সর্বোচ্চ সম্মান থেকে সর্বোচ্চ দায়িত্ব

ডেক্স রিপোর্ট : পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানিত পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয় নোবেল পুরস্কারকে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তার নিরলস লড়াইয়ের স্বীকৃতি হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সর্বোচ্চ এই সম্মান পেয়েছেন। এরপর বিশ্ব জুড়ে তাকে সম্মানিত করা হয়। গত ১৫ বছর দেশে নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়া ড. ইউনূস এখন দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার অপেক্ষায়।

গত কয়েক মাসে আদালতে হাজিরা দিতে দিতে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা, হয়রানি ও হতাশার কথা সাংবাদিকদের আদালত অঙ্গনে বারবার বলে আসছিলেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশেষ করে এজলাসে লোহার খাঁচায় দাঁড়িয়ে হাজিরা দেওয়াটা অত্যন্ত অপমানজনক বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। গত সোমবার ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ড. ইউনূস। প্যারিস থেকে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে দেশে ফিরে তার এই দায়িত্ব নেওয়ার কথা রয়েছে। এর আগেও বিদেশ সফরে গিয়ে ফিরে এসে তাকে আদালতে হাজিরার প্রস্তুতি নিতে হতো। তবে, এবার হাজিরা নয়, তিনি দেশের প্রতিকূল এক পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন।

১৫ বছরে নানা অপবাদ, মামলার যন্ত্রণা : আওয়ামী লীগ সরকারের টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনকালে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে নানা বিষয়ে অপমান, অপদস্থ ও যন্ত্রণা সইতে হয়েছে ড. ইউনূসকে। সদ্য পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে নিয়ে নানা সময় ‘রক্তচোষা’ ও ‘সুদখোর’ বলে কটূক্তি করেন। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ^ব্যাংকের সহায়তা বাতিল হলে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এমনকি পদ্মা সেতু চালুর পর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ড. ইউনূসকে পদ্মা নদীতে দুটি চুবানি দিয়ে সেতুতে তুলে দেওয়া উচিত।’

গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. ইউনূসকে সরিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে গেলেও হেরে যান তিনি। এরপর গ্রামীণ টেলিকমের অর্থ তছরুপ, শ্রম আইনের বিধি না মানাসহ নানা অভিযোগে একের পর এক মামলার বিষয়ে ড. ইউনূস বরাবরই নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তাকে হয়রানির কথা বলে আসছিলেন। তিনি বলেছেন, তার প্রতিষ্ঠিত অর্ধশতাধিকের বেশি প্রতিষ্ঠানে তার কোনো মালিকানা নেই এবং এসব প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি কোনো লভ্যাংশ নেন না। এসব প্রতিষ্ঠানের সবই মানুষের ও প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের কল্যাণে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলায় গত ২ জুন ড. ইউনূসকে ঢাকার সংশ্লিষ্ট বিশেষ জজ আদালতের এজলাসে লোহার খাঁচার ভেতরে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। ওইদিন তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘মহাকাব্যে কিছু দেবদেবী থাকে যারা অভিশপ্ত। তারা যাদের ওপর অভিশাপ দেয় তারা অভিশপ্ত জীবনযাপন করে। আমিও মনে হয় এ রকম মহাকাব্যের অংশ হয়ে গেছি। কোনো দেবদেবী আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছে, আমাকে অভিশাপ দিয়েছে। সেই অভিশাপের কারণে আজকে এখানে হাজির হয়েছি। লোহার খাঁচায় দাঁড়ানো অভিশপ্ত জীবনের অংশ।’

একই মামলায় ১২ জুন আবারও লোহার খাঁচায় গিয়ে হাজিরা দিয়ে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘যত দিন কোনো ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছেন, তত দিন নিরপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবেন। একজন নিরপরাধ নাগরিককে শুনানির সময় লোহার খাঁচার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, এটা আমার কাছে অত্যন্ত অপমানজনক। এটা গর্হিত কাজ। একটা সভ্য দেশে কেন একজন নাগরিককে মামলার শুনানির সময় পশুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?’ এ মামলায় গত ১৫ জুলাই সর্বশেষ হাজিরা দেন তিনি। তবে, ওই দিন লোহার খাঁচায় হাজিরা দিতে না হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেন তিনি। তাড়াহুড়ো বিচার নিয়ে ড. ইউনূস বলেছিলেন, ‘কিছু একটার শিকার হচ্ছি তো, এটা পরিষ্কার। এটা প্রতিহিংসা বলেন, বিদ্বেষ বলেন সবকিছু মিলিয়েই।’

