শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ১০:১৬ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
গত বছরের আলোচিত ঘটনা : সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়

ওই রায়ের রেফারেন্স হিসেবে যেসব কথা বলা হয়েছে, তা শুধু তাকেই বিতর্কিত করেনি, বরং তা সংবিধানসম্মত কি না তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। ওই রায় বিরোধী দল একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে সরকার ও ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। যুক্তিসংগত কারণে ওই রায়ের বিরুদ্ধে এখন রিভিউ আবেদন করা হয়েছে।

 

ডা. এস এ মালেক

 

গত বছরের একটি আলোচিত ঘটনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কে রায়। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কে ওই সময়ের মাননীয় প্রধান বিচারপতি ও তার সহযোগীরা সম্মিলিতভাবে যে রায় দিয়েছিলেন অর্থাৎ সংসদ বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারবে না। সেই রায়কে কেন্দ্র করেই অনেক তর্ক- বিতর্কের ঝড় উঠেছিল গত বছর। সাংসদের বক্তব্য ছিল- সংসদেই সার্বভৌম। সেই সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করতে হলে রাষ্ট্রের প্রতিটি ব্যাপারে সংসদের অন্য সকল প্রতিষ্ঠানের ওপর সংসদের কর্তৃত্ব থাকা প্রয়োজন। বিচার বিভাগও তা থেকে বিমুক্ত নয়। যদি সংসদ রাষ্ট্রপতিকে অর্থাৎ, সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানের সর্বময় কর্মকর্তাকে সংসদে অপসারণ করতে পারে, তাহলে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক যে বিচারপতি নিয়োগপ্রাপ্ত হন তাদের অপসারণ করার অধিকার সংসদের থাকবে না কেন? অপর দিকে বিচার বিভাগের বক্তব্য ছিল, তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন। সংসদ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কোনো অবকাশ তাদের নেই। আইনের বিরোধ দেখা দিলেই এপিলেড ডিভিশনের রায়েই সর্বগ্রাহ্য। রাষ্ট্রের এক্সিকিউটিব ব্রাঞ্চ অথবা জাতীয় সংসদে কারও অধিকার নেই, বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করবার। সংবিধানের সংশ্লিষ্ট ধারাসমূহ বিশ্লেষণ করলে বিচার বিভাগের এই অধিকার আছে বলেই মনে হয়।
ওই রায়ে মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল সংসদ কর্তৃক বিচারপতিদের অপসারণের অধিকার নাকোচ করা। অথচ সেই রায়ে এমন কিছু প্রসঙ্গ উপস্থাপন করা হয়েছে, যা জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংশিস্নষ্ট। এমনকি জাতির জনকের যে সাংবিধানিক অবস্থান প্রধান বিচারপতির রায়ে তাকেও বিতর্কিত করা হয়েছে বলে মনে হয়। প্রধান বিচারপতির রায়ে যা বলা হয়েছে, তার অর্থ দাঁড়ায় বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। তাই প্রশ্ন জাগে বিচারপতির রায়ে যা বলেছেন, তা সংবিধান সম্মত কি না। আসলে ষোড়ষ সংশোধনী সম্পর্কিত এই রায়ে মূল বিষয় ছিল সংসদে বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারবে কি না; কিন্তু রায়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের চাইতেও অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নসমূহের এমন বিস্ত্মর বিবরণ দেয়া হয়েছে যে পরবর্তী কালে সে কারণেই সরকার ও বিরোধী দলের ভিতর যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে, তা সৃষ্টির পেছনে রায়ের উলেস্নখিত ওই সব প্রসঙ্গের বিবরণসমূহ দায়ী কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

