মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৮:৪৬ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
যুগান্তরের ২০ বছর পদার্পণে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলমের অনুভুতি : চিরজীবী বাংলাদেশের কল্যাণে যুগান্তর

দৈনিক যুগান্তর উনিশ বছর পেরিয়ে আজ পা রাখল বিশে। এই শুভক্ষণে সত্যের সন্ধানে নির্ভীক, পাঠকের অন্তরজুড়ে থাকা যুগান্তরের সহযাত্রী সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানাই আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন।

একুশ শতকের সূচনালগ্নে আমাদের যে যাত্রা শুরু, অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তা আজ তারুণ্যে উপনীত। তারুণ্যের সাহসী অভিযাত্রায় শামিল আমরা। এই তারুণ্যকে রবীন্দ্রনাথ আবাহন করেছিলেন এমন পঙক্তিতে- “ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা/ ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ/ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা!… চিরযুবা তুই যে চিরজীবী/ জীর্ণ-জরা ঝরিয়ে দিয়ে/ প্রাণ অফুরান ছড়িয়ে দেদার দিবি…।” (সবুজের অভিযান : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

তারুণ্যই বাঙালি জাতির প্রাণশক্তি আর গরিমা। তারুণ্যই তার আত্মপরিচয়। একটি সংবাদপত্র কিংবা গণমাধ্যমের বয়স অবশ্যই অঙ্কের হিসাবে নির্ণয় করা যায় না।

কেননা তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে লক্ষ লক্ষ পাঠকের অস্তিত্ব, তাঁদের ছায়া উপস্থিতি। তা সত্ত্বেও আমরা তারুণ্যের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করছি কারণ তারুণ্য সপ্রাণতা, সক্রিয়তা আর গতিশীলতার প্রতীক।

তারুণ্য সভ্যতার চিরন্তন কাম্য। তারুণ্য যেমন গ্রহণে তীব্র-তীক্ষ্ণ এবং পরাঙ্গম, তেমনই বর্জনেও আপসহীন। তারুণ্য সর্ববিধ মঙ্গলের আবাহনে সমস্ত অমঙ্গলকে দূরে ছুড়ে ফেলে এগিয়ে চলে অকুতোভয়ে।

জন্মের শুভক্ষণে এই অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে সূচিত যুগান্তরের সেই সাহসী পথপরিক্রমা এখনও অব্যাহত। দেশের অন্যতম কবি পুরুষ শামসুর রাহমানের পঙক্তির স্মরণ নিয়ে আমরা বলতে পারি- “এখনও দাঁড়িয়ে আছি এ আমার একধরনের অহংকার/ বেজায় টলছে মাথা, পায়ের তলায় মাটি সারাদিনমান পলায়নপর/… এখনও দাঁড়িয়ে আছি এ আমার একধরনের অহংকার।” (একধরনের অহংকার; শামসুর রাহমান)।

আমাদের অহংকার, অঙ্গীকারে অটল থাকার। যদিও একুশ শতকের বাস্তবতা, প্রতিমুহূর্তে পাল্টে যাচ্ছে সবকিছু। পায়ের তলার মাটিই শুধু নয়, মাথার ওপরে যে আকাশ, সেটিও মুহূর্তে মুহূর্তে রং বদলাচ্ছে।

সেই সতত বদলে যাওয়া বিশ্বে টিকে থাকতে হয় প্রচণ্ড যোগ্যতায়। আর সেটাই আমাদের অহংকার। বদলে যাচ্ছে সমাজ, বদলে যাচ্ছে দেশ, বদলে যাচ্ছে বিশ্ব- বদলে যাচ্ছি আপনি আমি সবাই, সেই বদলে যাওয়ার ঘূর্ণিপাকে আরেকটি নতুন বছর। আজ আরও এক নতুন বাস্তবতায় এসে দাঁড়ালাম আমরা।

২.

জীবন এক বহতা নদী। এক ধারায় নয়, বহু ধারায় বয়ে চলে। যদি রুদ্ধ হয় তার একটি ধারা, সে অন্য ধারায় বয়ে চলে সমুদ্রের দিকে। জীবন বহুমাত্রিক, বহুরৈখিক। দশ দিগন্তে তার সর্বব্যাপী বিস্তার। সভ্যতার ইতিহাস, পরিবর্তনশীল বিশ্বের জাতিগুলোর ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে সেটা স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়। আমরাও এই নিয়ম আর নিয়তির বাইরে নই।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অভিযাত্রাও নানা অভিজ্ঞতায়, নানা মাত্রায় পল্লবিত। মূলত আমরা যেন এই সত্য বিস্মৃত হয়েছি যে, নবীনের উদ্যম আর প্রবীণের অভিজ্ঞতা- এই পরম্পরাকে পুঁজি করেই এগিয়ে যায় পৃথিবী, এগিয়ে যায় সভ্যতা।

