শনিবার, ২৭ Jul ২০২৪, ১২:৪৮ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
শিকদার গ্রুপের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা, প্রতিবাদ, ন্যাশনাল ব্যাংকের লালবাতি, অবশেষে ব্যাংকটি শিকদার গ্র্রুপমুক্ত, খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা

স্টাফ রিপোর্টার : ন্যাশনাল ব্যাংকের লালবাতি, খেলাপি ্ঋণের ভারে নূব্জ, যদিও বেসিক ব্যাংকের সাথে এখনই একীভুত হচ্ছে না ব্যাংকটি, দীর্ঘমেয়াদি ঝুকিতে ব্যাংকটি। একরাতেই ব্যাংক থেকে তোলে নেয়া হয়েছে ২৩ কোটি টাকা। এ নিয়ে প্রথম আলোতে ধারাবাহিক প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। অবশেষে ব্যাংকটি শিকদার গ্রুপমুক্ত করা হয়েছে।শিকদার গ্রুপের পারিবারিক পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। একটি ব্যাংকের এমডিকে হত্যার হুমকি, সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা, গ্রেফতার এড়াতে করোনার সময়ে নিজস্ব বিমানে করে বিদেশে পাড়ি দেয়া সেই রন হক শিকদারের কর্তৃত্ব আর ন্যাশনাল ব্যাংকে নেই। জয়নুল হক শিকদার মারা যাবার তার স্ত্রী, কণ্যা, দুই ছেলে -কেউ আর এখন ন্যাশনাল ব্যাংকের সাথে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক পুরনো পর্ষদ ভেঙে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে। অবশেষে শিকদার গ্রুপের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করেছে।
ন্যাশনাল ব্যাংক, শিকদার গ্রুপ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টিং নিয়ে শিকদার গ্রুপ প্রতিবাদ করেছে। অর্থনীতির কাগজে তা পর পর প্রকাশিত হয়েছে।একুশে বার্তার পাঠকদের জন্য প্রতিবাদটি তুলে ধরা হলো: পাশাপাশি প্রথম আলোর প্রকাশিত প্রতিবেদটিও তুলে ধরা হলো:

 

দুদকের দায়ের করা মামলা নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ সম্পর্কে সিকদার গ্রুপের বক্তব্য

গত ৩১ মার্চ ২০২৪ খ্রি: দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক সিকদার গ্রুপের পরিচালক রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার এর বিরুদ্ধে দ্বায়েরকৃত ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারের মামলা সম্পর্কে সিকদার গ্রুপের বক্তব্য।

দীর্ঘদিন যাবৎ লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, দেশের স্বনামধন্য বৃহৎ শিল্প ও বানিজ্য গোষ্ঠি সিকদার গ্রুপের বিরুদ্ধে একটি স্বার্থান্বেষী মহল ষড়যন্ত্রেলিপ্ত। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর জনাব জয়নুল হক সিকদার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ গ্রুপের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়িয়ে তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি করার হীন চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা ন্যাশনাল ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারের একটি ভিত্তিহীন বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে।

অথচ সিকদার গ্রুপের পরিচালকদ্বয় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বিদেশে ১২.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী খরচকৃত অর্থ পরিশোধ সাপেক্ষে সুদ ও অন্যান্য চার্জ বাবদ অতিরিক্ত আরো ২.১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছেন। এর মাধ্যমে বিষয়টি সেখানেই চুড়ান্তভাবে নিস্পত্তি হয়ে গেছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার বাবদ ব্যাংকের সকল পাওনা সিকদার গ্রুপের বৈদেশিক ব্যবসায়িক আয় হতে পরিশোধ হওয়ায় এক্ষেত্রে অর্থপাচারের অভিযোগ সর্ম্পূন ভিত্তিহীন।

