শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৮:৫৩ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন : হেরফের হয়নি ভল্টের স্বর্ণ

একুশে বার্তা ডেক্স : বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত স্বর্ণ হেরফের হয়নি। একটি স্বর্ণের চাকতি ও রিঙের বিশুদ্ধতা লিপিবদ্ধ করার সময় ভুলবশত ৪০ শতাংশের পরিবর্তে ৮০ শতাংশ লেখায় জটিলতার উদ্ভব হয়। শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদনে বিশুদ্ধতার হার নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সেটা সঠিক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রক্রিয়ার বাইরে ভিন্ন প্রক্রিয়ায় মান নির্ধারণের কারণে তারতম্য হয়েছে। অন্যদিকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় না নিয়ে ওজন করায় ওজনে তারতম্য হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

শুল্ক গোয়েন্দার ভল্ট পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্য যাচাই-বাছাই করতে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত কমিটি গঠন করে। ভল্ট পরিদর্শন শেষে কমিটি গভর্নরের কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে শুল্ক গোয়েন্দার পরিদর্শন প্রতিবেদনের প্রতিটি আপত্তি খণ্ডন করে বিশদ ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ২৮ নভেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার কাছে গোপনীয় প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। একই সঙ্গে প্রতিবেদনে শুল্ক গোয়েন্দার উত্থাপিত আপত্তিগুলো নিষ্পত্তিকৃত হিসেবে গণ্য করার অনুরোধ জানানো হয়।

২০১৬ সালের ২৪ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার যাচাই-বাছাই করতে আট সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর। কমিটি ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি ভল্ট পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু করে। কাস্টমসের ২২৭টি মামলায় আটক এবং ভল্টে রক্ষিত ৯৬৩ কেজি স্বর্ণ যাচাই-বাছাই করা হয়। যাচাই-বাছাই শেষে চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি এনবিআরে শুল্ক গোয়েন্দা থেকে একটি তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়।

এ প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের চাকতি ও রিং জমা রাখার সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮০ শতাংশ বিশুদ্ধ স্বর্ণের প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়। পরিদর্শনে চাকতিতে ৪৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ (১১ দশমিক ২০ ক্যারেট) এবং রিঙে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ (৩ দশমিক ৬৩ ক্যারেট) স্বর্ণ পাওয়া গেছে। এ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও জনমনে তোলপাড় শুরু হয়।

তখন থেকে শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদনের তথ্যকে ভুল দাবি করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ভল্টের স্বর্ণ হেরফের তদন্তে ২২ জুলাই ছয় সদস্যের ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন’ কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে কমিটি করেন গভর্নর ফজলে কবির। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এএনএম আবুল কাশেমকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়। কমিটিতে ছিলেন বাংলাদেশে ব্যাংকের কারেন্সি অফিসার আওলাদ হোসেন চৌধুরী ও ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্টের মহাব্যবস্থাপক সুলতান মাসুদ আহমেদ। এছাড়া কমিটিতে আরও দু’জন মহাব্যবস্থাপক ও একজন উপমহাব্যবস্থাপক রাখা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত স্বর্ণ পরীক্ষকের যাচাই অনুযায়ী জমাদানের সময় চাকতি ও রিংটির স্বর্ণের বিশুদ্ধতার মান ৪০ শতাংশ হলেও ওই তারিখে অন্য সব স্বর্ণালংকারের মান ছিল ৮০ শতাংশ। অন্য সব স্বর্ণালংকারের বিশুদ্ধতার মান ৮০ শতাংশ হওয়ায় অসাবধানতাবশত চাকতি ও রিংটির মানও একই ধারাবাহিকতায় ৪০ শতাংশের স্থলে ৮০ শতাংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ করনিক ভুলের স্বপক্ষে যুক্তিতে বলা হয়- শুল্ক গোয়েন্দার আপত্তি অনুযায়ী ওজন ঠিক রেখে