শুধু তাই নয়, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রাপ্তির পর হতে তিনি যেভাবে প্রকাশ্যে আলোচনা সভায় রাষ্ট্র পরিচালনা, সরকার ও রাজনৈতিক সম্পর্কে যেসব অনাকাঙ্খিত মন্ত্মব্য করেছিলেন, তা তো ইতিপূর্বেই প্রধান বিচারকের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে কি না? এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার বিরম্নদ্ধে উত্থাপিত ১১টা মারাত্মক অভিযোগ। নৈতিক অবস্ফলন ও দুর্নীতির মতো অভিযোগ প্রধান বিচারপতির বিরম্নদ্ধে যদি উত্থাপিত হয়, তাহলে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হয় কি-না? আর এর জন্য তো সংসদ সরকার ও রাজনীতিবিদরা দায়ী হতে পারেন না।
এ কথা সত্য ষোড়শ সংশোধনীর রায় ঘোষণার পর জাতীয় সংসদের কোন কোন সদস্য যেভাবে বিচারপতির সমালোচনা করেছেন, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সেজন্য শেষ পর্যন্ত্ম তাকে বিদায় নিতে হলো। তবে সংসদের এই দাবি যে ওই প্রতিষ্ঠানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে সংসদের অভিমত সুপারভেন করা দরকার। বিচার বিভাগ ও এক্সিকিউটিভের দ্বন্দ্ব যার সঙ্গে আইন বিভাগও জড়িয়ে পড়েছিল।
এটা বাংলাদেশেই শুধু একটা নতুন বিষয় হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়নি। পৃথিবীর অনেক সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশেও এ ধরনের সংকট সৃষ্টি হতে দেখা যায়। তবে এই রায়কে কেন্দ্র করে বিরোধী দল বিএনপি বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও এর প্রধান যেভাবে বিষয়টি রাজনীতিকরণ করে তা বিস্ময়কর।
আর ওটা যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সরকার ও সরকারি দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবার জন্য করা হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ আছে কি? লক্ষ্যণীয় হয়েছে প্রধান বিচারপতি সিনহা যে ভাষায় কথা বলেছিলেন, প্রায় একই ভাষা সরকার ও সরকারি দলকে আক্রমণ করবার জন্য ব্যবহার করেছিলেন। তাছাড়া প্রধান বিচারপতি তার সুস্থতা-অসুস্থতা, বিদেশ গমন ও প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে তার ছুটি গ্রহণ প্রাক্কালে লিখিতভাবে যা দিয়েছিলেন তাও পরস্পরবিরোধী। এক বার অসুস্থতার কারণে লিখিতভাবে ছুটি চেয়েছিলেন ও তার পর তিনি সুস্থতার দাবি করেছিলেন। আবার বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে বললেন, তিনি সুস্থ আছেন।
যারা বলেছেন যে, সরকার জোরপূর্বকভাবে প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন, তারা এক বারও তার অসুস্থতাজনিত ছুটির দরখাস্ত্ম এবং চিত্তবিনোদনের জন্য বিদেশ গমন ও তার বিরম্নদ্ধে আনা ১১টা অভিযোগের সম্পর্কে একটা কথাও বলেননি। শুধু একটা কথায় বিরোধী দল থেকে বলা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতিকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করবার মতো ঘটনা এর পূর্বে কখনো ঘটেনি। এবং সে কারণে বিচার ব্যবস্থার প্রতি পূর্ণ অনাস্থা জ্ঞাপন করা হয়েছে। তারা একবার বলেননি ওই ১১টা অভিযোগের কারণে তার সহযোগী এপিলেড ডিভিশনের অন্যান্য বিচারপতিগণ তার সাথে বসে বিচারকার্য সম্পন্ন করতে অস্বীকার করেছেন। বলা হয়েছিল- অভিযোগসমূহ এর পূর্বে আনয়ন করা হলো না কেন এবং সরকার নাকি উদেশ্যমূলকভাবে ঐ অভিযোগগুলো দাঁড় করিয়েছে। কিন্তু মাননীয় প্রধান বিচারপতি সিনহার বিরম্নদ্ধে মরাল টারপিচিউড ও দুর্নীতির মতো অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে এবং তা যদিও সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তখন কী হবে?
