বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৪৬ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
অভিযুক্তই যখন কর্মকতা

নিউজ ডেক্স : যে সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বড় রকমের দুর্নীতির অভিযোগ উঠল এবং সেই দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু করল যে সংস্থাটি, বছর পেরোতে না পেরোতেই সেই সংস্থারই মাথার ওপরে নাজেল হলেন ওই ‘দুর্নীতিবাজ’ কর্মকর্তাটিই।

আবার মাথায় গিয়ে বসতে না বসতেই নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ, চলমান অনুসন্ধান সব ‘উধাও’ হয়ে গেল। কখনও বা আত্মীয়স্বজনের নামও অভিযোগপত্র থেকে ‘গায়েব’ হয়ে যায়। ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে দেশে দুর্নীতি ঠেকানোর সর্বোচ্চ সংস্থা ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’-দুদকে।

২০০৪ সালের ৯ মে তারিখে গঠিত হয় স্বাধীন ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’, সংক্ষেপে একে ডাকা হয় দুদক নামে। দুদকের ওয়েবসাইটে এই কমিশনের ‘রূপকল্প ও লক্ষ্য’ অধ্যায়ে লেখা আছে, ‘সমাজের সর্বস্তরে প্রবহমান একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী সংস্কৃতির চর্চা এবং এর প্রসার সুনিশ্চিত করা’ দুদকের রূপকল্প আর ‘অব্যাহতভাবে দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ এবং উত্তম চর্চার বিকাশ সাধন করা’ দুদকের লক্ষ্য।

এর পর তিনটি কৌশলগত লক্ষ্যের উল্লেখ করে বলা আছে- এই তিনটি লক্ষ্য আবার ‘চারটি সহায়ক লক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত’। এই সহায়ক লক্ষ্য চারটির একটি হলো- ‘মানবসম্পদ সহায়তা ও উন্নত অভ্যন্তরীণ শাসনপদ্ধতি প্রদান করা’। কিন্তু প্রতিদিনের বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গত প্রায় এক মাস ধরে চালানো অনুসন্ধান বলছে, খোদ দুদকের ভেতরেই চলছে সম্পূর্ণ উল্টো সব কর্মকাণ্ড।

যেমন, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ছিলেন আবদুন নূর মুহম্মদ আল ফিরোজ (আ ন ম আল ফিরোজ)। বিতর্কিত-দুর্নীতিবাজ ঠিকাদার জি কে শামীম এবং ক্যাসিনো ডন সম্রাট গংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে সরকারের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক অনুসন্ধান শুরু করে ২০১৬ সালে। কিন্তু অনুসন্ধান চলা অবস্থাতেই অভিযুক্ত এই কর্মকর্তাকে ২০১৯ সালে প্রেষণে দুদকেরই মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

সেই সময় দুদকের চেয়ারম্যান ছিলেন ইকবাল মাহমুদ, কমিশনার ছিলেন এএফএম আমিনুল ইসলাম ও বর্তমান কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান। দুদকের সর্বোচ্চ পদের এই তিন কর্মকর্তার মধ্যে কমিশনার এএফএম আমিনুল ইসলাম দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ওই আমলা আ ন ম আল ফিরোজকে দুদকে বদলি করায় চেয়ারম্যান বরাবর দুই পাতার একটি নোট দেন, যেখানে তিনি উল্লেখ করেন- ‘দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এমন একজন কর্মকর্তার কোনোভাবেই দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে আসা উচিত নয়।’ তিন কমিশনারে গঠিত দুদকের একজনের লিখিত অভিযোগের পরেও কিচ্ছু হয়নি ওই আমলার। প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে দুদকের বিধি অনুযায়ী তিন বছরের পূর্ণ মেয়াদেই স্বপদে বহাল থাকেন আল ফিরোজ।

জানতে চাইলে প্রতিবাদকারী সাবেক কমিশনার (তিনি এখন অবসরে) এএফএম আমিনুল ইসলাম গত ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি একটি নোট দিয়েছিলাম। নোটে কী লিখেছিলাম, সেটা না দেখে হুবহু বলা যাচ্ছে না। তবে নোটের সারাংশটা এমন ছিল- ‘আ ন ম আল ফিরোজ নামের ওই কর্মকর্তা যেহেতু অনিয়ম-দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত, তাকে যেন দুদক থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। তার নিয়োগ দুদকের ভাবমূর্তি ও কাজের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’

