শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৮ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
ঘাটাইলের কৃতি সন্তান মামুনুর রশিদের বয়স ৭২ হলেও জন্মদিন ১৮ তম

ডেক্স রিপোর্ট : নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক মামুনুর রশীদের ১৮তম জন্মদিন আজ। অধিবর্ষে জন্ম নেওয়া এই শিল্পীর জন্মদিন আসে চার বছর পরপর। বয়স ৭২, অথচ ১৮তম জন্মদিন! কিন্তু এটাই সত্য। ১৯৪৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারী তিনি মাতুলালয়ে টাঙ্গাইলের কালীহাতি থানার পাইপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ী টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ভাবনদত্ত গ্রামে।

মামুনুর রশীদের সহোদর অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান পেশাজীবী সমম্বয় পরিষদের সদস্য সচিব এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মামুনুর রশিদের বাবার নাম হারুনুর রশিদ খান। তিনি বাংলাদেশ ডাক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ভাবনদত্ত গ্রামে।

মামুনুর রশিদ বলেন, চার বছর পরপর আসে আমার জন্মদিন। বন্ধু, শুভানুধ্যায়ীরা অপেক্ষা করে, কখনো কখনো উৎসবের আয়োজন করে এটা আনন্দের বিষয়। এছাড়া বয়স এখনো আঠারোয় আটকে থাকল, এটাই বা কম কিসে। আমি আজকের দিনে কেবল দোয়া চাইছি সবার কাছে। এভাবেই যেন বাকিটা জীবন কাজ করে যেতে পারি।

২৯ ফেব্রুয়ারি, নিঃসন্দেহে এক দুর্লভ ও ব্যতিক্রমী দিন। প্রতি বছর তো আর তারিখটি আসে না। চার বছর পর পর প্রতি লিপইয়ারে ২৯ ফেব্রুয়ারি আসে। এই তারিখটি যদি কারো জীবনের বিশেষ দিন হয়, তাহলে…? বিশেষ এই দিনের জন্য চার বছর অপেক্ষা।

সম্প্রতি একুশে পদক পাওয়া খ্যাতিমান অভিনেতা ও নাট্য-ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ জন্মদিনটি তার কাছে ভীষণ আকাঙ্ক্ষিত।মামুনুর রশীদের কাছের মানুষ ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্যও নিশ্চয়ই এটি বহুল প্রতিক্ষীত, কারণ প্রিয়জনকে তো প্রতিবছর তারা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারেন না। এই বিশেষ দিনটি নিয়ে মামুনুর রশীদের অনুভূতি জানতে তার মুখোমুখি হয়েছিলেন সংবাদ কর্মী।

নিচে তার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হল:

আমাদের দেশের অনেকেরই জন্মদিন দুইটি। একটি হলো পৃথিবীর আলো দেখার দিনে, অন্যটি স্কুলে ভর্তি হওয়া সূত্রে। আপনার জন্মদিন কয়টা?

মামুনুর রশীদ : আমার এই একটাই জন্মদিন ২৯ ফেব্রুয়ারি। তবে বাবা আর মাকে আমার জন্মতারিখটা নিয়ে দ্বিধান্বিত হতে দেখেছি। আমার দাদা তার বংশধরদের সবার জন্মের খুঁটিনাটি নিয়ে লিখে রাখতেন ডায়েরিতে। সেই ডায়েরিটা হারিয়ে যাওয়ার কারণে এই দ্বিধার জন্ম হয়। তবে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখটাই জন্মদিন হিসেবে চুড়ান্তভাবে নির্ধারণ করা হয়।

চার বছর পরপর জন্মদিন, বিষয়টা কেমন লাগে?

মামুনুর রশীদ : ভালোই লাগে। ব্যতিক্রমী একটা ব্যাপার। মনে হয় বিষয়টা একদিক দিয়ে ঠিকই আছে, প্রতিবছর হলে সবার ঝামেলা হয়ে যেত। কারণ কাছের মানুষরা আমার জন্মদিনটি ইদানিং পালন করতে চায় । প্রতিবছর জন্মদিন পালনের জন্য সময় বের করা আমার জন্য কঠিন হয়ে যেত। চার বছর পর পর জন্মদিনের জন্য একটি দিন ছেড়ে দেওয়া যেতেই পারে।

ছোটবেলায় চার বছর পর পর জন্মদিন আসার ব্যাপারটি কখনো কী মনখারাপের কারণ হয়েছে?

