সচিবালয়ে শোডাউন , ফুসে ওঠেছে প্রশাসন ক্যাডাররা , খসড়া প্রস্তাব প্রত্যাখান, সদস্য সচিবের অপসারণ দাবি

নিউজ ডেক্স : জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রস্তাবে ফুঁসে উঠেছেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) ব্যানারে তারা দাবি তুলে বলছেন, প্রশাসন ক্যাডারের কোনো পদ অন্য কোনো ক্যাডারকে দেওয়া যাবে না। বরং উপসচিব বা তদূর্ধ্ব পদগুলোর শতভাগ প্রশাসন ক্যাডারের জন্য নির্ধারিত করতে দাবি তুলেছেন। তারা আরও বলছেন, ক্যাডার পুল বলে আর কোনো কোটা রাখা যাবে না।
অপরদিকে তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছেন সাড়ে ১৫ বছর বঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া ক্যাডার কর্মকর্তারা। তারা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর অপসারণ এবং কমিশন বিলুপ্ত করে নতুন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি করেন। তারা সংস্কার কমিশনের খসড়া সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করেছেন। পাশাপাশি কমিশনের সদস্য সচিবের অপসারণ দাবি করেন।
রোববার সচিবালয়ে প্রশাসন ক্যাডারের বিভিন্ন ব্যাচের কয়েক শ কর্মকর্তা সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের করিডরে সমবেত হয়ে এসব দাবি পেশ করেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের করিডরে অবস্থান নেন। এ সময় বিএএসএ-এর সভাপতি ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব ড. আনোয়ার উল্যার নেতৃত্বে ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) তানভীর আহমেদসহ প্রায় ২০ জন কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠক শেষে জনপ্রশাসন সচিব এবং বিএএসএ-এর সভাপতি যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন। জনপ্রশাসন সচিব বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে কিছু বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। কমিশনে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মতামত দেওয়া এবং কমিশনেরও মতামত নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিএএসএ-এর নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে আমরা বুঝতে পারছি তারা কমিশনের কাছে তাদের সমস্যার কথা বলতে চায়।
সিনিয়র সচিব আরও বলেন, বিএএসএ-এর সভাপতি এবং ঢাকা জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দিয়েছি তারা কমিশনের একটি সেমিনার, ক্লোজডোর মিটিং অথবা ওপেন মিটিং করে সুপারিশগুলো একটি প্রস্তাব আকারে জমা দেবেন। শিগগিরই এ ওয়ার্কশপ করব। কমিশন, বিএএসএ এবং কমিশন সচিব পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ওয়ার্কশপের তারিখ নির্ধারণ করবে বলে জানান সিনিয়র সচিব। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এতে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে যাবে। সিনিয়র সচিব আরও বলেন, ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ এবং আজকের অবস্থানে প্রশাসন। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আজকের প্রশাসন নিয়ে যাতে কোনো সংকট তৈরি না হয়, এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি থাকবে। প্রশাসন ক্যাডার নিয়ে উচ্চ আদালতের কিছু রায়ও আছে। আদালতের রায়ের কোনো ভায়োলেশন যাতে না হয়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখা হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আরও বলেন, যেসব কথা বলা হচ্ছে সেগুলো এখনো কোনো সুপারিশের কাঠামোতে দাঁড় করানো হয়নি। যেখানে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেখানে দূরত্ব কমিয়ে একটি কাঠামো তৈরির চেষ্টা করা হবে। বিএএসএ-এর সঙ্গে বৈঠক করে এ কাঠামো তৈরি করা হবে। এক প্রশ্নে সচিব আরও বলেন, অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে আগেই বসেছি। এবার চূড়ান্তভাবে বসব বিএএসএ-এর সঙ্গে। বিএএসএ-এর সঙ্গে আগে বসা হয়নি। বিএএসএ-এর সভাপতি, ঢাকার ডিসি এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য সচিব হিসাবে আমি বসে কথা বলব।
এভাবে প্রশাসনের কর্মকর্তারা শোডাউন দিতে পারেন কি না-এমন প্রশ্নে সিনিয়র সচিব বলেন, আমরা বিষয়টি উদারভাবে বিবেচনা করতে চাই। বিএএসএ একটি সংগঠন। তারা সংগঠনের পক্ষ থেকে এসেছেন। আমি জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য সচিব হিসাবে তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। এখানে দোষের কিছু নেই।
বিএএসএ-এর সভাপতি ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব ড. মো. আনোয়ার উল্যাহ বলেন, জনপ্রশাসন ও অর্থ বিভাগে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কর্মকর্তা কর্মরত। তারা ক্যাডারসংক্রান্ত যে কোনো একটি সিদ্ধান্ত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য সচিবের মুখ থেকে শোনার জন্য আসতেই পারেন। এখানে কোনো মিছিল-মিটিং হয়নি। আমরা কমিশনপ্রধানকে তো পাই না। এ কারণে কমিশনের সদস্য সচিবের কাছে শোভন প্রক্রিয়ায় আমরা একটি আবেদন পেশ করতে এসেছি। এতে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে বলে মনে করি না। কর্মকর্তারা সচিবালয়ের বাইরের এবং বিভিন্ন জেলা পর্যায় থেকে এসেছেন-এমন প্রশ্নে বিএএসএ-এর সভাপতি বলেন, অ্যাসোসিয়েশনের মিটিং থাকায় অনেকে ঢাকার বাইরে থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই এসেছেন। সুতরাং এতে দোষের কিছু হওয়ার কথা না।