দুদকের এই সাবেক কমিশনার আরও বলেন, ‘আমি নোট লিখে কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর জমা দিয়েছি। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নিয়ম হচ্ছে- ফাইল পর্যায়ক্রমে নিচ থেকে ওপর দিকে ওঠে, আবার সেটা ধাপে দাপে নিচে নেমে আসে। কিন্তু দুদকে সে নিয়ম নেই। আমরা নোট লিখে চেয়ারম্যানের কাছে দিই, কিন্তু পরে এসবের বিষয়ে খুব একটা খবর জানা হয় না। ওই ফাইলটার বিষয়েও পরে আর বিশেষ কিছু জানতে পারিনি। তবে অভিযুক্ত সেই অফিসারের বিষয়ে যে নোট দিয়েছি, সেটা সত্য।’

দুদক চাকরিবিধি ২০০৮-এর ৮ (১) বিধিতে প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘তফসিলের বিধান সাপেক্ষে কোনো পদে প্রেষণে নিয়োগের ক্ষেত্রে কমিশন সরকার, ব্যাংক বা বিধিবদ্ধ সংস্থা বা কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোনো উপযুক্ত কর্মচারীকে স্থিরীকৃত শর্তাধীনে নিয়োগ করিতে পারিবে।’ একই ধারার ৮-এর ২(ক)-তে বলা হয়েছে, ‘প্রেষণের সময়কাল, ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া, তিন বৎসরের অধিক হইবে না; (খ) মাতৃসংস্থার চাকুরীতে কর্মকর্তার পূর্বস্বত্ব থাকিবে এবং প্রেষণের সময়কাল শেষ হইবার পর অথবা তৎপূর্বেই ইহার অবসান ঘটিলে তিনি মাতৃসংস্থার চাকুরীতে প্রত্যাবর্তন করিবেন।’

‘দুদক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমন অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের কেন নিয়ে আসে’ প্রশ্ন করলে দুদকের আরেক সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘দুদকের জনবল সংকট হলেই তখন প্রেষণে কর্মকর্তা নিয়ে আসে। দুদক তো কোনো অপরাধী আনতে চায় না। যখন কোনো পদ শূন্য হয়, তখন কেবিনেট ডিভিশনে কী ধরনের, কতজন কর্মকর্তা প্রয়োজন, সেটা জানিয়ে চিঠি দেয়। কেবিনেট ডিভিশন সেটি পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। দুদকের যে যে পদে লোক দরকার, জনপ্রশাসন থেকে সেগুলোতে পদায়ন করা হয়ে থাকে।’

তিনি আরও জানান, প্রেষণে আসা কর্মকর্তা অনধিক তিন বছর দুদকে কাজ করতে পারবেন। তবে কমিশন চাইলে তাকে যেকোনো সময় যে দপ্তর থেকে এসেছেন, সে দপ্তরে ফেরত পাঠাতে পারবেন।

‘অভিযুক্তরা কীভাবে প্রেষণে আসে’ প্রশ্ন তুললে মঈদুল ইসলাম বলেন, ‘দুদকে আসার পর যদি জানা যায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, দুদক চাইলে সেই কর্মকর্তাকে গ্রহণ না করে নিজ দপ্তরে ফেরত পাঠাতে পারে। কেন ফেরত পাঠাল সেই কারণ উল্লেখ করে দুদক তা করতে পারে। সে ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে। কমিশন যদি সেই ক্ষমতা প্রয়োগ না করে, সেই গাফিলতির দায়ও কমিশনের’- মন্তব্য করেন এই সাবেক মহাপরিচালক।

দুদকের একটি সূত্র জানায়, নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগটি তখন ওই মহাপরিচালক নিজ ক্ষমতাবলেই নিষ্পত্তি করিয়েছেন। দুদক নিজেই কোনো অভিযোগ নিষ্পত্তি করা মানে অভিযোগ ও তদন্ত-অনুসন্ধান ডিসমিস করে অভিযুক্তকে নিষ্কৃতি দেওয়া।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিতর্কিত মহাপরিচালক আ ন ম আল ফিরোজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দুদকের উপপরিচালক জালাল উদ্দিন আহমেদকে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তার কাছে জানতে চাইলে ‘অভিযোগের বিষয়টি তার মনে নেই বলে জানান জালাল উদ্দিন। প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘আমার এমন কিছু এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।’

বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে অতিরিক্ত সচিব পদে কর্মরত আ ন ম আল ফিরোজের সঙ্গে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে বিষয়টি তুললে প্রথমে তিনি এই প্রতিবেদককে ভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তাকে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়- ‘আপনি যখন দুদকের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান, তখন সেখানেই আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছিল কি না?’ এ প্রশ্নের জবাবে আল ফিরোজ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ওটা তো আগেই নিষ্পত্তি হয়ে যায়। ২০১৬ সালের অভিযোগ; আমি দুদকে যাওয়ার আগেই নিষ্পত্তি হয়েছিল।’

‘আমাদের কাছে যেসব নথিপত্র আছে, সেখানে যে দিন-তারিখ উল্লেখ আছে, তাতে দেখা যায়, আপনি দুদকের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত অবস্থায় অভিযোগটি নিষ্পত্তি হয়েছে’ জানালে আল ফিরোজ তখন বলেন, ‘আমি যাওয়ার আগে না ঠিক, তখন ওইরকম নিষ্পত্তি হবে ডিসিশন হয়েছিল। আমি দুদকে থাকতেই নিষ্পত্তির অর্ডারটা হয়েছে আর কী!’ তার বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে প্রশ্ন করলে অভিযোগ অস্বীকার করে আল ফিরোজ বলেন, ‘আমি গৃহায়নে দায়িত্বে থাকার সময় একটি রিপোর্ট দেওয়ার বিষয় ছিল। ওরা (দুদক) তিনজনকে দিয়েছে, তিনজনের একজন হিসেবে আমাকেও দিয়েছে।’ তাকে দুদক থেকে সরাতে তৎকালীন দুদক কমিশনার আমিনুল ইসলামের দেওয়া নোটের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে আল ফিরোজ বলেন, ‘আমিনুল স্যার তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন, অভিযুক্ত সেই মানুষটা আমিই কি না। তখন তিনি নোট দিয়েছিলেন- আপনি অভিযুক্ত হলে আপনার দুদকে থাকা ঠিক হবে না।’ খোদ কমিশনারের এমন মন্তব্যের পরও দুদকে আরও এক বছর কর্মরত থাকার কথা স্বীকার করে বিতর্কিত আমলা আল ফিরোজ বলেন, ‘হ্যাঁ, এর পরেও আমি এক বছর ছিলাম দুদকে।’

প্রতিদিনের বাংলাদেশের অনুসন্ধানে দুদকে এ রকম আরও অনেক ঘটনা বেরিয়ে এসেছে। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতি, কেনাকাটায় অনিয়ম, সরকারি ক্রয়নীতি (পিপিআর)-এর শর্ত অনুযায়ী জাতীয় পত্রিকা বা অনলাইনে দরপত্র আহ্বান না করেই পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ছিল রংপুর সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আক্তার হোসেন আজাদের বিরুদ্ধে। এর ভিত্তিতে ২০১৮ সালে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। অথচ অনুসন্ধান চলমান অবস্থাতেই ২০২০ সালে আক্তার হোসেন আজাদকে প্রেষণে সেই দুদকেই পরিচালক (অর্থ) পদে বদলি করা হয়।

এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল- তিনি রংপুর সিটি করপোরেশনের ৪৮টি লটে ১৮টি প্যাকেজে বিভিন্ন কাজ জাতীয় দৈনিক বা অনলাইনে দরপত্র আহ্বান না করেই টাকার বিনিময়ে পছন্দের ঠিকাদারদের পাইয়ে দিয়েছিলেন। তবে দুদকের পরিচালক হয়ে আসার পর তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান পর্ব শেষ করে ‘পিপিআর-এর শর্ত ভঙ্গের মাধ্যমে সরকারের ৭ কোটি ৬ লাখ ২৫ হাজার ৩৩৬ টাকা আত্মসাৎ’ করার দায়ে একটি মামলা করা হয়।