মামুনুর রশীদ : মোটেও না। আসলে আমাদের সময় জন্মদিন পালনের এই ধারণাটাই তো ছিল না। সেজন্য এই দিনটা যে স্পেশাল কিছু, সেটা ভাববার কোন সুযোগই হয়নি। এমনকি ১২ বছর আগেও এই দিনটি কোন দিক দিয়ে চলে যেত টের পেতাম না। বুড়ো হওয়ার কারণেই বোধ হয় এখন আমার পরিবার দিনটি পালন করে আমাকে বয়সটা মনে করিয়ে দেয়।

শৈশবের মধুর স্মৃতি ….

মামুনুর রশীদআমার বাবা ছিলেন পোস্টমাস্টার। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বদলির চাকরি। শৈশবের দুয়েকটি স্মৃতি এখনো আমার মনে পড়ে। আমার তখন চার বছর বয়স। স্কুলে যাই। ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুরে বেবি ক্লাসে পড়ার সময় আমি প্রত্যেক বিষয়ে একশ’ পেলাম। আমার আর ক্লাস ওয়ানে পড়া হলো না। শিক্ষকরা আমাকে ক্লাস টুয়ে ডবল প্রমোশন দিয়ে দিলেন। আরেকটি স্মৃতি আছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আমি মামাবাড়িতে ছিলাম। দাঁতের ব্যথায় আমি খুব কাঁদছিলাম। আমার মা, আমাকে কোলে করে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলঘরের সামনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওইখানে আমার মামারা স্লোগান দিচ্ছিলেন ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নূরুল আমিনের কল্লা চাই।’ দাঁতের ব্যথার স্মৃতির সঙ্গে এই স্মৃতিটা এক হয়ে আছে।

ওই সময় গ্রামীণ জীবন কেমন ছিল?

মামুনুর রশীদ : তখন রাস্তাঘাট ছিল না। বর্ষায় গ্রাম প্লাবিত হতো। বাবার কর্মস্থল থেকে, নৌকায় করে আমরা ফুপুর বাড়ি, মামার বাড়ি যেতাম। আমার বাবার মামাবাড়ি থেকে একটা পানসি নৌকা আসত। সেটায় চড়ে বাবার মামাবাড়ি যেতাম। তখন মানুষ অনেক সরল ছিল। সবার সঙ্গে সম্পর্কও খুব আন্তরিক ছিল। মানুষ এখনকার মতো আতঙ্কে থাকত না। হয়তো দু’-তিন বছরে কালেভদ্রে কোথাও ডাকাতি হতো। অভাব, দারিদ্র্য ছিল। ১৯৫৪-৫৫ সালে দুর্ভিক্ষ হয়েছে। চালের অভাব হয়েছে, খাদ্য সংকট হয়েছে, কিন্তু মানুষ ছিল অকৃত্রিম। মানুষ মানুষের দুঃখে এগিয়ে আসত। কেউ মারা গেলে আশপাশের কয়েক গ্রামের মানুষ এসে মৃতের স্বজনদের সহানুভূতি জানাত। এখন যেরকম কথায় কথায় ডিভোর্স হয়ে যায়, এসব কিছুই ছিল না। তখন স্কুলের হেডমাস্টারের বেতন ছিল ৪০ টাকা। সেটাও তারা পেতেন কয়েক দফায়। অনেক ছাত্র বেতনও দিতে পারত না। দুজন শিক্ষক আমার জীবনে খুব রেখাপাত করেছেন। একজন হলেন দক্ষিণারঞ্জন আইচ। খেতে পেতেন না স্যার, তবু পড়াতেন। নিরলসভাবে পড়িয়ে যেতেন ছাত্রদের। কোনো একটা ছাত্র বুঝতে না পারলে তাকে বাড়িতে যেতে বলতেন। তাদের বিনামূল্যে প্রাইভেট পড়াতেন। আরেকটা স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন নিত্যানন্দ বাবু। তিনি টাঙ্গাইল শহর থেকে ছয় মাইল পথ প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে আসতেন। তার এমনই ডিসিপ্লিন ছিল, যখনই স্কুলের ওয়ার্নিং বেল বাজত, স্যারের সাইকেলের চাকাটা স্কুলের গেটে ঢুকত।

ওই সময়ের কোনো কষ্টদায়ক ঘটনা ….

