নিউজ ডেক্স : কাস্টমস কমিশনার এনামুল হকের কাকরাইলে দুই ফ্লাট বেচে দেবার পর এলো আদালতের ক্রোকের নির্দেশ। নড়েচড়ে বসেছে তদন্ত কর্মকর্তা।
আরেকটি ফ্লাট বেচার দাম হাকছেন দালাল।এক দাম– প্রতি বর্গফুট ২৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে ২ কোটি ৯২ লাখ টাকা পেলে রাজধানীর কাকরাইলের আইরিস নূরজাহান টাওয়ারের তৃতীয় তলার ১ হাজার ১৭০ বর্গফুটের বাণিজ্যিক জায়গাটি বিক্রি করবেন মালিক। ক্রেতার সাশ্রয়ের কথা ভেবে রেজিস্ট্রেশন বাবদ সরকারি ফি কমাতে চুক্তিমূল্য কম দেখাতেও রাজি তিনি। এমন সুবিধায় বাণিজ্যিক জায়গাটি যিনি বেচবেন, তিনি কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হক। নূরজাহান টাওয়ারের যে সম্পত্তি তিনি বেচার জন্য ক্রেতা খুঁজেছেন, সেটি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্জিত সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করে প্রায় এক বছর আগে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বর্তমানে সিলেটে কর্মরত এনামুল হক মামলার এজাহারভুক্ত সম্পদ কীভাবে বিক্রি করছেন, এর কিছুই জানে না দুদক।
এনামুল হক যে সম্পত্তিটি বিক্রি করতে চাচ্ছেন, তা দুদকের সেগুনবাগিচা কার্যালয় থেকে মাত্র ৬০০ মিটার দূরে। মামলার পর তিনি একে একে সম্পদ বিক্রির চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছেন। এরই মধ্যে কাকরাইলের আইরিস নূরজাহান টাওয়ারে থাকা দুটি ফ্ল্যাট ৪ কোটি টাকায় বেচে দিয়েছেন।
এদিকে কৌশলী এনামুলের সম্পদের খোঁজে অনুসন্ধানে নামে সমকাল। আর তাতেই নড়েচড়ে বসে দুদক। সংস্থাটি তাড়াহুড়ো করে আদালতে তাঁর সম্পদ জব্দের (ক্রোক) আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বৃহস্পতিবার এনামুলের ঢাকার বসুন্ধরার ৯ তলা বাড়ি, রাজধানীর কয়েকটি ফ্ল্যাট এবং কিছু স্থাবর সম্পদ জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। তবে মজার ব্যাপার হলো, আইরিস নূরজাহান টাওয়ারের যে দুটি ফ্ল্যাট ক্রোকের আদেশ এসেছে, সেগুলো আগেই বেচে দিয়েছেন এনামুল।
প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়ে গত ৩০ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে দুদকের ঢাকা জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১-এ মামলা করেছিলেন সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত টাকায় তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার কাকরাইলের তিনটি ভবন, মোহাম্মদপুরের দুটি ভবন, বনানী-বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক জায়গা, প্লট ও বাড়ি নির্মাণ করার অভিযোগ উঠেছিল।
দুদকের অনুসন্ধানে ঢাকার খিলক্ষেতের জোয়ারসাহারা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম এবং পৈতৃক বাড়ি ফেনীর সোনাগাজীতে ৬৪টি জমি ক্রয় ও মৎস্য খামার করেছেন বলে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া যায়। দুদকের অনুসন্ধানের সময় জিজ্ঞাসাবাদে এসব সম্পত্তির দাম ২২ কোটি টাকা দেখান এনামুল। যদিও এসব সম্পদের প্রকৃত মূল্য অনেক বেশি, তবু কাগজে-কলমের হিসাবে বৈধ আয় এবং ব্যাংক ঋণের বাইরে প্রায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের উৎস দেখাতে পারেননি।
এ অভিযোগে এনামুল হকের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান দুদকের উপপরিচালক ফারজানা ইয়াসমিন। গত এক বছরে এ কর্মকর্তা মামলার তদন্ত কতদূর এগিয়েছেন, এর কিছুই জানাতে রাজি হননি তিনি। এজাহারভুক্ত সম্পত্তি যে একে একে বেহাত হচ্ছে, সে খবরও রাখেননি এ কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাকরাইলের রাজমনি সিনেমা হলের বিপরীতে হাজি লতিফ ট্রেড সেন্টারের প্রায় পাঁচ হাজার বর্গফুটের দুটি ফ্লোর স্পেসও বিক্রির চেষ্টা করছেন এ সরকারি কর্মকর্তা। এটি বিক্রির দায়িত্ব নিয়েছেন ক্যাসিনোকাণ্ডে অভিযুক্ত এবং হাজি লতিফ ট্রেড সেন্টারের অন্যতম মালিক রুবেল মিয়া।
পাঁচ মাস আগে বিক্রি করা আইরিস নূরজাহান টাওয়ারের ১ হাজার ৯৯৫ বর্গফুটের ‘এ-১৩’ নম্বর ফ্ল্যাটটি ২ কোটি ২০ লাখ টাকায় কিনেছেন মক্কা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিক এম এ রশিদ শাহ্ সম্রাট। একই ভবনের ১ হাজার ৮৬৫ বর্গফুটের ‘বি-১৪’ নম্বর ফ্ল্যাটটি চার মাসে আগে ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় কিনেছেন ব্যবসায়ী বিমল। ওই ভবনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ক্রেতা সেজে এনামুল হকের সম্পত্তি বিক্রির তথ্য সংগ্রহে গত বুধবার আইরিস নূরজাহান টাওয়ারে যান এ প্রতিবেদক। ভবনটির জমির মালিক মুরাদ হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, ভবনে এনামুল হকের দুটি ফ্ল্যাট ছিল। ওই দুটি বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। এখন এনামুল হকের মালিকানায় ভবনটির তৃতীয় তলায় ১ হাজার ১৭০ বর্গফুটের একটি বাণিজ্যিক জায়গা আছে। সেটারই দাম চাওয়া হয় প্রতি বর্গফুট ২৫ হাজার টাকা। দাম কমানোর অনুরোধ জানালে সুযোগ নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন। তবে প্রতিবেদকের অনুরোধে তাৎক্ষণিক মোবাইল ফোনে এনামুল হকের সঙ্গে কথা বলেন মুরাদ হোসেন। এনামুল হক ফোনে তাঁকে জানান, আয়কর নথিতে এ সম্পত্তির দাম ১ কোটি ৯২ লাখ টাকা দেখানো আছে। ফলে এর কম দেখানোর সুযোগ নেই। দুই কোটি টাকার বেশি ক্রয়চুক্তি করতে রাজি আছেন তিনি। তবে জায়গাটির দাম ২ কোটি ৯২ লাখ টাকাই দিতে হবে।