গত ২৭ জুন ২০১৯ তারিখে দুদকের উপসহকারী পরিচালক নূর আলম বাদী হয়ে সংস্থাটির সমিন্বত জেলা কার্যালয় রংপুরে মামলাটি দায়ের করেন। কিন্তু ওই মামলায় সেই প্রধান নির্বাহী আক্তার হোসেন আজাদকে বাদ দিয়ে একমাত্র আসামি হিসেবে নাম দেওয়া হয় রংপুর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা গুলজার রহমানের। ২০২১ সালে এই মামলার চার্জশিট দাখিল করা হলে আদালত চার্জ গঠন করে বিচার-শুনানি শেষে ২০২২ সালে রায় প্রদান করে।

রায়ে উল্লেখ করা হয়, ‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধি ২০০৮ অনুসারে জাতীয় পত্রিকায় দরপত্র আহ্বান করার নিয়ম থাকা সত্ত্বেও সেটি মানা হয়নি। প্রকল্পের ক্রয় ও মূল্যায়ন কমিটির প্রধান হিসেবে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও মেয়র এই দায় এড়াতে পারেন না।’ শুনানি শেষে অভিযোগটি দুদকের সচিব বরাবর পুনঃতদন্তের আদেশ দিয়ে ফেরত পাঠান আদালত।

জানা গেছে, দুদকের রংপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক হোসেন শরীফ এই মামলাটির পুনঃতদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন।

বক্তব্যের জন্য অভিযুক্ত দুদক পরিচালক (অর্থ) মো. আক্তার হোসেন আজাদকে গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকবার ফোন করা হয়। রিং হলেও প্রতিবারই তিনি ফোন কেটে দেন। নিউজ সংক্রান্ত বক্তব্য নেওয়ার কথা জানিয়ে এসএমএস করলে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টায় তিনি ফিরতি এসএমএস-এ লেখেন, ‘সরি, আই এম রিলিজড ফ্রম এসিসি’। পরে ওই দিনই বেলা ৩টা ১০ মিনিটে আরও একটি এসএমএসের মাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার কথা জানালে তিনি আর কোনো সাড়া দেননি। আবার ফোন করলেও ধরেননি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি নথি থেকে জানা যায়, গত বছরের ৪ ডিসেম্বর আক্তার হোসেন আজাদকে বদলি করে যুগ্ম সচিব হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়। কিন্তু দুদকের একটি সূত্র জানায়, আড়াই মাস হয়ে গেলেও তিনি সেখানে যাননি; দুদকেই রয়ে গেছেন; এই মুহূর্তে ৪০ দিনের একটি প্রশিক্ষণে রয়েছেন। সূত্রটি আরও জানায়, তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের পুনঃতদন্ত শুরু হওয়ার কারণেই দুদক থেকে তিনি রিলিজ অর্ডার নিচ্ছেন না।

দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ ওঠা এবং তদন্ত-অনুসন্ধান চলমান থাকা কর্মকর্তাদের প্রেষণে দুদকে বদলির ঘটনার ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটা প্রত্যাশিত না। এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব যারা দুর্নীতি করে তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সরকারি অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকতে পারে। এমন অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে দুদকে পদায়ন করা অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।’

তিনি বলেন, দুদকে বদলি হয়ে আসার পর যদি অভিযোগটি নিষ্পত্তি হয়, তখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, তাকে এখানে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিষ্পত্তি করানোর জন্যই আনা হয়েছে। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘শুরু থেকেই দুদকের এক শ্রেণির কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের সঙ্গে অবৈধভাবে যোগসাজশ করে এখানে পদায়ন করা হয়ে থাকে।’