সিকদার গ্রুপ দীর্ঘদিন সুনামের সাথে দেশে-বিদেশে ব্যবসা করে আসছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে রয়েছে সিকদার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জয়নুল হক সিকদারের অসামান্য অবদান। সিকদার গ্রুপের মাধ্যমেই এদেশে গড়ে উঠেছে প্রথম মহিলা মেডিকেল কলেজ। জনাব জয়নুল হক সিকদার প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ মাদ্রাসা। হোটেল-টুরিজম, পোর্ট, পাওয়ার প্ল্যান্ট সহ বড় বড় অবকাঠামো নির্মানেও রয়েছে সিকদার গ্রুপের বিশাল ভূমিকা। সিকদার গ্রুপ ঢাকার পূর্বাচলে দক্ষিন এশিয়ার সু-উচ্চ ১১১তলা বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু ট্রাই টাওয়ার, যা পৃথিবীর পঞ্চম সু-উচ্চ ভবন, নির্মান করছে। আর এই কারণে সিকদার গ্রুপ কতিপয় স্বার্থন্বেষী মহলের টার্গেটে পরিনত হয়েছে। সিকদার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জনাব জয়নুল হক সিকদারের ইন্তেকালের পর এই ষড়যন্ত্রকারীরা আরো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পিতার মৃত্যুর পর তার দুই সুযোগ্য সন্তান জনাব রিক হক সিকদার ও জনাব রন হক সিকদার যখন গ্রুপটিকে আরো ব্যাপক উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক সেই মুহুর্তে এই গ্রুপের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্থ করতে ঐ স্বার্থান্বেষী মহল নানাভাবে অপচেষ্টা ও ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের কয়েকটি বৃহৎ প্রকল্পে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য সিকদার গ্রুপ যখন ব্যপকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই এই ষড়যন্ত্রকারীরা সেগুলো ব্যাহত করার লক্ষ্যে সিকদার গ্রুপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে উদ্দেশ্যপূর্নভাবে সংবাদ পত্রের মাধমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজে লিপ্ত হয়েছে।

সিকদার গ্রুপ এসকল ষড়যন্ত্রকারীর মিথ্যা প্রচারনায় বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।

 

প্রকাশিত সংবাদে বিভ্রান্তি দূর করার জন্য সিকদার গ্রুপের ব্যাখ্যা

ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনের ঘটনা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে সিকদার গ্রুপ ও সিকদার পরিবার নিয়ে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ও অনুমান নির্ভর অসত্য তথ্য পরিবেশিত হচ্ছে। এ নিয়ে সিকদার গ্রুপ সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। জনমনে বিভ্রান্তি দূর করার জন্য বিষয়গুলো নিয়ে আজ শনিবার (১১ মে) কোম্পানি সেক্রেটারি মাহফুজুর রহমান সাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে ব্যাখ্যা প্রদান করছে সিকদার গ্রুপ।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সিকদার গ্রুপ বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধের অন্যতম সংগঠক মরহুম জয়নুল হক সিকদারের ছয় দশকেরও অধিক পরিচালিত ঐতিহ্যবাহি একটি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সিকদার গ্রুপের অনেক অবদান রয়েছে। কতিপয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে সব অভিযোগ ও তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অবান্তর। কোন বৈধ সংস্থার রেফারেন্স ছাড়াই তা উল্লেখ করা হয়েছে। সিকদার গ্রুপ এ ধরনের মনগড়া, ভুল ও উদ্দেশ্যমুলক এবং প্ররোচনা সৃষ্টিকারী সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
সিকদার সিকদার পরিবার ন্যাশনাল ব্যাংকের সকল শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে বলে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তা সম্পূর্ণ অসত্য। আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই যে, সিকদার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের একটি শেয়ারও কারো কাছে বিক্রি বা হস্তান্তর করা হয়নি এবং ভবিষ্যতেও এধরনের শেয়ার হস্তান্তরের কোন পরিকল্পনাও নেই। আমরা আমাদের গ্রাহক ও শুভাকাঙ্খিদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, সিকদার গ্রুপ তাদের কোন কোম্পানীর কোন মালিকানা বা সম্পত্তি কারো কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে অন্য কোন গ্রুপের সাথে কোন ধরনের আলোচনাও করেনি।
একটি কুচক্রিমহল দীর্ঘদিন যাবৎ মরহুম জয়নুল হক সিকদারের দুই কনিষ্ঠ পুত্র রিক হক সিকদার এবং রন হক সিকদারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে একটি গোষ্ঠির স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা দেশের চলমান উন্নয়ন ধারাকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। প্রকাশিত সংবাদগুলোতেও ঢালাওভাবে নানা অভিযোগ করা হয়েছে এবং ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, যার কোন সঠিক তথ্য ও প্রমাণ উপস্থান করা হয়নি। পঞ্চাশ উর্ধ্ব রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদারের হাতে-খড়ি তাদের শ্রদ্ধেয় পিতা জয়নুল হক সিকদারের মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া শেষে তারা আরাম-আয়েশের জীবন কাটাতে পারতেন। তা না করে তারা দেশে এসে তাদের পিতার সাথে হাটে-মাঠে-ঘাটে ঘুরে গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে ব্যবসা বাণিজ্য শিখেছেন। আজ তার পিতার অবর্তমানে তারা যখন ব্যবসায়ীক গ্রুপটির হাল ধরেছেন, ঠিক তখনি কুচক্রীমহলটি তাদের হীন স্বার্থ চারিতার্থ করার উদ্দেশ্যে নানা অপপ্রচার শুরু করেছে।
তাদের ষড়যন্ত্রের একটি নমুনা উল্লেখ করতে চাই। একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জয়নুল হক সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল এর শেয়ার বা মালিকানা হস্তান্তর করা হয়েছে। এই তথ্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মরহুম জয়নুল হক সিকদারের প্রাণের এই প্রতিষ্ঠান দেশের প্রথম মহিলা মেডিকেল কলেজ যা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ দেশে বিভিন্ন দুর্যোগে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের মাধমে বিশাল অবদান রেখে এসেছে। এটি দেশের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারির একটি আধুনিক হাসপাতাল হিসেবে সুপরিচিত। কাজেই সিকদার মেডিকেল কলেজর মালিকানা হস্তান্তর করার প্রশ্নই আসে না।