এ ছাড়া শ্রম আদালত ও শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে জামিন নিতে ও হাজিরা দিতে গিয়েও মামলার যন্ত্রণার কথা প্রায়ই সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করতেন ড. ইউনূস। গত ৪ জুলাই এ মামলায় হাজিরা দিয়ে জামিন নিয়েছিলেন তিনি।

শ্রম আইনের মামলায় সাজা বাতিল : শ্রম আইনের মামলায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনের ছয় মাসের দণ্ড ও জরিমানা বাতিল করে গতকাল রায় দিয়েছে ঢাকার শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) এমএ আউয়াল চারজনের আপিল মঞ্জুর করে তাদের বেকসুর খালাস দিয়ে এ রায় দেন।

আদালতে ড. ইউনূসের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিচারিক আদালতের রায়টি বাতিল করে খালাস দিয়েছে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল।’

গত ১ জানুয়ারি ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালত এক রায়ে ড. ইউনূস, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, দুই পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহানকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড ও প্রত্যেককে ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশ দেয়। গত ২৮ জানুয়ারি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল তাদের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে তাদের জামিন দেয়। একই সঙ্গে আপিল নিষ্পত্তি পর্যন্ত কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের অংশটুকু স্থগিত করে ট্রাইব্যুনাল। হাইকোর্টে রিভিশন আবেদন করে বাদীপক্ষ কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। গত ৫ ফেব্রুয়ারি চারজনের দণ্ড স্থগিত করে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের দেওয়া আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়ে রুল দেয় হাইকোর্ট। একই সঙ্গে চারজনকে বিদেশে যেতে হলে আপিল ট্রাইব্যুনালকে অবহিত করতে হবে বলে আদেশ দেয় আদালত। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৮ মার্চ হাইকোর্ট রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দিয়ে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের আদেশটিকে (সাজা স্থগিত) বাতিল করে। গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে হাইকোর্টের এই পূর্ণাঙ্গ রায়ে মামলাটি যত দ্রুত সম্ভব নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। ১৪ আগস্ট এ মামলায় ড. ইউনূসের আদালতে হাজির হওয়ার কথা ছিল।

ড. ইউনূসসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিল-সংক্রান্ত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলা রয়েছে। এটি করা হয় গত বছরের ৩০ মে। এ মামলায় গত ২৯ জানুয়ারি ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। এরপর ৩ মার্চ ড. ইউনূসসহ অন্যরা এ মামলায় বিচারিক আদালত থেকে জামিন পান। গত ১২ জুন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ বিচার শুরুর আদেশ দেয়। সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে থাকা এ মামলাটির কার্যক্রম বাতিল চেয়ে গত ৮ জুলাই হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন ড. ইউনূস। গত ২৪ জুলাই হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ এ আবেদন খারিজ করার পাশাপাশি মামলাটির বিচারকাজ এক বছরের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয় আদালত।

গতকাল ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘নিম্ন আদালতে এ মামলাটি এখনো শুনানির প্রাথমিক ধাপে আছে। আমরা শিগগির আপিল বিভাগে আপিল করে মামলার কার্যক্রম বাতিল চাইব।’

বর্ণাঢ্য জীবন ড. ইউনূসের : ১৯৪০ সালের ২৮ জুন চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে তিনি ভ্যান্ডবিল্ট ইউনিভার্সিটি গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (জিপিইডি) থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি নাগরিক কমিটি গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। সেখানে অন্য বাঙালিদের সঙ্গে বাংলাদেশ তথ্যকেন্দ্র পরিচালনা করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশের দারিদ্র্যদূরীকরণে উদ্যোগী হন।

পরে দারিদ্র্যদূরীকরণে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণের ধারণাকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেন তিনি। এজন্য ২০০৬ সালে তিনি এবং তারই প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এ পুরস্কার ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’, ‘কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’সহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ২৮ জুন তার জন্মদিনকে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বৈশ্বিকভাবে ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। এখন পর্যন্ত দারিদ্র্যদূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ বা সামাজিক ব্যবসার এই মডেল পৃথিবীর ৪০টির বেশি দেশে ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করে চলেছে। এ ছাড়া পৃথিবীর ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তার নামে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে ড. ইউনূসের চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও তার জীবনাদর্শ নিয়ে গবেষণা হয়। এখন পর্যন্ত ২৪টি দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ৬০টির মতো সম্মানসূচক ডিগ্রি পেয়েছেন। ১৩০টির বেশি সম্মাননা পেয়েছেন ৩০টির বেশি দেশ থেকে। কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ড. ইউনূসের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গত কয়েক দশকে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ শক্তিসহ ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। দেশ রূপান্তর