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য সচিবের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে বিএএসএ-এর সভাপতি বলেন, আপনারা জানেন শনিবার ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা গণপূর্ত ভবনে একটি সভা করেছেন। সেখানে ব্যাপকসংখ্যক কর্মকর্তা সমবেত হয়েছিলেন। তারা মহাসমাবেশ ও কলমবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির ঘোষণা করেছেন। তবে আমরা কোনো ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারের তরফ থেকে আন্ডারমাইন্ড করছি না। সব ক্যাডারের অবস্থান থেকে কর্মকর্তাদের ওপরের পদে পদোন্নাতি পাওয়ার অবারিত সুযোগ আছে। আমরা তাদের ওপরের পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিরোধিতা করছি না। আমরা চাই না জনপ্রশাসনে অস্থিরতা তৈরি হোক। আমরা আমাদের ক্যাডারের পদগুলো কাউকে দেওয়ার পক্ষে না। তিনি আরও বলেন, মঙ্গলবার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কিছু কথা মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএএসএ মনে করে, কমিশনকে আরও কিছু তথ্য দেওয়া দরকার। এ কারণে আজ আলোচনায় বসা।
বঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের চলমান দাবির সমর্থনে সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের লাইব্রেরিতে সভা করেছেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের আহ্বায়ক এবিএম আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, প্রশাসন ও প্রশাসন ছাড়া অন্য ক্যাডারের পদোন্নতির অনুপাতিক হার ৫০:৫০ করার যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করে। এছাড়া অন্য লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির যে সুপারিশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে, তা সমর্থন অযোগ্য। আব্দুস সাত্তার আরও বলেন, আমরা জনপ্রশাসন কমিশনপ্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর অপসারণ দাবি করছি। একই সঙ্গে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বিলুপ্ত করে নতুন কমিশন গঠনের দাবি জানাচ্ছি।
এবিএম আব্দুস সাত্তার আরও বলেন, বিসিএস প্রশাসন কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে আমরা একটি বিবৃতি দেব। ইতোমধ্যে এ সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে। সংগঠনে ৪ হাজার ২০০ সদস্য রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা একজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করছি, যিনি নেপথ্যে থেকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে প্রভাবিত করছেন। ডিসিরা যে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস গঠনের দাবি করেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের প্রশাসন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তা গঠন করতে হবে। এ সার্ভিসে অন্য কোনো ক্যাডার ঢুকতে পারবে না। আমরা কারও খাবারে ভাগ বসাতে চাই না এবং আমাদের খাবারেও কাউকে ভাগ বসাতে দেব না।
আব্দুস সাত্তার আরও বলেন, বিসিএস প্রশাসন কল্যাণ সমিতি ও বিএএসএ যৌথভাবে বিএমএ মিলনায়তনে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ করব। সেই সমাবেশ থেকে আমরা কিছু কর্মসূচি দেব। উদাহরণস্বরূপ আমরা কালো ব্যাজ ধারণ করতে পারি, কলমবিরতিতে যেতে পারি, গণসম্পৃক্তা বাড়াতে জনসংযোগ করতে পারি। এতে জনমত তৈরি হবে। এরপর প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে আরও বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করব।
ঢাকার ডিসি ও বিএএসএর ঢাকা জেলার সভাপতি তানভীর আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ এবং আদার্স ক্যাডারের ২৫ শতাংশ অনুপাতিক হার দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় আবশ্যিকভাবে প্রতিপালনের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সংবিধান অনুসারে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনা মানতে হবে। এ ধরনের নিষ্পত্তিকৃত বিষয়ে নতুন করে যখন আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে, তখন প্রশাসন ক্যাডার মনে করছে বিষয়টিকে বিতর্কের জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ব্রিটিশ, পাকিস্তান থেকে এ পদগুলো প্রশাসন ক্যাডারেরই ছিল। ১৯৯৮ সালে বিগত আওয়ামী সরকারের সময়ে ২৫ শতাংশ কোটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এখন আবার আরও ২৫ শতাংশ পদ প্রশাসন ক্যাডার থেকে কেটে নেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। ফলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে একধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেখা দিয়েছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। আমরা সেই কথাগুলো জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য সচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে লিখিত আকারে জানাতে এসেছি। এ সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পূর্বপাশে তিন শতাধিক ক্যাডার কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এরপর তারা সদলবলে জনপ্রশাসন সচিবের দপ্তরের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন।