বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:২৩ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
সিনহা হত্যা: ওসি প্রদীপ-এসআই লিয়াকতের ফাসির রায় : সিনহা, একজন অভিযাত্রী, যার স্বপ্নের সমাপ্তি পুলিশের গুলিতে

নিউজ ডেক্স : মেজর সিনহা হত্যা মামলায় ওসি প্রদীপ , এসআই লিয়াকতের ফাসির রায় ঘোষণা করা হয়েছে। জনাকীর্ন আদালতে গত ৩১ জানুয়ারি এ রায় ঘোষণা করা হয়। রায় ঘোষণার সময় ওসি প্রদীপ, এসআই লিয়াকত কাদতে থাকে।

অ্যাডভেঞ্চার! ওই নেশাই তাকে টেনে নিয়েছিল কক্সবাজারের টেকনাফে : ২০২০ সালের জুলাই মাসের শেষ দিন সন্ধ্যার পর বাহারছড়ার এক পাহাড়ে উঠে ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন টাইম ল্যাপস ভিডিও। পরদিন ভোরের সূর্যের সঙ্গে সিনহা মো. রাশেদ খানের আর দেখা হয়নি।

সেনাবাহিনীর চাকরিতে অ্যাডভেঞ্চার কি ছিল না? কিন্তু সে জীবনে নিয়মের বড় কড়াকড়ি। আজীবন স্বাধীনচেতা সিনহা মেজরের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বানাতে শুরু করলেন ট্র্যাভেল ডকুমেন্টারি। অবশ্য সেটা ছিল কেবল শুরু। তার স্বপ্ন ছিল বিশ্ব ভ্রমণের।

যার সঙ্গে তার টক্কর লেগেছিল, তার ছিল অন্য নেশা। তদন্তকারীদের ভাষায়, ‘ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের ‘নির্মম নেশা’ পেয়ে বসেছিল টেকনাফ থানার তখনকার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে। আর সেই গোপন খবর জেনে গিয়েছিলেন তথ্যচিত্র নির্মাণে কক্সবাজারে যাওয়া সিনহা।

সেই রাতে পাহাড় থেকে নেমে নিজের রুপালী রঙের টয়োটা অ্যালিয়ন চালিয়ে ফেরার পথে শামলাপুর চেকপোস্টে থামনো হয় সিনহাকে। পুলিশের গুলিতে অপমৃত্যু ঘটে তার স্বপ্নের।

অথবা হয়ত কেবল সিনহারই মৃত্যু ঘটেছে, তার স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখতে রয়ে গেছে কেউ।

কক্সবাজারে ‘জাস্ট গো’ নামের ওই ট্র্যাভেল ডকুমেন্টারি বানানোর কাজে সিনহার সঙ্গী ছিলেন ঢাকার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজের ছাত্রী শিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত আর তাহসিন রিফাত নূর।

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে গিয়ে শিপ্রার সঙ্গে সিনহার পরিচয়, বন্ধুত্ব; সেখান থেকেই ‘জাস্ট গো’র শুরু।

 

শামলাপুরের ঘটনার দুই সপ্তাহ পর এক সাক্ষাৎকারে শিপ্রা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “সিনহা যে স্বপ্নটি দেখতে দেখতে মারা গেছে, যে স্বপ্নের জন্য মারা গেছে, আমি তো শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত সেই স্বপ্নটা মেরে ফেলতে দেব না। আমি সেই স্বপ্নটা বহন করতে চাই, শেষ পর্যন্ত।”

জীবনের দীর্ঘ পথে সেই স্বপ্ন শিপ্রা কতটা বয়ে নিতে পারবেন, তা বলে দেবে ভবিষ্যৎ। তবে তার একটি চাওয়া ইতোমধ্যে পূর্ণ হয়েছে।

ফিল্ম বানানোর নেশায় বিভোর এই তরুণী চেয়েছিলেন ‘জাস্টিস’। কক্সবাজারের আদালত সিনহাকে হত্যা করার দায়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এবং পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে ফাঁসির রায় দিয়েছে।

সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়া সিনহা মো. রাশেদ খান বিখ্যাত কেউ ছিলেন না। আত্মীয়-বন্ধুর গণ্ডীর বাইরে তাকে কারও চেনার কথাও ছিল না।

কিন্তু তার মৃত্যুর ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেয়। রোজ সকালে ঘুম ভেঙে ক্রসফায়ার আর কথিত বন্দুকযুদ্ধের খবর শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা বাংলাদেশের মানুষ এরপর দেখতে পায় নতুন কিছু।

তারা দেখতে পায়, অপরাধ দমনের নামে নিজেরাই ‘সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলা’ (ওসি প্রদীপকে এভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে সিনহা হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে) পরাক্রমশালী পুলিশ কর্মকর্তারাও আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের বিচারও শুরু হচ্ছে। কক্সবাজারের প্রায় প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে সরকার।

পরিবারের প্রিয় আদনান : সেই ছেলেবেলা থেকেই বেড়াতে পছন্দ করতেন সিনহা মো. রাশেদ খান, পরিবারে তার ডাকনাম ছিল আদনান। বড় হয়ে যখন সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন, হয়ে উঠলেন কোর্সমেটদের মধ্যমনি।

সিনহার বাবা এরশাদ খান ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। সর্বশেষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি মারা যান।

বাড়ি যশোরে হলেও বাবার বদলির চাকরির সুবাদে জেলায় জেলায় ঘুরতে হয়েছে সিনহার পরিবারকে। তারা রাঙ্গামাটিতে থাকার সময় ১৯৮৪ সালের ২৬ জুলাই সিনহার জন্ম।

কক্সবাজারের উখিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা ঘুরে সিনহার পরিবার গেল সিরাজগঞ্জে। সিনহা তখন সদ্য কৈশোরে।

তার মা নাসিমা আক্তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “ওর বাবা সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদ সচিব হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন সে বছর। আদনান সেখানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। সেখানে ওর স্কুল ছিল নদীর পাড়ে। বন্ধুদের নিয়ে নদীর পাড়ে খেলাধুলা করত। ও ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিল। ও বন্ধু-বান্ধবদের যেমন ভালবাসত, ওরাও তাকে ভালবাসত।”

হারানো ছেলের কথা স্মরণ করতে গিয়ে নাসিমা আক্তার যেন দেখতে পাচ্ছিলেন কৈশোরের সেই আদনানকে।

“ছোট থেকেই খেলাধুলার প্রতি প্রচণ্ড নেশা ছিল। সে ছিল স্বাধীনচেতা। একবার/দুইবার রিডিং পড়ত, সেটাই ছিল ওর পড়া। এতে ওর বাবার কোনো আপত্তি ছিল না, আমারও ছিল না।”

পরে সিরাজগঞ্জ থেকে উপ-সচিব হয়ে ঢাকায় এসে অর্থ মন্ত্রণালয়ে যোগ দিলেন সিনহার বাবা। আর সিনহা ভর্তি হলেন কুর্মিটোলায় বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখান থেকে এসএসসি আর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে এইচএসসি করে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আইবিএতে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে সুযোগ হওয়ায় সেখানেই যোগ দেন।

 

সেনাবাহিনীর অন্য জীবনে : ২০০৩ সালের ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির (বিএমএ) ৫১তম লং কোর্সে যোগ দেন সিনহা। ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশন পান।

সেইসব দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন তার এক কোর্সমেট। এখনও বাহিনীতে থাকায় নিজের পরিচয় তিনি গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে চাননি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা কোর্সমেটরা যখন একত্রিত হই, ওর কথা কোনো না কোনোভাবে আসবেই। বিএমএতে জয়েন করার পর আমরা ধরেই নিয়েছিলাম সিনহাকে কেউ টপকাতে পারবে না। ফাস্ট টার্মে ও খুব ভালো করল। সেকেন্ড টার্ম থেকেই ওর মধ্যে একটা চেইঞ্জ এল। নিজে ফার্স্ট হওয়ার বদলে সেকেন্ড থেকে থার্ড টার্ম এবং ফাইনাল টার্মে সে অন্যদের সাহায্য করা শুরু করল।

“পড়াশোনার জটিল বিষয়গুলোতে অন্যদের সাহায্য করত। বিএমএতে প্রচুর অ্যাসাইনমেন্ট করতে হয়। অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতে অনেকেই সিনহার দ্বারস্থ হত। সারারাত না ঘুমিয়েও ওর কিছু হত না। কোর্সমেটরা কোনোভাবে যদি সমস্যাটা ওকে বুঝিয়ে বলতে পারত, তাহলে এটা নিশ্চিত ছিল যে সে সাহায্য পাচ্ছে।”

সেনাবাহিনীর ওই কর্মকর্তা বলেন, “বিএমএতে মাইল টেস্ট খুবই গুরুত্বপর্ণ। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এক মাইল দৌড়ে আসতে হত। মাইল টেস্টে অনেকেই পাস করতে পারত না। তখন সিনহা দায়িত্ব নিল তাদের পাস করানোর।

“প্রথম প্রথম সিনহা দশের মধ্যে দশই পেত। পরে সবাইকে সাহায্য করতে গিয়ে ছয় পাওয়া শুরু করল। শেষের দিকে ট্রেইনার যারা ছিলেন (প্লাটুন কমান্ডার), তারাও সিনহার দ্বারস্থ হতেন। কোনো ক্যাডেট পাস করতে পারছেন না, ট্রেইনাররা সিনহাকে বলতেন তাকে একটু সাহায্য করার জন্য।”

সেসব দিনে সিনহাকে প্রচুর বই পড়তে দেখেছেন তার এই কোর্সমেট। বইয়ের সেই নেশার কথা পরে সিনহার বন্ধু হয়ে ওঠা শিপ্রার মুখেও শোনা গেছে।

২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ‘ভিআইপি প্রটেকশন কোর্স’ করে এসে ওই বছর ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সে (এসএসএফ) যুক্ত হন সিনহা। ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি এসএসএফে ছিলেন।

২০১৩ সালে আইভরি কোস্টে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের দায়িত্ব সেরে এসে পদোন্নতি পেয়ে মেজর হন সিনহা। পাঁচ বছরের মাথায় স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান।

সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া, চাকরি ছাড়া সবই নিজের ইচ্ছেয় করেছেন সিনহা। তার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বলেন, “আর্মিতে যাওয়া তার একটা স্বপ্ন ছিল। সে স্বেচ্ছায় আর্মিতে গিয়েছিল। এই প্রফেশনকে সে খুব ভালবাসত। তার মধ্যে দেশপ্রেম ছিল।”

আবার সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার আগেও বোনকে জানিয়েছিলেন সিনহা। স্কুল শিক্ষক শারমিন বলেন, “ও তখন আমাকে বলেছিল- ‘অনেক দিন সেখানে কাজ করলাম, সেখান থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। সেনাবাহিনী আমার ভালো লাগার জায়গা। একই সাথে আমি নতুন কিছু শিখতে চাই। সারা পৃথিবী ভ্রমণ করতে চাই’।”

 

বিশ্ব ভ্রমণের প্রস্তুতি : শারমিন বলেন, “যখন ক্লাস টুতে পড়ে, তখন থেকেই আদনান বলত সে হিমালয়ে যাবে। এজন্য টাকা দরকার। কিন্তু টাকার ব্যবস্থা করবে কীভাবে? আম্মুকে বলত- ‘তুমি বাইরে থেকে পান না কিনে আমার কাছ থেকে কিনো’। ও আম্মুর কাছে দুই টাকা করে পান বিক্রি করত, আর বলত, ‘টাকা জমতে জমতে আমি যখন বড় হব, তখন এই টাকা দিয়ে আমি হিমালয়ে যাব’।”