মামুনুর রশীদ :তখন স্কুলে পড়ি। একদিন আমার খুব প্রিয় একজন হিন্দু বন্ধু স্কুলে এলো না। ওদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তারা ইন্ডিয়া চলে গেছে। আমার স্কুলের অনেক হিন্দু মেয়েও ওই সময় ইন্ডিয়া চলে যায়। দেশভাগের পর ১৯৪৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এ ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় আমি খুব কষ্ট পেতাম, কাঁদতাম। ছায়া দি, অশোকা দি, আমার ক্লাসমেট অনিমা চলে গেল… আমার খুব খারাপ লেগেছিল।

নাটকের প্রতি আগ্রহ কেন হলো?

মামুনুর রশীদকালিহাতীর এলেঙ্গা গ্রামে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যদের বাড়ি ছিল। ওটা ছিল জমিদার বাড়ি। ওই সময় জমিদার বাড়িতে কালীপূজা হতো। পূজায় নানা আয়োজন হতো। গান, যাত্রাগান, পালাগান, খেমটা নাচ থেকে শুরু করে রামলীলা, কথক ঠাকুরের মহাভারতের গল্প বলা সব মিলিয়ে বিশাল উৎসবের আয়োজন হতো। পাঁঠা, মহিষ বলি হতো। অনুষ্ঠানে হাজার হাজার মানুষের আসত। দুর্গাপূজার সময় থিয়েটার হতো গ্রামে। কর্ণ-অর্জুন, মহাভারতের গল্প এসব প্রাচীন নাটকগুলো মঞ্চায়ন হতো। পর্দা উঠে যাওয়া, মেকাপ করা এগুলো আমার কাছে বেশ মজা লাগত। সোহরাব-রুস্তমসহ নানা যাত্রা দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। এই যাত্রাপালায় বাবা যখন ছেলেকে হত্যা করে তখন সকাল হয়ে গেছে। আমি দেখলাম যে, সোহরাব মাটিতে পড়ে আছে। বাবার গগণবিদারী চিৎকার। কিছুক্ষণ পর দুজন সেই জায়গা থেকে চলে গেল। কিন্তু দর্শক আর উঠছে না…আমার কৌতূহল হলো ভিতরে ওরা কী করছে তা দেখার। ভেতরে গিয়ে দেখি দু’জনই বিড়ি টানছে। আমার তখন মনে হলো, একটু আগে যারা সোহরাব-রুস্তমের অভিনয় করেছিল তারা একেকজন বিশাল বীর। আমার মনে হলো, এদের সাংঘাতিক ক্ষমতা।  এরপর আমি যাত্রাপালা নিয়মিত দেখতাম। কল্পনার একটা জগতে তখন বিচরণ করতাম।

নাটক শুরু করলেন কবে থেকে?

মামুনুর রশীদ : ১৯৫৯ সালের কথা। স্কুলে পড়া অবস্থায় বিজয়সিংহ নাটকে প্রথম আমি এক রাজপুত্রের চরিত্রে অভিনয় করি। মায়ের শাড়ি দিয়ে মঞ্চ বানিয়েছিলাম তখন। কলেজ থেকেই থিয়েটার করি আমি। সেকেন্ড ইয়ার থেকে নাটক লেখা হয় আমার।

লেখাপড়া কোথায় করেছিলেন…

মামুনুর রশীদপলিটেকনিকে। আমি প্রথমে ভর্তি হই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, অল্পদিন পর ঢাকা কলেজে, তারপর পলিটেকনিকে।

ঢাকা এসেই কি নাট্যাঙ্গনের সঙ্গে পুরোপুরি জড়িয়ে গেলেন?