 

 

মিলেমিশে শেষ করা হলো ন্যাশনাল ব্যাংককে :

২০০৯ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সিকদার পরিবারের হাতে। শুরু হয় অনিয়ম, ব্যাংক ছাড়েন ভালো উদ্যোক্তারা।

বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে বড় পরিবর্তন হয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই। ওই বছরে ব্যাংকটির কর্তৃত্ব চলে যায় সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের কাছে। নিজের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজন ও দলীয় নেতাদের পর্ষদে যুক্ত করে ব্যাংকটির একক নিয়ন্ত্রণ নেয় সিকদার পরিবার। শুরু হয় অনিয়ম, ব্যাংক ছাড়েন ভালো উদ্যোক্তারা। এর আগপর্যন্ত এটির পরিচিতি ছিল একটি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক হিসেবে।

সিকদার পরিবারের হাতে ন্যাশনাল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ যাওয়ার পর পরিচালনা পর্ষদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও বেনামি ঋণের নানা ঘটনা বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে। পর্ষদে পটপরিবর্তনের প্রায় ৬ বছর পর ২০১৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। কারণ, সিকদার পরিবার ও তাদের পক্ষে যেসব সংস্থা প্রভাব বিস্তার করে আসছিল, একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাও তাতে সুর মেলায়। ফলে আরও খারাপ হয় ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিস্থিতি।

এমন প্রতিষ্ঠান খারাপ করার জন্য যে ধরনের কর্মকাণ্ড করা প্রয়োজন, তার সবই এই ব্যাংকে ছিল। ফলে ব্যাংকটি খারাপ হয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক ছিল।

মোহাম্মদ নূরুল আমিন, সাবেক চেয়ারম্যান, এবিবি

২০০৯ সালে যে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি টাকার কম, এখন তা বেড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে পাঁচটি ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তাদের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। সর্বশেষ হিসাবে, ন্যাশনাল ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ২৯ শতাংশই খেলাপি। গত দুই বছরে তাদের নিট লোকসান ৪ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে গত তিন বছর যাবৎ বড় অঙ্কের ঋণ প্রদান বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 

দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোর একটি এখন ন্যাশনাল ব্যাংক। ব্যাংকটিকে বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সঙ্গে একীভূত করার পরামর্শ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ন্যাশনাল ব্যাংক তাতে সায় দেয়নি। হঠাৎ করে গত রোববার এর পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটিকে সম্পূর্ণভাবে সিকদার পরিবারমুক্ত করা হয়েছে। নতুন পর্ষদে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের বেশির ভাগ চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি। ফলে ব্যাংকটির মালিকানা নতুন করে কার হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

মিলেমিশে ব্যাংকটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময় এতে নীতি সহায়তা দিয়েছে। ফলে বড় এই ব্যাংকের পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়েছে।

ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের অভিযোগ, সিকদার পরিবার নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংকটিকে শেষ করেছে। একইভাবে সরকারঘনিষ্ঠ বড় কিছু ব্যবসায়ী বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়া, সুদ মওকুফ করানো ও টাকা পাচারের জন্য ন্যাশনাল ব্যাংককে বেছে নিয়েছেন। তাঁরা প্রভাব খাটিয়ে নানা রকম সুবিধা নিয়েছেন। এভাবে মিলেমিশে ব্যাংকটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময় এতে নীতি সহায়তা দিয়েছে। ফলে বড় এই ব্যাংকের পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়েছে।

ওই কর্মকর্তারা জানান, তারল্য-সংকটের কারণে মাঝেমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক। ফলে জরিমানাও গুনছে ব্যাংকটি।

 

ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে প্রায় দুই বছর দায়িত্ব পালন শেষে গত ডিসেম্বরে অবসরে গেছেন মেহমুদ হোসেন। ব্যাংকের এই পরিণতি সম্পর্কে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এমন সুদ মওকুফ করা হয়েছে, যার মুনাফার ওপর সরকারকে আগেই কর দেওয়া হয়েছে। আবার যার চাহিদা ছিল ২০ কোটি টাকার ঋণ, তাকে দেওয়া হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। এসব অর্থ কোনো উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হয়নি। উচ্চ সুদে আমানত এনে কম সুদে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এসব ঋণের টাকা ফেরত আসেনি কিন্তু ঠিকই উঁচু হারে সুদ ও আমানতের অর্থ ফেরত দিতে হয়েছে গ্রাহককে। এতে তারল্য-সংকট হয়েছে, জরিমানা গুনতে হয়েছে। যা সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে।

মেহমুদ হোসেন আরও বলেন, ন্যাশনাল ব্যাংককে ঘুরে দাঁড়াতে হলে দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ ও চৌকস ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন, যারা কোনো গোপন অ্যাজেন্ডা ছাড়া ব্যাংকের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংককে নীতি ও তারল্য সহায়তা দিতে হবে। সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানও ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলে নিয়ে গেছে। এসব টাকা ব্যাংকে ফেরাতে হবে। বড় ঋণ বন্ধ আছে, এটি বহাল রাখতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংকটিকে ভালো করা কঠিন।

বিভিন্ন নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, শুধু দেশে নয়, বিদেশেও গ্রুপের ব্যবসা বিস্তৃত হয়েছে। অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডসহ আরও কিছু দেশে।

যেভাবে খারাপ হলো ব্যাংকটি : বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর একটি ন্যাশনাল ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে কার্যক্রম শুরু করা এ ব্যাংকের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য ও সাবেক অর্থমন্ত্রী আজিজুর রহমান মল্লিক। ব্যাংকটিতে তাঁর কোনো শেয়ার না থাকার পরও উদ্যোক্তারা তাঁকে শুরুতে ১০ বছর চেয়ারম্যান পদে রেখেছিলেন। এরপর শেয়ারধারীরা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। তখনো ভালো ব্যাংক হিসেবেই ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচিতি ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি পরির্বতিত হয় ২০০৯ সালে।