বোনের ভাষায়, সিনহার বিশ্ব ভ্রমণ মানে বিলাসবহুল হোটেলে থেকে বেড়ানো নয়, অলিতে-গলিতে ঘুরে তাঁবু খাটিয়ে থাকা।

“প্রথমে চায়না, এরপর সেটা শেষ করে নেপালে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এভারেস্টের বেইজ ক্যাম্প শেষ করে তার ইচ্ছে ছিল শেরপা ছাড়া এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করবে। এটা শেষ করে বিশ্ব ভ্রমণের অন্যান্য যায়গায় বের হওয়ার কথা ছিল তার।”

সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সিনহা। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চে শুরু হয় করোনাভাইরাস মহামারী। দেশে দেশে লকডাউনে পৃথিবী স্থবির হওয়ার দশা।

শারমিন বলেন, “২০১৯ সালে বিশ্ব ভ্রমণে বের হওয়ার জন্য ২৫ কেজির ব্যাকপ্যাকও রেডি করে রেখেছিল। ভ্রমণে সাইক্লিং করার কথা ছিল। সেজন্য ব্যাগ ২৫ কেজির মধ্যে রেখেছিল। কিন্তু করোনার সংক্রমণ শুরু হলে সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল, ওর ভ্রমণে আর যাওয়া হয়নি।”

 

‘জাস্ট গো’ : ২০১৮ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরে বেড়াতে গিয়ে স্ট্যামফোর্ডের ছাত্রী শিপ্রার সঙ্গে পরিচয় হয় সিনহার। ঘোরাঘুরির আগ্রহ থেকেই ভ্রমণ বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ এবং তা ফেইসবুক, ইউটিউবে প্রকাশ করার পরিকল্পনা করেন দুজন। সেই পরিকল্পনা থেকেই ‘জাস্ট গো’ নামের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেল খোলার সিদ্ধান্ত হয়।

২০২০ সালের অগাস্টে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শিপ্রা বলেছিলেন, “সিনহার পাগলামির জায়গা ছিল ট্রাভেলিং আর আমার ফিল্মিং। সিনহা সৃজনশীল ছিলেন, জ্ঞানী ছিল, প্রচুর পড়াশুনা করত। বন্ধু হিসেবে কখন মানুষ কাছে আসে? যখন তাদের চিন্তাভাবনার মিল থাকে। আমাদেরও তা-ই হয়েছিল।

“সিনহার মূল পরিকল্পনা ছিল বিশ্ব ভ্রমণ। যখন আমার প্ল্যান শুনল, বলল, এটা অনেক সহজ, এটা যদি করি, তাহলে ওয়ার্ল্ড ট্যুরটা করতে পারব একসাথে।”

‘জাস্ট গো’ নামটা শিপ্রাই প্রস্তাব করেছিলেন, সিনহারও সেটা মনে ধরেছিল। তাদের প্রথম কাজটি হল ২০২০ সালের মার্চ-এপ্রিলে, নওগাঁর আলতাদীঘিতে। সেই ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল আইফোন দিয়ে। সিনহার মৃত্যুর পর সেই ভিডিও ভাইরাল হয়। সেখানে ভয়েসওভারের কণ্ঠটি ছিল সিনহার।

আলতাদীঘির কাজ শেষে পরবর্তী শুটিংয়ের জন্য কক্সবাজারকে বেছে নেন সিনহা ও শিপ্র, সঙ্গী হন ক্যামেরা পাগল সিফাতও।

শিপ্রা বলেছিলেন, “ওই সময় খবর আসছিল, লকডাউনের কারণে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত অনেক পরিষ্কার ছিল, বিভিন্ন ধরনের কচ্ছপ আসছিল, সৈকতে ডলফিন আসছিল। এছাড়া কক্সবাজার থেকে বান্দরবান কাছে, খাগড়াছড়ি কাছে, চট্টগ্রাম কাছে। আমরা এক সাথে নদী, সমুদ্র, পাহাড় সবগুলো একসাথে একই জায়গায় পাব, জনসমাগম থাকবে না। আর সেজন্য আমরা কক্সবাজারকে বেছে নিয়েছিলাম।”

