শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩৪ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
কুমারপল্লীর জীবন, ফিকে হয়ে গেছে প্রাণ জৌলুস

নিউজ ডেক্স : কুমারদের পাড়াগুলো সাধারণত নদীর ধারেই হয়। নদীর তলায় ভালো এঁটেল মাটি পাওয়া যায় কিনা! কুমারদের প্রায় সব কাজের কাঁচামাল এই শক্ত এঁটেল মাটি। তাই বোধহয় নদী বুকে নিয়েই চলতে হয় তাদের। বহুরিয়া কুমারপাড়াটিও এর ব্যতিক্রম নয়। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর হয়ে বহুরিয়া গ্রামের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে যমুনার এক শাখা নদী। তার পাড়েই একটুকরো জায়গায় কাঁথার মতো জড়িয়ে আছে বহুরিয়ার এই কুমারপল্লী। পাশ ঘেঁষে যে শাখা নদীটি চলে গেছে, তার নাম লৌহজং। সেই নদীও মরতে বসেছে। জবরদখল হয়ে আছে নানা গোষ্ঠীর হাতে।
একসময় এই কুমারপাড়াটি ছিল জমজমাট। ছিল গায়ে গায়ে লাগোয়া ঘর। ছোট ছোট নিকানো উঠান। কাঠের ভারী চাকা। সারি সারি শুকাতে দেওয়া কাঁচা হাঁড়ি-পাতিল।‌ বাড়ির সবার হাতেই কাদার ছাপ। এই ছিল একসময়কার কুমারপাড়ার সাধারণ দৃশ্য।
তবে এখনকার কুমারপাড়ায় চিত্র উল্টো। যেমন চিত্তরঞ্জন পাল। কুমোর পাড়ার তরুণ এই ছেলেটি বাপদাদার পেশা ছেড়ে হাতে নিয়েছে রাধুনির কাজ। বৃদ্ধ রতন পাল বললেন ‘আর বলো না কাহা! মাটির কাজ কি এখন আছে? বিক্কিরি হয় না একফোঁটা। স্টিলের হাঁড়ি-পাতিল আছে না ঘরে? কে কিনবে মাটির এসব ঠুনকো জিনিস!’ তাহলে কীভাবে চলে আপনাদের? প্রশ্ন শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
‘ ছেলেপুলেরা সব অন্য কাজ ধরেছে। একেকজন একেক কাজে লেগেছে। কী লাভই বা এ কাজ শিখে! এই আমরা যারা বুড়োটুরো আছি, মাটির কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ শিখিনি তো। তাই কামড়ে আছি। ছেলেপুলেরা আর এসব করবে না কাহা!’ তিনি আরও জানান, খড়ি-লাকড়ির দামের কাছে কুলায়া উঠবার পারছি না।’
একসময় চাল, ডাল, সবজি, ফল, আনাজপাতি নিয়ে গাঁও- গেরামের গৃহিণীরা আসত কুমারপাড়ায়। চালের বদলে হাঁড়িটা, ডালের বদলে সরাটা, সবজি দিয়ে পাতিল, মুড়ি ভাজার ঠিলা নিয়ে যেত। কুমাররাও আবার হাঁড়িকুড়ি মাথায় করে হাঁটে বিক্রি করতে নিয়ে যেতেন। কখনও কখনও যেত দূর-দূরান্তের মহল্লায়। বিকিকিনি ছিল তখন। স্টিলের হাঁড়ি-পাতিলের চল হতেই পেশায় টান পড়তে শুরু করল। কুমারদের জাত-ধর্ম মাটির কাজ। জমিজিরাতও নেই তাদের। তারা এখন বিপদের মধ্যে পড়ছেন।
হাঁড়ি পোড়ানোর বিশাল চুল্লির ওপর কাজ করছিলেন এক কুমার গিন্নি। তাকে বললাম, কেমন চলে কাজ কারবার? শুকনো হেঁসে বললেন, ‘এখন শুধু ল্যাট্রিনের চাক বানাই গো। এটাই চলে।’ তবে দেখা গেল চাকের পাশেই দই বসানোর পাতিল আছে কিছু। আছে মুড়ি ভাজার ঠিলা, ছাবনি। এগুলো নাকি একটু-আধটু এখনও চলে। তাই বানানো হয় অল্প পরিমাণ। তবে ভালো দাম নেই। টানও নেই আগের মতো।
আহা! অতীতে কত পদের, কত ঢঙের তৈজসপত্র বানানো হতো এই কুমারপাড়ায়। মাটির বিশাল জালা, পানি রাখার কলস, ভাতের ফেন গালার ঢুকসা, কুপি রাখার গাছি, ভাতের হাঁড়ি, পান্তা ভাত জিইয়ে রাখার বেলী! সবই উধাও হয়ে গেছে। হয়তো একদিন শেষ সম্বল যেটুকু আছে, সেটুকুও মুছে যাবে। সে তো কেবল আরেকটি প্রজন্মের ফের!
যে কুমারপাড়া একসময় কাজের ফুরসত পেত না, অনেককেই বসে থাকতে দেখলাম। গিন্নিদের মাঝেও নেই তেমন ছোটাছুটি ভাব। যেন কুমারপাড়া মরে গেছে। ফিকে হয়ে গেছে তার প্রাণ- জৌলুস। এমন কড়া রোদে আগে কুমারপাড়া ভরে থাকত কাঁচা কাঁচা হাঁড়ি-পাতিলে। পাশেই বসে ছোট্ট কোনো মেয়ে কাঁচা হাঁড়ি পাহারা দিত আর একতাল কাদা নিয়ে পুতুলের নাক টিপে টিপে ছাঁচ বুনতো। এখনকার কুমারপাড়ার উঠানগুলো রোদে কেমন খাঁ খাঁ করছে। নেই সোঁদা মাটির গন্ধ! এভাবে চলতে থাকলে নিকট ভবিষতে এদের জাত পেশার ছিটেফোঁটাটি আর পাওয়া যাবে না। হারিয়ে যাবে মৃৎশিল্পের চিহ্নটুকু!

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।