শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৬:৩৮ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
ভারতীয় সাংবাদিক সানাকে পুলিৎজার পুরস্কার নিতে যুক্তরাজ্যে যেতে বাধা ,‘আমি একজন পেশাদার সাংবাদিক, এজন্য আমাকে শাস্তি দিতে পারেন না’

নিউজ ডেক্স : আমি একজন পেশাদার সাংবাদিক, আমি সত্য রিপোর্ট করছি এবং আপনি এর জন্য আমাকে শাস্তি দিতে পারেন না। কথাগুলো বলছেন পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী কাশ্মিরী ফটোসাংবাদিক সানা ইরশাদ মাট্টু। তাকে বিদেশ যেতে আবারও বাধা দেওয়া হয়েছে।একের পর এক টুইটে সানা ইরশাদ দাবি করেছেন, সোমবার তিনি পুলিৎজার পুরস্কার নিতে নিউ ইয়র্কে যাচ্ছিলেন, কিন্তু দিল্লি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা তাকে আটকে দেন।

তার দাবি মার্কিন ভিসা ও টিকিট থাকা সত্ত্বেও তাকে ভ্রমণ করতে দেওয়া হয়নি। সানা ইরশাদ বলেন, এ নিয়ে দ্বিতীয়বার বিনা কারণে আমাকে ভ্রমণে বাধা দেওয়া হলো। কয়েক মাস আগে যা ঘটেছিল তা নিয়ে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা সত্ত্বেও আমি কোনো জবাব পাইনি। এই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় মুহূর্ত হতে পারতো। সানার এই দাবির বিষয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া না জানানো হলেও জম্মু-কাশ্মির পুলিশের কর্মকর্তারা সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন, নো-ফ্লাই লিস্টে তার নাম রয়েছে, যার জন্য তাকে বিদেশ যেতে দেওয়া হয়নি।

সানা বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ফটো সাংবাদিক। ভারতে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ছবি তুলে চলতি বছর পুলিৎজার পেয়েছেন তিনি। ৯ এপ্রিল পুলিৎজার জয়ী হিসাবে তার নাম ঘোষণা করা হয়। সেই পুরস্কার গ্রহণ করতেই নিউ ইয়র্ক যাচ্ছিলেন তিনি। শ্রীনগরের বাসিন্দা সানা ইরশাদ ২০১৮ সাল থেকে জম্মু ও কাশ্মিরে ফটোগ্রাফি করছেন। সানা ইরশাদ মাট্টু বলেন, আমাকে কেন থামানো হচ্ছে তার কোনো কারণ আমাকে জানানো হয়নি। আমাকে বলা হয়েছে যে আমি বিদেশ ভ্রমণ করতে পারব না।

পুরস্কার গ্রহণের সম্মান থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটা পুলিৎজার সম্মান ছিল। এটা প্রত্যেক সাংবাদিকেরই স্বপ্ন। আপনি যখন এই সম্মানের জন্য নির্বাচিত হন, তখন এর সাথে যুক্ত প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা এখন আমার কাছ থেকে এই সুখ কেড়ে নিয়েছে। তারা কেন আমাকে বিদেশে যেতে বাধা দিচ্ছে তা বলে না… সত্যি বলতে কী, আমার মনটা ভেঙে গেছে।

চলতি বছরের জুলাই মাসে প্রথম সানাকে বিদেশ যেতে বাধা দেওয়া হয়। একটি বই প্রকাশ এবং ফটোগ্রাফি প্রদর্শনীর জন্য তার দিল্লি থেকে প্যারিসে যাওয়ার কথা ছিল। তখনও তিনি বলেছিলেন যে তার কাছে ভিসা রয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ তাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। সানা সেই সময় টুইটারে লিখেছিলেন, আমি দিল্লি থেকে প্যারিস যাচ্ছিলাম বই প্রকাশ ও ছবি প্রদর্শনীর জন্য। আমাকে সেরেনডিপিটি আর্লস গ্রান্ট ২০২০-এর ১০ জন পুরস্কারপ্রাপ্তের মধ্যে একজন হিসাবে যেতে বলা হয়েছিল। তিনি বলেন, ফ্রান্স থেকে ভিসা পাওয়া সত্ত্বেও আমাকে দিল্লি বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ডেস্কে আটকে দেওয়া হয়। আমাকে এর জন্য কোনো কারণ জানানো হয়নি, কেবল বলা হয় যে আপনি আন্তর্জাতিক ভ্রমণ করতে পারবেন না।

২০১৯ সালের আগস্টে জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল হওয়ার পর থেকেই সেখানে কর্মরত সাংবাদিকদের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এই মুহূর্তে জম্মু ও কাশ্মিরের জেলে বন্দি রয়েছেন তিন কাশ্মিরী সাংবাদিক। জননিরাপত্তা আইনের মতো কঠোর আইনে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে লুকআউট সার্কুলার জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ নো-ফ্লাই লিস্টেও তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত চারজন কাশ্মিরী সাংবাদিককে বিদেশে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছে।