মামুনুর রশীদ : নাটক তো ভেতরে ছিলই। পলিটেকনিকে আমার শিক্ষক ছিলেন রাকিবউদ্দিন…শর্মিলী আহমেদের স্বামী। তিনি তখন বিধায়ক ভট্টাচার্যের সঙ্গে কাজ করেছেন, কলকাতায়। রামেন্দু দা’র বড় ভাই রণেন্দু স্যার, তিনিও পলিটেকনিকে শিক্ষক ছিলেন। তারা সবাই নাট্যানুরাগী ছিলেন। সেখানে আমি নবীনবরণ নিয়ে একটি নাটক লিখে ফেললাম। নাগরিক নাট্যাঙ্গনের আবুল কাশেম, তিনি তখন সেখানে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেন। তিনি পড়ে বললেন, ভালো হয়েছে। ওটা করার পর বেশ নাম হলো। এরপর শুরু হলো আমার নাটক লেখা আর অভিনয় করা। ’৬৪ সাল থেকেই এটা করতে লাগলাম। ’৬৫ সালে টাঙ্গাইলে মহাবিপ্লব নামে একটি মঞ্চ নাটকের নির্দেশনা দিলাম। তখন আমার বয়স মাত্র ১৭ বছর। এরপর কলেজে নাটক লেখা ও নির্দেশনা দিতে লাগলাম। এভাবেই শুরু হলো। পরে বিটিভে ’৬৭ সালে নাট্যকার হিসেবে কাজ শুরু করলাম। ওই সময় শহীদুল্লাহ কায়সারের সংসপ্তক নাটকের নাট্যরূপ দিলাম। এর সূত্র ধরে শহীদুল্লাহ কায়সার, আসকার ইবনে শাইখ, আবদুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হলো। সেই শুরু…এখনো লিখছি।

পরিবার থেকে কোনো সমস্যা হয়নি?

মামুনুর রশীদ : আমার বাবা একেবারেই চাইতেন না আমি নাটক করি। পাঁচ বোন, চার ভাইয়ের মধ্যে বড় আমি। বাবা আমাকে অনেক নিষেধ করলেন নাটক করার ব্যাপারে। আমি ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকায় চলে আসি। তারপর তো স্বাধীন।

৭১-এ কোথায় ছিলেন? সেই সময়কার কোনো স্মৃতি?

মামুনুর রশীদ : ২৫ মার্চ আমি ছিলাম গ্রিনরোডে রোজী সামাদের স্বামী সামাদ সাহেবের বাসায়। একটি চিত্রনাট্য লেখার কাজ করছিলাম। কাজ করতে করতে দেরি হওয়ায় ঠিক করলাম রাতটা থেকেই যাই। রাত ১১টার পর ট্যাঙ্ক নেমে পড়ল ঢাকার রাস্তায়। আর ট্রেসিং গান। হঠাৎ শোনা গেল গুলির শব্দ। ভয়ে আমরা দরজা-জানালা বন্ধ করে দিলাম। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম ট্যাঙ্ক, সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান যাচ্ছে। সারারাত গুলির শব্দ। এক সময় ফজরের আজান হলো। সেই আজানের মধ্যেও শুনতে পেলাম গুলির শব্দ। পরের দিনও সারাদিন গোলাগুলি, আগুন জ্বলছে এখানে-ওখানে। ২৭ মার্চ কিছুক্ষণের জন্য কারফিউ শিথিল করা হলো। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে টিএনটি অফিসের বিপরীত দিকে যে জায়গায় থাকতাম সেখানে গেলাম। সেখান থেকে নিউমার্কেটে ঢুকলাম। সেখানে কসাইদের গলাকাটা লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম। মানুষ আর গরুর রক্ত এক হয়ে গেছে। ইকবাল হল, জগন্নাথ হল সব জায়গায় শুধু মৃতদেহ। তারপর ঢাকা শহর ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ নদীর ওপারে যেতে শুরু করল। বুড়িগঙ্গার পারে বাদামতলীতে আমার এক বন্ধুর বাড়ি গেলাম। এরপর নদী পার হয়ে সুবুন্ডা গ্রামে গেলাম। তারপর এখানে-ওখানে পালিয়ে বেড়ালাম। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে ঢাকা ফিরে আসি। পরে টাঙ্গাইলে আমার মামাবাড়ি যাই। ওখানেই কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে পরিচয় হলো। কালীহাতিতে একটা যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধের পর আর্মিরা কিছু অস্ত্র ফেলে যায়। সেই অস্ত্রগুলো পালরা ওদের পুনে ঢুকিয়ে মাটি দিয়ে লেপে দিয়েছিল । তখন পালদের একজন এসে আমাকে খবর দিল যে, এগুলো দিয়ে কি করা যায়? আমি কাদের সিদ্দিকীকে খবর দিলাম। গ্রামবাসীদের নিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করে ওকে দিলাম। এরপর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে বেশ কিছুদিন ছিলাম। ছোটখাটো অপারেশনেও অংশ নিলাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম, আমাকে টানছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। পরে ঢাকায় এসে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা গেলাম। সেখান থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। ওখানেই ছিলাম দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কী কাজ করলেন?

