হলো নতুন আরেকটি বছরের। ২০২৫ সালকে ঘিরে মানুষের প্রত্যাশা যেন একটু বেশিই। তবে সেই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব আখেরে কতটা মিলবে, সেটা অনাগত দিনগুলোই বলে দেবে।নতুন বছরে অনিশ্চয়তা কেটে যাক, সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি ফিরে আসুক, দেশ গণতন্ত্রে ফিরে আসুক- এ প্রত্যাশা সকলের।
সামগ্রিকভাবে ২০২৪ সালটি ছিল যেন এক অস্থিরতা আর নৈরাজ্যের বছর। বিশ্বব্যাপী চলমান যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা এবং বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানের প্রভাব পড়েছে সমাজ, ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনযাত্রায়। তাই নতুন বছরে দুনিয়াব্যাপী মানুষের প্রত্যাশা, গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা, লেবাননে ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং রাশিয়া-ইউক্রেনের নৃশংস ও অমানবিক যুদ্ধের অবসান ঘটে মানবতার জয় হোক। অর্থনীতি ফিরে পাক তার আপন গতি। বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা, সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠুক নতুন বছরে।
খ্রিষ্টীয় নতুন বছর-২০২৫ উপলক্ষে দেশবাসী এবং প্রবাসী বাঙালিসহ বিশ্ববাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ৩১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার পৃথক পৃথক বাণীতে এ শুভেচ্ছা জানান তারা।
মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন বছর আমাদের মধ্যে বয়ে এনেছে এক নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা। বিরাজমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে আমি আশা করি, সচ্ছল সমাজ ও রাষ্ট্র দুস্থ, অসহায় ও পশ্চাৎপদ মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। নববর্ষ উদযাপন একজনের আনন্দ যেন অন্যদের বিষাদের কারণ না হয়, আমরা সেদিকেও খেয়াল রাখব। তিনি আরও বলেন, জুলাইর গণঅভ্যুত্থানের আত্মত্যাগ, আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার পথ ধরে বাংলাদেশ অমিত সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাক নতুন বছরে, এ প্রত্যাশা করি।
অন্য এক বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার লাখো শহীদের রক্ত ও গত জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতাকেসর্বদা সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করছে। আমরা দেশকে ভালোবাসব, দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করব এবং যে কোনো সন্ত্রাসবাদকে প্রতিহত করব।
ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে দেশ-বিদেশের সবাইকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত ৩১ ডিসেম্বর ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তারেক রহমান লেখেন, ‘নতুন বছরে আমরা দেশের সামগ্রিক রূপান্তরের একটি পর্বে উপনীত হতে পারব বলে আশা রাখি। অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আসুন আমরা রাষ্ট্র ও সমাজে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একযোগে কাজ করি। আমরা এমন একটি জাতি নির্মাণের প্রত্যাশা করছি, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রত্যেকের কণ্ঠ স্বাধীন থাকবে।’
দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক মুহম্মদ মুনির হোসেন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান তিনি। মির্জা ফখরুল বলেন, অতীতের সফলতা ও ব্যর্থতার ওপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য এখন দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যেতে হবে। একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণই আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য হবে। নতুন বছর অর্জন আর প্রাচুর্যে, সৃষ্টি আর কল্যাণে সমৃদ্ধ হোক। এ ছাড়া নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম (চরমোনাই পীর)।
চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি বিরাজ করছে। আত্মবিশ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। দীর্ঘদিন কর্মস্থলে পুলিশের অনুপস্থিতির সুযোগে এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে লুটপাট, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের রাজত্ব কায়েম করেছে। দিনদুপুরে ব্যাংক ডাকাতির অপচেষ্টা মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে জানমালের নিরাপত্তার ভয় আর উৎকণ্ঠা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হতে থাকলেও নতুন বছরে নিরাপত্তাহীনতা থেকে পুরোপুরি মুক্তির প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের।