ওই বছর ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন জয়নুল হক সিকদার। এরপর অন্য উদ্যোক্তারা ব্যাংকটি ছাড়তে একরকম ‘বাধ্য’ হন বলে অভিযোগ রয়েছে। খারাপ হতে শুরু করে ব্যাংকটির অবস্থা। কিন্তু ওই সময় থেকেই ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে সিকদার পরিবারের সম্পদ। ব্যাংক ছাড়াও বিমা, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, নির্মাণ, হোটেল, পর্যটন, এভিয়েশনসহ বিভিন্ন খাতে গ্রুপটির ব্যবসা বিস্তৃত করে। বিভিন্ন নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, শুধু দেশে নয়, বিদেশেও গ্রুপের ব্যবসা বিস্তৃত হয়েছে। অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডসহ আরও কিছু দেশে।

জগন্নাথ কলেজে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতাকে ব্যাংক দেওয়া হয়েছিল। তাঁর ছেলে জনসমক্ষে একটি ব্যাংকের এমডিকে গুলি করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তারা কত টাকা যে বিদেশে নিয়ে গেছে, তার হিসাব নেই। এই ব্যাংক একীভূত করে, না আলাদা রেখে শায়েস্তা করা হবে, এটা সিদ্ধান্তের বিষয়। একীভূত করা ভালো সিদ্ধান্ত, তবে এটা নতুন করে সংকট তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের অনেকগুলোই সিকদার পরিবার ও তাদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হচ্ছে। আবার বেনামি ঋণ সৃষ্টি করেও পরিবারটি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে।’ জানা গেছে, এসব টাকা আর ব্যাংকে ফেরত আসছে না। পাশাপাশি ব্যাংকটি এমন অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে, যেসব ঋণের আদায় নেই বললেই চলে। তারপরও এসব ঋণ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে না।

ব্যাংকের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৩৮৮ কোটি টাকা, গত ডিসেম্বরে যা বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ৪২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা।

সিকদার পরিবারের দিকে ইঙ্গিত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বৃহস্পতিবার এক বক্তৃতায় বলেন, ‘জগন্নাথ কলেজে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতাকে ব্যাংক দেওয়া হয়েছিল। তাঁর ছেলে জনসমক্ষে একটি ব্যাংকের এমডিকে গুলি করে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তারা কত টাকা যে বিদেশে নিয়ে গেছে, তার হিসাব নেই। এই ব্যাংক একীভূত করে, না আলাদা রেখে শায়েস্তা করা হবে, এটা সিদ্ধান্তের বিষয়। একীভূত করা ভালো সিদ্ধান্ত, তবে এটা নতুন করে সংকট তৈরি করতে পারে।’

এমন প্রতিষ্ঠান খারাপ করার জন্য যে ধরনের কর্মকাণ্ড করা প্রয়োজন, তার সবই এই ব্যাংকে ছিল। ফলে ব্যাংকটি খারাপ হয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক ছিল।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন

সুদ মওকুফের পর বড় লোকসানে : সংকটে থাকার পরও ২০২১ সালে ৭ গ্রাহকের ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে ন্যাশনাল ব্যাংক। বিভিন্ন শর্ত দিয়ে এক দিনেই বড় অঙ্কের সুদ মওকুফ করার বিষয়ে অনাপত্তি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব সুদ আগের ১০ বছরে আরোপ করা হয়েছিল। সাতটি প্রতিষ্ঠানই চট্টগ্রামের। ন্যাশনাল ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার গুলশান শাখা ২০০৩ সাল থেকে বিভিন্ন সময় এই সাত প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের বিভিন্ন নথি বিশ্লেষণে দেখা যায়, যেসব সুদ মওকুফ করা হয়, তা আরোপ করা হয়েছিল ২০১০ সাল থেকে। এই সুদ ন্যাশনাল ব্যাংক প্রতিবছর আয় হিসেবে দেখিয়েছে। আয়ের বিপরীতে মুনাফা থেকে ব্যাংকটি সরকারকে কর দিয়েছে, আবার শেয়ারধারীদের লভ্যাংশও বিতরণ করেছে। এরপর এসব সুদ মওকুফ করা হয়। এখন প্রতিবছরের আয় থেকে এই সুদ মওকুফ বাবদ অর্থ বাদ দিতে হবে।

কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকটি দুই বছর ধরে লোকসানে পড়ার এটাও অন্যতম কারণ। ২০২২ সালে ব্যাংকটির লোকসান হয় ৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা, আর ২০২৩ সালে লোকসান দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। এর আগপর্যন্ত কমবেশি মুনাফা করেছে ব্যাংকটি। ২০১৮ সালে ব্যাংকটি ৪১০ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে ৪১৬ কোটি টাকা, ২০২০ সালে ৩৪৮ কোটি টাকা ও ২০২১ সালে ১৯ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল।

 

বড় গ্রাহক বড় খেলাপি যারা : ব্যাংকটির গত ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, বিতরণ করা ৪২ হাজার কোটি টাকা ঋণের অর্ধেকই ২০টি গ্রুপের কাছে সীমাবদ্ধ। তারাই ব্যাংকটির একরকম নিয়ন্ত্রক। এর মধ্যে কেউ কেউ খেলাপি হয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে ভালো গ্রাহকের তালিকায় রয়েছেন। আর এই সুযোগে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হকের মাইশা গ্রুপের ঋণ স্থিতি ২ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা, যার ওপর আদালতের স্থগিতাদেশ আছে।

এ ছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণের স্থিতি ৩ হাজার ৬১২ কোটি টাকা; বেক্সিমকো এলপিজি ও বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ স্থিতি ২ হাজার ১১৭ কোটি টাকা; চট্টগ্রামের মো. ইয়াসীন চৌধুরীর এফএমসি গ্রুপের ঋণ ১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা; সাইফ পোর্ট হোল্ডিং ও সাইফ পাওয়ারটেকের ঋণ ১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা; ফুওয়াং ফুড ও এসএস স্টিলের ঋণ ৬৯৮ কোটি টাকা; কর্ণফুলী গ্রুপের ঋণ ৬৭৫ কোটি টাকা।

অন্যদিকে ব্যাংকটির খেলাপি গ্রাহকদের তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, শীর্ষ ২০ খেলাপি গ্রাহকের কাছে আটকা পড়েছে ৮ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্লুম সাকসেস ইন্টারন্যাশনালের খেলাপি ঋণ ৮৩৬ কোটি টাকা, ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটের ৬৬৮ কোটি টাকা, নুরজাহান গ্রুপের ৫৯৬ কোটি টাকা, ডাইকিং স্মার্ট ব্যাটারির ৫৩১ কোটি টাকা ও এহসান গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৬১৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া মিলেনিয়াম গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৫৪৭ কোটি টাকা, ওপেক্স সিনহা গ্রুপের ৫৩১ কোটি টাকা, মরিয়ম কনস্ট্রাকশনের ৪৭৯ কোটি টাকা, আরএসএ ক্যাপিটালের ৪৩১ কোটি টাকা, কেয়া কসমেটিকের ৩৭৬ কোটি টাকা, ইনডিপেনডেন্ট টিভির ৩৩৩ কোটি টাকা ও জিএমজি এয়ারলাইনসের ২৩৮ কোটি টাকা।

ন্যাশনাল ব্যাংকের যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে ক্ষুব্ধ সাবেক ব্যাংকাররাও। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবার চোখের সামনে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস করা হলো, কেউ কিছু করল না। ব্যাংকটিতে নিয়ম না মেনে নির্দেশিত ঋণ দেওয়া হয়েছে, অন্য সব সিদ্ধান্তও হয়েছে পর্ষদের নির্দেশে। আইনকানুন মানার কোনো বালাই ছিল না। সুশাসনের প্রচণ্ড রকম ঘাটতি ছিল ব্যাংকটিতে।’

মোহাম্মদ নূরুল আমিন আরও বলেন, এমন প্রতিষ্ঠান খারাপ করার জন্য যে ধরনের কর্মকাণ্ড করা প্রয়োজন, তার সবই এই ব্যাংকে ছিল। ফলে ব্যাংকটি খারাপ হয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক ছিল। যারা এসব করেছে, এখন পর্যন্ত তাদের কোনো জবাবদিহিও করতে হয়নি। দোষীদের বিচার না হলে ও জবাবদিহি না থাকলে অন্য ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

 

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।