মামুনুর রশীদ : আমি ’৭১-এর মার্চে আবার ‘আসিব ফিরে’ নামে একটি নাটক লিখেছিলাম বিটিভির জন্য। এটি ছিল পুলিশের গুলিতে নিহত ফারুক ইকবালকে নিয়ে। নাটকটি ভীষণ সাড়া জাগিয়েছিল বিটিভিতে। সেটির পা-ুলিপি আমার সঙ্গেই ছিল। প্রথমে আমি ওই নাটকটিই শুরু করি রেডিওতে।

আপনার দূর্লভ এই জন্মদিনটি পরিবারের সদস্যরা কিভাবে পালন করেন ?

মামুনুর রশীদ : পরিবার এখন আর আমার সংসারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। দীর্ঘদিনের কাজের সহকর্মী এবং আমার নাট্যদল আরণ্যক আমার বৃহৎ পরিবার। তারাই এখন ঘটা করে জন্মদিন পালন করে। সবাই মিলে মজা করে।

জন্মদিন উপলক্ষে যদি আপনাকে বর দেওয়া হয় ‘প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি’ পদের মধ্যে যে কোন একটিকে বেছে নিতে হবে। কোনটি নেবেন?

মামুনুর রশীদ : আমি প্রধানমন্ত্রীর পদটিই নেব। কারণ সমস্ত নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। আমার সমস্ত কর্মদক্ষতা দেখানোর সুযোগ সেখানে পাব।

প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পেলে সংবিধানের কোন আইন সংশোধন করবেন কিংবা সংযোজন করবেন?

মামুনুর রশীদ : আমি ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যেতে চাইব। আর পরিবর্তন করতে চাইব রাষ্ট্রধর্ম বিল। বাংলাদেশকে মানব ধর্ম প্রধান অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসাবে দেখতে চাই। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ যখন এই বিলটি পাশ করেন তখন অধ্যাপক আহমেদ শরীফ এই বিলটির বিরোধীতা করে তার নিজের সংগঠন ‘মুক্তচিন্তা’ থেকে একটি সভা আয়োজন করেছিল। আমি নিজেও এর বিরোধীতা করে সেখানে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেছিলাম।

জীবনের এতটা পথ পাড়ি দেওয়ার পর মানব মানবীর প্রেমকে কিভাবে দেখেন। প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে বেশি বয়স কি প্রতিবন্ধকতা?

মামুনুর রশীদ : প্রেম মানসিক আর শারীরিক এই দুইয়ের সমন্বয়ে তৈরি অনন্য এক অনুভূতি। প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে মোটেও বিবেচ্য নয়, কার প্রেমে পড়ছি কিংবা তার সাথে আমার বয়সের ব্যবধান কত। সময়ের সাথে শরীরের খোলসটা পরিবর্তন হয়ে যায় কিন্ত মনটা আজন্ম সজীব সেই কৈশোরেই আটকে থাকে।

প্রেমে পড়েছেন কয়বার?  প্রথম প্রেম সম্মন্ধে জানতে চাই?

মামুনুর রশীদ : কত যে প্রেমে পড়েছি তার কোন হিসাব নেই। এখনো তো প্রেমে পড়ে যাই। প্রথম প্রেমে পড়েছি ক্লাস নাইনে পড়ার সময়। সে আমার থেকে দু ক্লাস নিচে পড়ত। তার নাম বলব না। সেসময় ছিল চোখে চোখে প্রেম। একটু চাওয়া, একটু মুচকি হাসা এতেই শিহরিত হত মন। পড়ালেখার জন্য একসময় ঢাকায় চলে এলাম। তারপর থেকেই দুরত্ব বাড়তে লাগল। এভাবেই গোপনের প্রেম গোপনে চলে গেছে। আর যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। অনেকদিন আগে তার সাথে দেখা হয়েছিল তখন টের পেয়েছিলাম পুরনো আবেগ। এখনো মনে পড়ে প্রথম প্রেমের কথা।

এমন একজনের নাম বলেন যার সাথে ভীষন প্রেম করতে ইচ্ছা করত?

মামুনুর রশীদএই তালিকায় অনেকে আছে। সেসব নাম দিয়ে তালিকা করা যাবে। তবে একজনের নাম বলতে হলে বলব সোফিয়া লোরেনের নাম। ভীষন পছন্দের সে আমার।

মনে পড়লেই হাসি পায় এমন কোন ঘটনা আছে?