৮০ শতাংশ স্বর্ণবিশিষ্ট চাকতি ৪৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ স্বর্ণবিশিষ্ট চাকতি দিয়ে এবং ৮০ শতাংশ রিংটি ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ স্বর্ণবিশিষ্ট রিং দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হলে (স্বর্ণের ঘনত্ব প্রতি ঘনসেন্টিমিটারে ১৯ দশমিক ৩২ গ্রাম, রুপার ঘনত্ব ১০ দশমিক ৫০ গ্রাম ও তামার ঘনত্ব ৮ দশমিক ৯৬ গ্রাম) চাকতি ও রিংটির আয়তন লক্ষণীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পাবে, যা সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা। কিন্তু ভল্টে জমা দেয়া কাস্টমস কর্মকর্তা ও তালিকাভুক্ত স্বর্ণপরীক্ষক চাকতি ও রিংটির আকার ও আয়তনে অস্বাভাবিকতা দেখতে পাননি।

এছাড়া চাকতি ও রিংটির গায়ে লাগানো মাস্কিং টেপের ওপর কাস্টম হাউসের প্রতিনিধির লাল কালিতে হাতে লেখা ভিজিআর নম্বর অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। এ কাগজ অক্ষত অবস্থায় উঠিয়ে নতুন তৈরি আরেকটি চাকতি ও রিঙে লাগানোর আলামত পাওয়া যায়নি। বিশুদ্ধতার মান তারতম্যের বিষয়ে বলা হয়, দুটি ভিন্ন প্রক্রিয়ায় স্বর্ণালংকারের মান নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রেকর্ড করা মানের সঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দার পরিদর্শন দলের যাচাই করা মানের পার্থক্য দেখা গেছে।

এর যৌক্তিকতায় বলা হয়, শুল্ক গোয়েন্দার দল বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বর্ণের বিশুদ্ধতার মান নির্ধারণের প্রক্রিয়া বিবেচনায় নেয়নি এবং তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশুদ্ধতার মান নির্ধারণ প্রক্রিয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হলে স্বর্ণের মানে তারতম্যের কারণ স্পষ্ট হতো।

ওজনে তারতম্যের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওজন পরিমাপক মেশিনের অবস্থানগত ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ (ওজন যন্ত্রের কাছেই বড় আকারের কয়েন বক্স ওঠানো-নামানো, প্যাডস্ট্যাল ফ্যান চালু থাকায় সৃষ্ট কম্পন, ওজন মেশিনটি স্থির হতে সময় না দেয়া), ওজনের ক্ষেত্রে কিছুটা রক্ষণশীল নীতি অবলম্বন, অনেক ক্ষেত্রে রাউন্ড ফিগার করা এবং জমা গ্রহণকালে ওজন যন্ত্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার ভিত্তিতে স্বর্ণালংকার একত্রে ওজন করা হয়।

এক্ষেত্রে শুল্ক গোয়েন্দা পরিদর্শনের সময় আইটেমভিত্তিক স্বর্ণালংকার (যেমন- নাকফুল, কানের দুল, আংটি, গলার চেইন আলাদা করে) পৃথকভাবে ওজন করেছে। এ কারণে প্রতিটি আইটেমের ওজনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্থক্য একীভূতভাবে ৪৪৯ দশমিক ৭০ গ্রাম পার্থক্য হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রেকর্ডকৃত ওজনের সঙ্গে শুল্ক গোয়েন্দার পরিদর্শন দলের পরিমাপকৃত ওজনে যেটুকু পার্থক্য হয়েছে, তা বিএসটিআই স্বীকৃত পার্থক্য বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া নিলামের আগে স্বর্ণালংকার পুনরায় ওজন করা হয়, তাই এ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেয়ার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে শুল্ক গোয়েন্দার তৎকালীন মহাপরিচালক ড. মইনুল খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তাৎক্ষণিক মন্তব্য করতে রাজি হননি।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।