 

সত্যিই চলে যাওয়া : মহামারীর মধ্যে এই ঘোরাঘুরির কারণে মায়ের সংক্রমিত হওয়ার চিন্তায় ছিলেন সিনহা। রাজশাহী-নওগাঁ ঘুরে ঢাকায় ফিরেই জুলাইয়ের শুরুতে শুটিংয়ের জিনিসপত্র গুছিয়ে চলে যান কক্সবাজারে।

৩ জুলাই চারজন মিলে কক্সবাজারে পৌঁছানোর পর প্রথমে তারা কলাতলিতে ‘ওয়ার্ল্ড বিচ’ নামের একটি হোটেলে ছিলেন। পরে ওঠেন নীলিমা রিসোর্টে। ১৩ জুলাই কক্সবাজারের দৃশ্য ধারণ শুরু হয়। সে সময় রেজু খাল, পাহাড় ও সমুদ্রের পাশের দৃশ্য ধারণ করেন তারা।

শিপ্রার ভাষায়, সিনহা খুব দ্রুতই ডকুমেন্টারি তৈরির কাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন।

“সে মিডিয়ার লোক ছিল না, তবে সে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিল। পেশাদার লোক না হয়েও সে বিষয়গুলো দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিল।

“সিনহা আর্মির চাকরি করায় সেইফটির বিষয়টি খুব খেয়াল রাখত। যে কোনো কিছু করতে গেলেই আগে সেইফটি ও সিকিউরিটির বিষয়গুলো সে ঠিক রাখত। কক্সবাজারে পাহাড়ে চড়া, সাগরে নামা, সবগুলো কাজের জন্য সেইফটি গিয়ার আমাদের সঙ্গে ছিল।”

৩১ জুলাই বিকালে সিফাতকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ে চলে যান সিনহা, সন্ধ্যার পর তারার ছবি তুলতে। শিপ্রা তখন কটেজে। বিকালের দিতে পাহাড় থেকে ছবিও পাঠিয়েছিলেন সিনহারা। সেদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ফোন শেষবার কথা হয়।

“তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, কী অবস্থা তোমাদের আর কত সময় লাগবে? সে বলে, সন্ধ্যার পরে আকাশে যে তারা উঠে, সেই বিষয়ে টাইম ল্যাপস (সময়ক্রম) ছবি নিচ্ছিল।

“সিনহা বলেছিল, সাড়ে ৮টার মধ্যে আমাদের ছবি নেওয়া হয়ে যাবে। সাড়ে ৯টার মধ্যে আমরা ফিরে আসব। আমি বলেছিলাম, ওকে ফাইন, টেক কেয়ার।”

এরপর আর রিসোর্টে ফেরা হয়নি সিনহার, পথেই তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান তিনি।

কক্সবাজারে থাকার সময় ২৬ জুলাই ছিল সিনহার জন্মদিন। তার জন্মদিনে মোবাইলে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি মা ও বড় বোন অনলাইনে উপহারও পাঠিয়েছিলেন।

মা নাসিমা আক্তার বলেন, “তার জন্ম যেই মাসে, মৃত্যুও সেই মাসে। তার জন্ম পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড় ঘেরা জায়গায়, সেই পাহাড়-সমুদ্র ঘেরা জায়গায় তার মৃত্যু হল।”

আর সিনহার বড় বোন বললেন, “নিরাশা, হতাশা, নেতিবাচকতা আমার ভাইয়ের অভিধানে ছিল না। আর আমরাও তার পথ অনুসরণ করে আশা- ইতিবাচকতা- মানসিক শক্তি নিয়ে এগিয়ে চলছি। আর হ্যাঁ, আদনান অবশ্যই আমাদের সাথে আছে- তাকে ছাড়া আমাদের জীবন না। সে ছিল, আছে ও থাকবে আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে।বিডি নিউজ২৪ ডটকম ”

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।