মামুনুর রশীদ : যৌবনের দিনগুলিতে কত যে অসম্ভব চিন্তা করতাম সেগুলি মনে পড়লেই হাসি পায়। যেমন জাতীয় দলের ক্রিকেটার হতে চাইতাম। আবার জেলা স্কুলের বিএসসি শিক্ষক হতে চাইতাম। আমাদের সময়ে বি.এ.সি শিক্ষকের খুব সম্মান ছিল। এখন ভাবলেই হাসি পায়।

চোখ বন্ধ করে কৈশোরে ফিরে গেলে সেসময়ের কোন অপ্রাপ্তি এখনো কষ্ট দেয়?

মামুনুর রশীদসেরকম কোন অপ্রাপ্তি আমার নাই। ছোটবেলায় ভীষনরকম স্নেহ মায়া মমতায় আমি মানুষ হয়েছি। যৌথ পরিবার ছিল আমাদের। খুব আদরের ছিলাম আমি। তবে গ্রামের স্কুলে পড়ার সময় খুব মনে হত যদি শহরের স্কুলে গিয়ে পড়তে পারতাম! কিন্তু এখন আমার মনে সেই ধারণাটা আর নেই। আমি আমার নিজের স্কুলকে খুব ভালবাসি এবং তাকে নিয়ে গর্ব করি।

দূর্লভ এই জন্মদিনে নিজের জন্য কি প্রত্যাশা করেন?

মামুনুর রশীদ : যেন ভাল ভাল নাটক লিখতে পারি, আরো পরিপক্ক অভিনয় করতে পারি, অনেক ভাল মানুষ হতে পারি – নিজের মধ্যে এই ক্ষমতাগুলো খুব করে প্রত্যাশা করি।

আপনাদের সম্পর্ক এখন ….

মামুনুর রশীদ : আমার স্ত্রীর নাম গওহর আরা চৌধুরী। গৃহবধূ সে। সে আছে আমার আনন্দ-বেদনার সঙ্গী হয়ে। কখনো সে আমাকে বোঝে, কখনো না। দুজনের মতবিরোধও হয়। এই সমস্যা কখনো ঠিক হয়। কখনো আবার রেললাইনের মতো সমান্তরালে চলে। তার মতো সে, আমার মতো আমি।

সন্তান…

মামুনুর রশীদ : দুই ছেলেমেয়ে আমার। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছেলে ডকুমেন্টরি নির্মাতা। তার একটা কোম্পানিও আছে বাংলা কমিউনিকেশন নামে।

আপনি তো একজন অভিনেতা, নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, সংগঠকও। কোন কাজটি আপনাকে বেশি আকৃষ্ট করে?

মামুনুর রশীদ : কাজগুলো সব একই ধরনের। সবই আমাকে টানে। কারণ যখন যেটা করেছি সিরিয়াসলি করার চেষ্টা করেছি।

আপনি কোন ধরনের দর্শনে বিশ্বাসী?

মামুনুর রশীদ : আমি মার্কসবাদে বিশ্বাসী।

আপনি তো বইও লেখেন। এ পর্যন্ত কতটি বই প্রকাশিত হয়েছে?

মামুনুর রশীদ : উপন্যাস লিখেছি চারটি। আর আমি কলাম লিখি প্রথম আলোতে জীবনের সার্কেল শিরোনামে। কলামগুলো নিয়েও একটি বই বেরিয়েছে।

দেশের বর্তমান অবস্থায় আপনার ভাবনা কী?

মামুনুর রশীদ : এটা বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সৃষ্ট এ দেশের জাতি উগ্রপন্থাকে পছন্দ করে না। নকশাল, উগ্রবাদ, জামায়াতে ইসলামীর আগুন সন্ত্রাস কেউ পছন্দ করেনি। এগুলোর আস্তে আস্তে একটা প্রাকৃতিক মৃত্যু হয়। তবে এর মাঝখানে কতগুলো প্রাণ ঝরে যায়। আমার মনে হয় না, এ ধরনের জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে কোনো সুদূরপ্রসারী জায়গা নেবে।

তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আপনার কোনো মেসেজ আছে কী?

মামুনুর রশীদ : আমাদের এখন একটা চর্চাহীন সমাজ গড়ে উঠেছে। আমি তরুণদের বলতে চাই, যে কাজটি কর না কেন তা গভীর অনুভূতির সঙ্গে কর। যে লিখছ সে লেখার চর্চা কর,অভিনয় করলে তার চর্চা কর। অনুশীলন কর।

(বাংলানিউজ

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।