২০১৯ সালের ২৮ মার্চ ঢাকায় বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল; আহত হয়েছিল শতাধিক মানুষ। পরে দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ভবনটির তিনটি ফ্লোর রাজউকের নকশাবহির্ভূতভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এই ঘটনায় আর্থিক অনিয়ম করার অভিযোগে দুদক ভবন মালিকপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষেরসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। দুদকের উপপরিচালক আবু বকর সিদ্দিক বাদী হয়ে ওই বছরের ২৫ জুন মামলাটি করেন। তবে পরের বছর ১৩ ডিসেম্বর আদালতে চার্জশিট জমা দেয় দুদক। তবে চার্জশিট থেকে রাজউকের এস্টেট শাখার সদস্য রেজাউল করিম তরফদারসহ পাঁচজনের নাম বাদ দেওয়া হয়। এজাহারে থাকা আসামিদের নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়ার কারণ হিসেবে চার্জশিটে বাদী উল্লেখ করেন, সম্পৃক্ততা না থাকায় অভিযোগ থেকে তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মামলা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া রাজউকের এস্টেট শাখার সদস্য রেজাউল করিম তরফদার দুদকের তদন্ত-১ শাখার মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) রেজানুর রহমানের শ্বশুর। ওই মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘চার্জশিটে রেজাউল করিম তরফদারের নামটি বাদ রাখতে তার মেয়ে-জামাই দুদকের ওই মহাপরিচালককে চাপ দেন। মামলায় অভিযোগপত্রটি আদালতে দাখিল করলেও নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে আদালত থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।’ অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে দুদকের ওই মহাপরিচালক রেজানুর রহমানের মোবাইল ফোন নম্বরে গত ১৬, ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি তিন দিনে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি তার ফোন নম্বরে এবং হোয়াটসঅ্যাপে পরিচয় ও প্রয়োজন জানিয়ে এসএমএস করলেও তিনি সাড়া দেননি।

অনুসন্ধানে আরেকটি দৃষ্টান্ত মেলে লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল আউয়ালের ঘটনায়। প্রকৃত ভূমিহীন বাদ দিয়ে অবস্থাপন্ন ও ভূমি মালিকের নামে সরকারের দশমিক ২২ একর খাস জমি বন্দোবস্ত দিয়েছেন তিনি, এই অভিযোগের প্রমাণ মেলে দুদকেরই অনুসন্ধানে। অথচ অনুসন্ধান চলাকালেই ওই কর্মকর্তাকে ২০১৭ সালে দুদক প্রধান কার্যালয়ে উপপরিচালক পদে বদলি করা হয়। পদোন্নতি পেয়ে এখন পরিচালকও হয়েছেন তিনি। তার আগে ২০১৬ সালেই অভিযোগ থেকে সেই ইউএনওকে বাদ দিয়ে শুধু ভূমিগ্রহীতা সেলিনা আক্তার নিশু ও তার স্বামী কাজী আলাউদ্দিন বাবুলের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর মামলার চার্জশিট দাখিল করে সংস্থাটি।

দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা উপসহকারী পরিচালক মো. শোয়ায়েব হোসেন ও মো. সাফিউল্যা চার্জশিটে লেখেন, ‘কোনো আবেদনকারী যদি নিজের তথ্য গোাপন করেন, তার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী।’ কিন্তু আদালতের রায়ে প্রশ্ন তোলা হয়, ‘কেউ প্রকৃত ভূমিহীন কি না, তা জানতে যদি ভূমি অফিস অক্ষম হয়, তাহলে রাষ্ট্রের ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য ভূমি অফিস রাখার যৌক্তিকতা কী?’ দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে ভূমিগ্রহীতা নিশুর স্বামীর নামে প্রায় দুই একর জমি থাকার নথি যুক্ত করা হয়। সেটা আমলে নিয়ে আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, বন্দোবস্ত নীতি অনুযায়ী সেলিনা আক্তার নিশু সকল তথ্য গোপন করেছেন, তা বলার অবকাশ নেই। তিনি নিজেকে ভূমিহীন দাবি করলেও স্বামীর নাম গোপন করেননি। বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ায় দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের তার স্বামীর সম্পত্তির অনুসন্ধান করা প্রয়োজন ছিল।’