২৫ বছর বয়সী ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক আকাশ হাসানকে চলতি বছরের জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে বাধা দেওয়া হয়। আকাশ জানান, তিনি কলম্বো যাচ্ছিলেন শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে রিপোর্ট করতে। আকাশ তখন টুইটারে লিখেছিলেন, আমাকে পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়, ওই সময়ে আমাকে এক কাপ চা বা পানি কিচ্ছু দেওয়া হয়নি। পরে আমার পাসপোর্ট এবং বোর্ডিং পাসে প্রত্যাখ্যানের লাল সিল দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।তিনি বলেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করানোর পর আমাকে বলা হয় যে আমাকে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমাকে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ জানানো হয়নি, তবে বিমান সংস্থার কর্মীরা আমাকে বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে লুকআউট নোটিশ জারি করা হয়েছে। আমি যখন কাশ্মিরে ফিরে আসি, তখন আমি কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি যে কী কারণে এই নোটিশ জারি করা হয়েছে।

গত মার্চে মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্টের জন্য লেখা সাংবাদিক রানা আইয়ুবকে মুম্বাই বিমানবন্দর থেকে বিদেশ যেতে দেওয়া হয়নি। সে সময় তিনি ব্রিটেনে যাচ্ছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্টসের একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে যাওয়ার কথা ছিল তার। রানা আইয়ুবকে কিছুদিন পর বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলেও এর জন্য তাকে দিল্লি হাইকোর্টের দরজায় কড়া নাড়তে হয়। আদালতের লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার পরেই তিনি এই ভ্রমণের অনুমতি পেয়েছিলেন।

অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার প্রাক্তন প্রধান আকার প্যাটেলকে গত এপ্রিলে বেঙ্গালুরু বিমানবন্দরে দু’বার আমেরিকা যেতে বাধা দেওয়া হয়। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, আকার প্যাটেলের আমলে অ্যামনেস্টি ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে বৈদেশিক মুদ্রা আইনের বিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো আকার প্যাটেলকে ‘ঝুঁকি’ হিসাবে অভিহিত করেছে। পরে আদালত তাদের জানায়, অনুমতি ছাড়া তিনি দেশ ছাড়তে পারবেন না।

গত আগস্টে এমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক অঙ্গদ সিং দিল্লি পৌঁছনো মাত্রই তাকে ফের নিউ ইয়র্কে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কিছু না বললেও, অঙ্গদ সিং-এর পরিবারের অভিযোগ ওই সময় তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছিল। অঙ্গদ সিংয়ের মা অভিযোগ করেছিলেন যে তার তৈরি তথ্যচিত্রের কারণে তার সাথে এটা করা হয়েছিল। অঙ্গদ সিং ভাইস নিউজের জন্য ভারতের করোনা সংকট এবং কৃষকদের ওপর এই তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন।

সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ফিলিপো ওসেলাকে চলতি বছরের শুরুর দিকে ভারতের একটি বিমানবনন্দর থেকেই আবার লন্ডন ফেরত পাঠানো হয়। গত ৩০ বছর ধরে তিনি ভারতে যাওয়া-আসা করছিলেন। অধ্যাপক ফিলিপো ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তকে পক্ষপাতদুষ্ট ও অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করে দিল্লি হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন যে সরকারি কর্মকর্তারা তার সাথে অপরাধীর মতো আচরণ করেছিলেন এবং তাকে কেন ঢুকতে দেওয়া হবে না তার কোনো কারণ দেননি। গত সপ্তাহে তার মামলার শুনানিতে কেন্দ্রীয় সরকার আদালতে জানায়, তার বিরুদ্ধে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে এবং তার ভিত্তিতেই তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

জম্মু-কাশ্মিরের ডিরেক্টর জেনারেল অব পুলিশ দিলবাগ সিং চলতি বছরের আগস্টে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, কোনো সাংবাদিক যাতে বাইরে গিয়ে ‘বিষাক্ত চিন্তা’ ছড়াতে না পারেন, তার জন্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবেই তাদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দিলবাগ সিং দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছিলেন, কিছু সাংবাদিক আছেন যারা বিদেশে গিয়ে ‘বিষাক্ত চিন্তা’ ছড়াতে শুরু করেছিলেন। মিডিয়ার সুপরিচিত কয়েকজনও আছেন। তাদের মধ্যে কারও কারও নাম এখানেও আছে। তাদের অবস্থান মাঝামাঝি, তারা অন্য দিকেও নয় এবং জনগণের পক্ষেও নয়। তাই আমরা সতর্কতা হিসেবে এ ধরনের মানুষের ওপর নজর রাখছি। তিনি আরও বলেন, তাদের নজরদারির তালিকায় রাখার অর্থ হলো তাদের বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া উচিত নয়, তাই আমি মনে করি এটি একেবারেই যুক্তিসঙ্গত। এর আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আমরা এটা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারি না।

যে কাশ্মিরী সাংবাদিকদের বিদেশ যেতে দেওয়া হয়নি, তাদের কেউই আদালতে চ্যালেঞ্জ করেননি। তাদের আশঙ্কা, এমনটা করলে তারা সরকারের রোষের মুখে পড়তে পারেন। আকাশ হাসান বলেন, আদালতের কাছ থেকে তার কোনো প্রত্যাশা নেই। তিনি বলেন, আমরা অতীতে দেখেছি যে, আদালত বিচারের ক্ষেত্রে কাশ্মীরি সাংবাদিকদের হতাশ করেছে। যখন তিনজন সাংবাদিক কারাগারে আছেন এবং আদালত থেকে জামিন পাচ্ছেন না, জননিরাপত্তা আইনের মতো কঠোর আইনের অধীনে তাদের কারাগারে রাখা হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে আমি আদালতের কাছ থেকে কোনো আশা দেখছি না।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।