এখানে কেউই হিসাবের বাইরের নয়। যে হিসাব সমষ্টির, সেই হিসাবের অংশীদার অন্য সবাই। এই হিসাব ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে। সবাইকে নিয়ে, সবার জন্য বলে যথার্থই গণতান্ত্রিক। গণতন্ত্র মানে ৫ বছর পর পর শুধুমাত্র একদিন ভোটদানের অধিকার নয়, প্রতিদিন জীবনের দাবি বুঝে নেওয়ার অধিকার।

স্বাধীন দেশে জ্বালাও, পোড়াও, ভাংচুর এবং হরতাল, অবরোধ অসহযোগের, ঔপনিবেশিক আমলের যে সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতি থেকে ক্রমাগত বেরিয়ে আসছে রাজনীতি। দেশ ও জনগণ।

একটি পরাধীন দেশে নিপীড়িত মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল সেটা বিজাতীয় দখলদারদের বিরুদ্ধে। আজ আমরা স্বাধীন সার্বভৌম। অতএব প্রশ্ন, ওই ধরনের আত্মঘাতী, আত্মবিনাশী কর্মসূচি কার বিরুদ্ধে? এদেশ তো আমার, আপনার, আমাদের।

অতএব রাজনীতিকে হননের হাতিয়ারে পরিণত করা নয়, বরং সৃজনের হাতিয়ারে পরিণত করতে হবে। স্বাধীন দেশের প্রকৃত গণতন্ত্রে অসহযোগ কিংবা দমন পীড়ন নয়, প্রয়োজন সহযোগ ও সংযোগের। এ সত্যটাই তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে আজ।

৩.

সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আমরা যদি আত্মঘাতী সংস্কৃতিতে আবর্তিত হতেই থাকি, তাহলে বঞ্চিত হব সভ্যতার অধিকার থেকে। আমাদের দ্বারে অবিরাম কড়া নাড়ছে এই শতকের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আহ্বান।

আমাদের বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের দক্ষ করে তৈরি করতে হবে সেই বিপ্লবের শরিকানা ও নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠার জন্য। আমরা যদি সেই দায়িত্ব পালন না করি, তাহলে তার পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ।

কবি নজরুল ইসলাম আক্ষেপ করেছিলেন- “বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে/ বিবি তালাকে ফতোয়া খুঁজছি ফেকাহ হাদীস চষে”- সে রকম ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। যদি আমাদের তারুণ্যকে বিশ্বব্যাপী সূচিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সৃজন উৎসবে শরিক করতে না পরি, তাহলে আমরা সর্বনাশের চোরাবালিতে পতিত হব।

আমাদের প্রয়োজন প্রতিদিনের গণতন্ত্র; যে গণতন্ত্রে প্রো-পিপল। প্রো-পাওয়ার গণতন্ত্রের অবসান ঘটুক এ দেশ থেকে। জ্বালাও-পোড়াও, ভাংচুর যেমন গণতন্ত্র নয়, তেমন দমন-পীড়ন-নির্যাতনও নয় গণতন্ত্র।

জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রুটি-রুজির নিশ্চয়তা, জীবনের নিরাপত্তার গ্যরান্টি- এসব হচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্রের শর্ত। গণতন্ত্র হচ্ছে সামনের দিকে এগিয়ে চলার অদম্য প্রেরণা।

পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে যেমন সরকার এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে চলতে হয়, তেমনই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেও সেই বাস্তবতা আমলে নিয়ে দলীয় নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচির নবায়ন, পুনঃনবায়ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

এ কাজটি সার্বক্ষণিক চর্চার- এখানে পিছিয়ে থাকার কোনো অবকাশ নেই। এই চ্যালেঞ্জ জীবন ও সমাজের সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আজ গণমাধ্যমের ক্ষেত্রেও কঠোর বাস্তব এবং সত্য। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতার স্বাধীনতা নয়।

এমনকি একচেটিয়া আধিপত্যের স্বাধীনতাও নয়। আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা প্রতিমুহূর্তে সে পরীক্ষাই দিয়ে চলেছি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে আজ অঙ্গাঙ্গি হয়ে গেছে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধও।

ক্ষমতাসীনদের তোষামোদিও যেমন পাঠকের কাছে বিষ বলে বিবেচিত, তেমনই অন্যদের ক্ষমতা লিপ্সার আকাক্সক্ষাও তাদের কাছে পরিত্যাজ্য বিষয়।

দৈনিক যুগান্তর তার জন্মলগ্ন থেকে আজও সব শ্রেণীর পাঠকের অন্তরের কথাগুলো তুলে ধরে তার প্রতিটি পৃষ্ঠায়। তাই আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকারের ধারাবাহিকতায় এদেশের মানুষের অন্তরের স্বতঃস্ফূর্ত ধ্বনিকে প্রতিধ্বনিত করব, তুলে ধরব আমরা আগামী দিনের প্রত্যাশিত সম্ভাবনাগুলোকেও।

দেশের কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে আমাদের সাহসী ভূমিকা অব্যাহত থাকবে চিরজীবী বাংলাদেশের কল্যাণের লক্ষ্যে। যুগান্তর

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।