‘শুনেছি, এনামুল হকের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা আছে। এ সম্পত্তি কিনে ঝামেলায় পড়তে হবে না তো?’ ক্রেতা সেজে এ প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে মুরাদ হোসেন বলেন, ‘আমিই তো আগে দুটি ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছি। কোনো সমস্যা হয়নি। এটা নির্ভেজাল সম্পদ। বাণিজ্যিক স্পেসটি এখন রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্সের কাছে মাসিক ৫৫ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া আছে। তিন বছর চুক্তির মেয়াদ শেষে গত মাসে এনামুল হক নিজে এসে আরও তিন বছরের ভাড়া চুক্তি নবায়ন করে গেছেন। ১২ বছর আগে ডেভেলপারের কাছ থেকে দুটি ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্পেসটি কিনেছিলেন। দুদক তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ পায়নি। তাই মামলা থেকে তাঁকে খালাস করে দিয়েছে– এমনটাই জানান মুরাদ হোসেন।
তবে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এনামুল হকের মামলা চলমান। এটি এখনও তদন্ত পর্যায়ে আছে। খালাস দেওয়ার তথ্য ঠিক নয়। কারণ, এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ এখনও শুরুই হয়নি।
সম্পত্তি বিক্রি হচ্ছে, জানে না দুদক
এনামুলের মামলার তদন্ত করছেন দুদকের উপপরিচালক ফারজানা ইয়াসমিন। তিনি এ বিষয়ে তথ্য দিতে রাজি না হলেও সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা মুখ খোলেন। তদন্তের পর্যায়ে কী করে আসামি এজাহারভুক্ত সম্পত্তি বিক্রি করছেন– এ প্রশ্নে ওই কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত পর্যায়ে আসামির সম্পত্তি ক্রোক করা হবে কি হবে না, তা তদন্ত কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিষয়। এ ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।
গত বছরের জুলাইয়ে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মামলার এজাহারেই উল্লেখ করেছেন, জিজ্ঞাসাবাদে সম্পদের উৎস বিষয়ে এনামুল হক জানান, ফ্ল্যাট বিক্রি করে ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা এবং জমি বিক্রির বায়না হিসেবে ২০ লাখ টাকা পেয়েছেন। আসামির কাছ থেকে এক বছর আগেই সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টার কথা জানার পরও তদন্ত কর্মকর্তা সম্পত্তিগুলো জব্দ (ক্রোক) করার উদ্যোগ নেননি। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপ থাকতে পারে বলে ধারণা দেন দুদকের এক কর্মকর্তা।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, এনামুলের বিরুদ্ধে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পেয়ে ২০২২ সালের নভেম্বরে অনুসন্ধানে নামে দুদক। ওই বছরের নভেম্বরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়।
দুদকের মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, এনামুল হক ১৯৯৩ সালের ৮ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ২২ কোটি টাকার বেশি মূল্যের সম্পদ অর্জন করেন। এর মধ্যে ৯ কোটি ৭৬ লাখ ৯৭ হাজার ১০৭ টাকার সম্পদ অর্জনের পক্ষে বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি। অর্থাৎ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য গোপন করে তিনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
যেভাবে ক্রোক আদেশ
গত মঙ্গলবার দুদকের ঢাকা জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১-এ গিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তা এনামুলের মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে জানান, এ মামলা এখনও তদন্ত পর্যায়ে; বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়নি। এজাহারে উল্লিখিত বেশ কিছু সম্পত্তি এনামুল বিক্রি করেছেন এবং আরও সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টায় আছেন– এমনটি জানালে ওই কর্মকর্তা তাৎক্ষণিক তদন্ত কর্মকর্তা ফারজানা ইয়াসমিনকে ফোন করেন। তাঁর কাছে জানতে চান, এনামুল যে মামলার এজাহারভুক্ত সম্পত্তি বিক্রি করছেন– সে বিষয়ে জানেন কিনা। উত্তরে ‘না’ সূচক জবাব দিলে ওই কর্মকর্তা পরদিনই (বুধবার) আদালতের মাধ্যমে ক্রোকের আদেশ নিতে পরামর্শ দেন। অন্যথায় সমকালে এ খবর প্রকাশ হলে এর তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তিনি বিপদে পড়তে পারেন বলেও সতর্ক করেন। এর পরই গতকাল ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন শুনানি শেষে এনামুলের সম্পদ জব্দের আদেশ দেন।সমকাল