২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর নোয়াখালীর বিশেষ জজ আদালতে মামলার নথি থেকে ইউএনও আবদুল আউয়ালের নাম বাদের বিষয়টি নজরে এলে আদালতের রায়ে উল্লেখ করেন, ‘কোন ব্যক্তি বিশেষ থেকে আবেদনকারীকে ভূমিহীন মর্মে জেনেছেন, তা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে ‘আবেদনকারী ভূমিহীন’ এই বিষয়টি উক্ত কর্মকর্তা নিজ দায়িত্বে নিশ্চিত হয়েছেন বলা ছাড়া সুযোগ নেই। আবেদনকারীকে ‘ভূমিহীন’ সাব্যস্ত করার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কোনো প্রকার সূত্র উল্লেখ না করার কারণ কী ছিল, এই বিষয়টিও তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করেননি।’ আদালত রায়ে বলেন, ‘তদন্তের ত্রুটিসমূহ নিরসনকল্পে অত্র মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ প্রদান করা হলো। সেক্ষেত্রে পূর্ববর্তী তদন্তকারী

কর্মকর্তার পরিবর্তে অন্য কোনো কর্মকর্তা দ্বারা অধিকতর তদন্ত করানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সচিব দুদককে নির্দেশ প্রদান করা হলো। এবং অত্র মামলাটি চার্জ গঠনের পর্যায় হতে উত্তোলন করা হলো।’

অভিযুক্ত ইউএনও থেকে দুদকের পরিচালক পদে উন্নীত আবদুল আউয়ালের কাছে জানতে চাইলে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘ভূমি বন্দোবস্তের কাজটি করে থাকে ইউনিয়ন পরিষদ ও ভূমি অফিস; আমি পদাধিকারবলে সভাপতি। আমাদের জানার সুযোগ হয় না কে ভূমিহীন, কে নয়। তা ছাড়া লক্ষ্মীপুরের কমলনগর একটি নদীভাঙনপ্রবণ এলাকা। তাদের কার জমি আছে, কার নেই- সেটা জানার সুযোগও সীমিত। কেউ যদি মিথ্যা ভূমিহীন পরিচয় দিয়ে খাসজমি নিয়ে থাকে, তাহলে সেটা বাতিল করার এখতিয়ার আমাদের আছে।’

গত ৯ ফেব্রুয়ারি দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদকে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন। পরে অসুস্থতার কথা বলে ফোন রেখে দেন। তারপর ১৫ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিনই একাধিকবার ফোন নম্বরে ও হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি, এসএমএস করা হলেও তার উত্তর দেননি।

দুর্নীতি দমন কমিশনে অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের প্রেষণে বদলি করার বিষয়ে গত ২০ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, অভিযোগ চলমান রয়েছে এমন কাউকে দুদকে দেওয়া হয়েছে আমার জানা নেই। এটা আমি অবশ্যই জানার চেষ্টা করব। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে তাদেরকে যেন না দেওয়া হয় সেটা আমি আপনার সঙ্গে একমত পোষণ করি। যাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ রয়েছে তারা যেন না আসতে পারে সেটাও আমরা দেখব।

ফরহাদ হোসেন আরও বলেন, আপনার যে প্রশ্ন সেটা হলো অভিযুক্ত একজন কর্মকর্তার কীভাবে দুদকে পদায়ন হয়? বিষয়টি যদি এমন হয়, আমি অবশ্যই এটি দেখব এবং ব্যবস্থা নেব। মাঠ প্রশাসনে থাকতে ন্যূনততম অভিযোগ আছে এমন কোনো কর্মকর্তাকে আমরা দেইনি। যদি কেউ এখানে থেকে থাকেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায় তখন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় যে শাস্তির বিধান রয়েছে সেটা হবে। কেউ কেউ ওএসডি হয়ে যান, কেউ চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অনেক সময় কমিশন থেকে চেয়ে নেওয়া হয় ওই অফিসারটা ভালো তাকে দেন। আমরা চাইলেই দিই তা না, যাচাই-বাছাই করেই দিই। আমরা যখন দিই তখন বিষয়গুলো ওভারলেপ হয় কি না সেটা একটা প্রশ্ন।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হকের মোবাইল ফোনে ফোন করে জানতে চাওয়া হয়েছিল, অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনে বিশেষ সুবিধা পান। এই প্রশ্নের উত্তরে জহুরুল হক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বিশেষ সুবিধা তো না, কমিশনের মেজোরিটি আমলা। এ ছাড়া বাংলাদেশে কিছু আমলাতান্ত্রিক প্রভাব তো আছেই, তা অস্বীকার করা যায় না। আপনারা যদি স্পেসিফিক লেগে থাকেন তাহলে সমস্যার সমাধান হবেই। প্রবা

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।