বিগত ১৫ বছরে দ্রব্যমূল্যের ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতিতে পিষ্ট ছিল সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের জীবনযাপন অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সিন্ডিকেটের কারসাজি ও বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ দিশেহারা। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম অবস্থা সব স্তরের মানুষের। নতুন বাংলাদেশেও সেই অবস্থা থেকে মুক্তি মেলেনি কারও। বাজার কারসাজি আর সিন্ডিকেটমুক্ত হতে পারেনি দেশের মানুষ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করে একটি টেকসহ সিন্ডিকেটমুক্ত বাজার ব্যবস্থা চালু করতে পারলে নতুন বছরে হয়তো মুক্তি মিলতে পারে বলে আশা সাধারণ মানুষের।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই প্রশাসনে নানা বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। হুমকির মুখে পড়েছে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড। বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ কেলেঙ্কারি নিয়ে শুরু হওয়া এমন অস্থিরতা গতকাল পর্যন্ত শেষ হয়নি। প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে এরই মধ্যে সরকার কঠোর বার্তা দিয়েছে। সেজন্য নতুন বছরে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনসেবায় নিজেদের নিয়োজিত করবেন বলে প্রত্যাশা সবার।
ব্যাংকসহ দেশের আর্থিক খাত লুট হয়ে গেছে বিগত সরকারের সময়। দেউলিয়া হয়ে পড়ে কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আর্থিক খাতে পতিত সরকারের নানা দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটের চিত্র এরই মধ্যে বেরিয়ে এসেছে। পরিকল্পিতভাবে লুটপাট আর কারসাজির মাধ্যমে শেষ করে দেওয়া হয়েছে দেশের শেয়ারবাজার। জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টদের। সরকার ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এরই মধ্যে বেশ কার্যকরী পদক্ষেপও নিয়েছে। নতুন বছরে আবারও প্রাণ ফিরে পাবে শেয়ারবাজার ও আর্থিক খাত—সেই আশায় বুক বেঁধেছেন সংশ্লিষ্টরা।
কোটা সংস্কারসহ নানা দাবি-দাওয়ার ছাত্র আন্দোলনে গত বছর উত্তাল ছিল দেশ। সেই আন্দোলনে ভর করে উদিত হয়েছে নতুন এক বাংলাদেশের সূর্য। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য এখনো থামেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাযথ শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উপযুক্ত সময় হতে পারে এই নতুন বছর। এ বছরটি হোক শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করার বছর। গণঅভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের খসে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ এ সময় পুনর্সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে নতুন বছরে মেধা ও মননে যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবে নিজেদের তৈরি করুক শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসুক, সেই প্রত্যাশা সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের।
যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে মত প্রকাশ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হলো পূর্বশর্ত। গঠনমূলক সমালোচনা মেনে নেওয়ার মনোভাব সবার থাকা চাই। বিগত বছর ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বারবার আঘাত এসেছে, যা নজিরবিহীন। এ ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। গণমাধ্যম অফিসে দুর্বৃত্তদের ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনাও ঘটেছে। অস্থিরতা বিরাজ করছে অনেক প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমে। যদিও সরকার বিষয়টি খুব আন্তরিকভাবে দেখভাল করছে। তবে নতুন বছরে এসব ঘটনার আর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেই প্রত্যাশা রয়েছে সবার।
সর্বোপরি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার ছাত্র-জনতার ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছে, নতুন বছরে তার সুবিচার নিশ্চিত এবং দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নতুন বছরে একটি সুন্দর নির্বাচন অথবা নির্বাচনের ইশতেহারের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের ভোটাধিকার বঞ্চনার অবসান ঘটবে বলে আশা নাগরিকদের। পাশাপাশি বিভিন্ন দাবি-দাওয়া ও আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সড়ক, মহাসড়কগুলো অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির পাঁয়তারা থেকে মুক্তি মিলুক জনগণের। নতুন বছরের নতুন দিনের সূর্যোদয়ে সব অনিশ্চয়তার সব মেঘ কেটে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে আসুক জাতীয় জীবনে।