ডেক্স রিপোর্ট : কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার গত ৪ আগস্ট ছাত্রদের আন্দোলনের মধ্যেই আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠে নামান। তাঁর পিএস এবং তিনি রাজধানীর খামারবাড়ি ও মানিকনগরে বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদ পরিষদের কথিত শান্তি সমাবেশের নামে মহড়ায় যোগ দেন। সরকারের পক্ষে বেপরোয়া ছিলেন ওয়াহিদা। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির বহু অভিযোগ।
তাঁর স্বামী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার সরকার পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু গতকাল সোমবার তাদের দু’জনকেই সচিবালয়ে দেখা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ছাত্রদের বিরুদ্ধে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজপথে লেলিয়ে দেওয়া ওয়াহিদার আবার ফিরে আসায় অনেকেই ক্ষুব্ধ।
ওয়াহিদা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ছাত্রলীগ নেত্রী ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনার উপদেষ্টা মসিউর রহমানে ভাগনি। এক প্রতিমন্ত্রীর পিএস থেকে হন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের পরিচালক। এরপর প্রধানমন্ত্রীর পিএস হিসেবে কাটান প্রায় চার বছর। সেখান থেকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে যোগ দেন কৃষি মন্ত্রণালয়ে। সচিব পদে পদোন্নতির পর কৃষিতেই থেকে যান তিনি।
গত মার্চ মাসে অবসরে যাওয়ার পর দলীয় কোটায় এক বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান তিনি। গত কয়েক বছর ধরে কৃষি সেক্টরের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল এই আমলার। শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের খাতিরে দলীয় কার্যক্রমেও অংশ নেন।
শেখ বখতিয়ার সচিব পদমর্যাদায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান। অনেক সিনিয়রকে ডিঙিয়ে বখতিয়ারকে চেয়ারম্যান বানান ওয়াহিদা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের সুযোগে দুইবার স্বামীকেও চুক্তিভিত্তিক চেয়ারম্যান করেছেন।
শেখ বখতিয়ার এখনও নিজ দপ্তরে যাননি। তাঁর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে নানা সংবাদ প্রকাশ হলেও তাঁর স্ত্রী কৃষি সচিব হওয়ায় পার পেয়ে গেছেন।
এদিকে সরকার পতনের পর থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে দপ্তরগুলোতে চলছে অস্থিরতা। অনেক দপ্তরেই মহাপরিচালক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। এর মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সুবিধাভোগী একটি গোষ্ঠী। এক সময়ের সরকারপন্থি কর্মকর্তারা নতুন করে ভোল পাল্টাতে শুরু করেছেন। তারা দপ্তরগুলোতে কর্মকর্তাদের চাপ দিয়ে পদত্যাগ ও নতুন পদায়নের বাধ্য করছেন। এমন পরিস্থিতিতে কৃষি বিভাগে নেমে এসেছে আতঙ্ক। ফলে মাঠ পর্যায়ে তৈরি হয়েছে স্থবিরতা।
গত ৮ আগস্ট বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শাহজাহান কবিরের সঙ্গে দেখা করেন বিএনপিপন্থি পরিচয়ে কিছু কর্মকর্তা। তারা জোর করে তাঁর কাছ থেকে অব্যাহতিপত্র নেন। একই সঙ্গে বেশ কিছু কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দিতে চাপ সৃষ্টি করেন। তবে একই দিন মহাপরিচালক কৃষি মন্ত্রণালয়ে আরেকটি আবেদন জমা দেন। ওই আবেদনপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, একদল কর্মকর্তা তাঁর কাছ থেকে জোর করে অব্যাহতিপত্রে স্বাক্ষর নিয়েছেন। তিনি অবসরের আবেদন করেননি। অবশ্য ৮ আগস্টের পর থেকে তাঁকে আর অফিসে দেখা যায়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরেও বিএনপিপন্থি পরিচয়ে একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী তৎপর হয়ে উঠেছেন। তাদের সঙ্গে খোলস বদলে যুক্ত হয়েছেন এক সময়ে দুর্নীতিবাজ দলবাজ বেশ কিছু কর্মকর্তা। গত কয়েক দিন ধরে তারা কৃষি সম্প্রসারণের মহাপরিচালকে অব্যাহতি ও নতুন করে পদায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। তাদের ভয়ে অনেক কর্মকর্তাই অফিসে যেতে পারছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ দিকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার পতনের পরদিন অফিসে গেলে একদল কর্মকর্তা তাঁকে হুমকি দেন। এরপর থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন। নানা অনিয়মের কারণে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরে ক্ষুব্ধ কিছু কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল আউয়াল সরকার পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে। নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে অভিযুক্ত এই কর্মকর্তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে পেশাজীবীদের মিছিলে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে আজ সোমবার সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. সুরজিত সাহা রায় গত ৪ আগস্ট রাজধানীর খামারবাড়িতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে মিছিলে ১৮টি ব্যানার ও ৫০০টি প্ল্যাকার্ড বানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বেই কর্মকর্তা-কর্মাচরীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে রাজপথে ছিলেন।
এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, প্রকাশনার টাকা আত্মসাৎ, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগও রয়েছে। এতদিন সুরজিত সাহা রায় অফিসে না গেলেও গতকাল কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, হঠাৎ করে ভোল পাল্টিয়ে তিনি এখন বিএনপি-জামায়াতের সাফায় গেয়ে চলছেন।
দুর্নীতিতে অভিযুক্ত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান (বিএডিসি) আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ রাতারাতি নিজেকে বদলে এখন বিএনপিপন্থি পরিচয় দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, গত কয়েক দিনে ৩৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে পদায়ন করেছেন।
এ ছাড়া বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ফেরদৌসী ইসলাম ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ সরকার পতনের পর থেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। কৃষির ১৮টি দপ্তরেই এখন একই পরিস্থিতি। সব দপ্তরেই দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি বঞ্চনা এবং হয়রানির অভিযোগ এনে একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী বিক্ষোভ করছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, আমরা সরকারি চাকরি করি। সরকারের কাছ থেকে যখন যে নির্দেশনা আসে তা পালন করতে বাধ্য। কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারের বক্তব্য জানতে গতকাল একাধিকবার ফোন ও মেসেজ দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কৃষি দেশের শেষ ভরসা। যে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে কৃষি দেশের চাকা সচল রাখে। দ্রুত কৃষিকে দুর্নীতিমুক্ত করে সচল করা জরুরি। মাঠ পর্যায়ে যে অস্থিরতা চলছে তা দ্রুত বন্ধ না হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে।
Share this:
- Click to share on Facebook (Opens in new window)
- Click to share on Twitter (Opens in new window)
- Click to share on LinkedIn (Opens in new window)
- Click to share on Tumblr (Opens in new window)
- Click to share on Pinterest (Opens in new window)
- Click to share on Pocket (Opens in new window)
- Click to share on Reddit (Opens in new window)
- Click to share on Telegram (Opens in new window)
- Click to share on WhatsApp (Opens in new window)
- Click to print (Opens in new window)