প্রধান বিচারপতি তো আপিল ডিভিশনে অন্যান্য বিচারকরা যখন তার সাথে বসে ওই ১১টা অভিযোগ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন এবং তার সাথে একই বেঞ্চে বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, তখনই তো তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। তাই পদত্যাগ কিছুটা দেরিতে হলেও এর পেছনে কোন জোড়-জবরদস্ত্মিমূলক ব্যাপার আছে বলে মনে হয় কি? প্রধান বিচারপতির মতো একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব নিশ্চয়ই অনুধাবন করেছিলেন নিশ্চয় তার ঐ পদে থাকা উচিৎ নয়। তাই হয়তো অত্যন্ত্ম যুক্তিসঙ্গত কারণে দেশের বাইরে অবস্থান নিয়ে ওই পদত্যাগ পত্র দূতাবাসের মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে। যে বাস্ত্মব অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে প্রধান বিচারপতি ওই পদে ফিরে এসে যোগদান ও বিচারকার্য সম্পন্ন করার মতো পরিস্থিতি যে আর ফিরে আসবে না, এটা অনুধাবন করেই তো তিনি পদত্যাগ করেছেন।
সরকারি দল ও কোন কোন সংসদ কর্তৃক প্রধান বিচারপতির বিরম্নদ্ধে সংসদের ভিতরে ও বাইরে যা বলা হয়েছে, তা যে বিচার বিভাগের মর্যাদা একটুও ক্ষুণ্ন করেনি এরূপ দাবি করা ঠিক হবে না। তার সব কর্মকা-ের যদি বিশেস্নষণ করা হয়, তাহলে তা যে তার নিজের সরকারের ও ও জনগণের স্বার্থবিরোধী বলে বিবেচিত হতে পারে, এরূপ সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে।
হপ্রধান বিচারপতি হিসেবে যতটা দায়িত্বশীল হওয়া তার উচিত ছিল ততটা দায়িত্বশীল তিনি হননি। যে কারণেই হোক, তিনি তা হতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। বরং তার কথা-বার্তা ও কর্মকা-ে রাজনৈতিক সংশিস্নষ্টতা থাকার বিষয়টি অগ্রাহ্য করা যায় না। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর ব্যাপারে তিনি যা রায় দিয়েছেন, প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিজস্ব বিবেচনার ভিত্তিতেই তা দেয়া হয়েছিল। অন্যান্য এপিলেড ডিভিশনে তারা সমর্থন জানিয়েছেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে ওই রায় দেয়া হয়েছে।
হওই রায়ের রেফারেন্স হিসেবে যেসব কথা বলা হয়েছে, তা শুধু তাকেই বিতর্কিত করেনি, বরং তা সংবিধান সম্মত কি না তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। ওই রায় বিরোধী দল একটা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে সরকার ও ক্ষমতাসীনদের বিরম্নদ্ধে ব্যবহার করেছিল। যুক্তিসংগত কারণে ওই রায়ের বিরম্নদ্ধে এখন রিভিউআবেদন করা হয়েছে।
এখন বিরোধী দল তাদের পূর্বের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির রায়কে আগামী নির্বাচনে সরকারের বিরুদ্ধে একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করবার চেষ্টা করবে। সরকারের উচিত এ ব্যাপারে একটা স্বচ্ছ ও যুক্তিসংগত অবস্থান গ্রহণ করা। ব্যক্তি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা আর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা একই ব্যক্তি হলেও, তার দু’টি জায়গার অবস্থান ভিন্ন। সুপ্রীম কোর্টে প্রধান বিচারপতির একটা রায় জাতীয় রাজনীতির বিতর্কের বিষয়ও বাঞ্ছনীয় নয়। নতুন বছরে, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে এর একটা সুরাহা হওয়া ।

ডা. এস এ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।