শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৮:৫২ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
মার্কিন হামলায় জেনারেল সোলাইমানি নিহত

ডেক্স রিপোর্ট : ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন সামরিক হামলায় নিহত হয়েছেন ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডের এলিট শাখা কুদ্‌স ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ নির্দেশের মাধ্যমে বছরের শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা নতুন মাত্রায় নিয়ে গেলেন তিনি। সোলাইমানি ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন। সাধারণত লাইমলাইট থেকে দূরে থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধির কারিগর ধরা হয় তাকে। অনেকে তাকে দেশটির পরবর্তী সুপ্রিম লিডার হওয়ার প্রতিযোগিতায়ও এগিয়ে রেখেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।

সুলাইমানির ওপর মার্কিন হামলার প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে, বিধ্বংসী প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে ইরান। দেশটির সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ আল খোমেনি তার মৃত্যুতে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, অপরাধীদের জন্য কঠিন প্রতিশোধ অপেক্ষা করছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অনুসারে, বৃহস্পতিবার ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন সামরিক বাহিনীর চালানো এক হামলায় নিহত হন সোলাইমানি। ইরাকে মার্কিন দূতাবাসে বিক্ষোভকারীদের হামলার একদিন পর এই হামলা চালালো যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের রাষ্ট্র পরিচালিত গণমাধ্যম জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের হেলিকপ্টার দিয়ে চালানো হামলায় জেনারেল সুলাইমানি ও ইরাকি মিলিশিয়া নেতা আবু মাহদি আল-মুহানদিস সহ আটজন নিহত হয়েছেন।

যেভাবে মারা গেলেন সুলেইমানি: সামপ্রতিক সময়ে একাধিকবার বাগদাদে সফর করেছিলেন সুলাইমানি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘন ঘন সফরই সোলাইমানির মৃত্যু ডেকে আনে। ইউএস ইন্সটিটিউট অব পিস এর স্কলার রামজি মারদিনি বলেন, সুলাইমানি বাগদাদে এমনভাবে চলাফেরা করতেন যেন তিনি অস্পৃশ্য। তার এই চিন্তা ভুল ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বের প্রশাসনগুলো তার ওপর হামলার মতো সিদ্ধান্ত নিতো না। তিনি আরো বলেন, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানের বিশাল নেটওয়ার্ক ধরে রাখার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সোলাইমানি। তার মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে।

দ্য ডেইলি মেইল জানিয়েছে, হামলার দিন সবেমাত্র সিরিয়া থেকে বাগদাদে পৌঁছেছিলেন সোলাইমানি। সেখান থেকে তাকে নিয়ে আসতে যায় ইরাকের পপুলার মোবালাইজেশন ফোর্সেস এর মিলিশিয়ারা। স্থানীয় সময় বৃহসপতিবার দিবাগত মধ্যরাত ১২টা ৩৪ মিনিটে বাগদাদ পৌঁছেন তিনি। বাগদাদের বিমানবন্দর থেকে মিলিশিয়াদের সঙ্গে ফেরার সময় একটি মার্কিন ড্রোন থেকে চালানো চারটি ক্ষেপণাস্ত্রে ধ্বংস হয়ে যায় তাকে ও মিলিশিয়াদের বহনকারী দু’টি গাড়ি।

মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সোলাইমানির ওপর হামলার দায় স্বীকার করেছে। এক বিবৃতিতে বলেছে, তাকে হত্যার নির্দেশ দেন ট্রাম্প। বিবৃতিতে বলা হয়, সুলাইমানি ইরাক সহ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন কূটনীতিক ও কর্মকর্তাদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। এমনকি ইরাকে মার্কিন দূতাবাসে বিক্ষোভকারীদের হামলার পেছনেও জড়িত ছিলেন তিনি। আরো বলা হয়, বিদেশে অবস্থানরত মার্কিন কর্মীদের রক্ষা করতে এ নিষ্পত্তিকারী প্রতিরক্ষা পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী। ইরানের ভবিষ্যৎ হামলা প্রতিরোধে এই হামলা চালানো হয়েছে। মার্কিন নাগরিকরা বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্র সবসময় আমাদের জনগণ ও স্বার্থ রক্ষায় সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া অব্যাহত রাখবে।

সোলাইমানি নিহত হওয়ার খবর প্রকাশের পরপরই নিজের টুইট একাউন্টে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পতাকার ছবি পোস্ট করেছেন ট্রাম্প। তার এ নির্দেশ অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রু বধ হলো।

প্রতিশোধের হুমকি: জেনারেল সোলাইমানি ইরানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের একজন। তার নেতৃত্বাধীন কুদ্‌স ফোর্স সরাসরি দেশটির সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ খোমেনির কাছে জবাবদিহি করে। দেশটিতে জাতীয় বীর হিসেবে পরিচিত তিনি। অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শক্তি বৃদ্ধিতে তার ভূমিকা অনবদ্য। তার মৃত্যুর যথাযথ জবাব দেয়ার হুমকি দিয়েছে দেশটির নেতারা। রেভ্যুলুশনারি গার্ডসের সাবেক এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জানিয়েছে, খুবই কুৎসিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কঠোর জবাব দেবে ইরান।

ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ বলেছেন, এই হামলার মাধ্যমে চরম মাত্রায় বিপজ্জনক ও বেকুবি করে উত্তেজনা বাড়িয়েছেন ট্রাম্প। এটা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ। এই অপরাধের জন্য মার্কিন প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ইরান তাদের সকল রাজনৈতিক, আইনি ও আন্তর্জাতিক সক্ষমতা প্রয়োগ করবে।

সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ খোমেনি বলেছেন, আমার সব বন্ধু ও শত্রুরা এটা জেনে রাখুন- বিদ্রোহের জিহাদ এখন নতুন উদ্দীপনায় চলবে। যোদ্ধাদের জন্য রহমতের এ পথে জয় অপেক্ষা করছে। আমাদের প্রিয় জেনারেলের মৃত্যু তিক্ততার। কিন্তু আমাদের অবিরাম লড়াই ও জয় তার হত্যাকারী ও অপরাধীদের জন্য অধিকতর তিক্ত হবে।

সুলাইমানির মৃত্যুতে প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে লেবাননের সশস্ত্র রাজনৈতিক দল হিজবুল্লাহও। দলটির নেতা হাসান নাসরাল্লাহ এক ঘোষণায় বলেন, আমরা সকল যুদ্ধের ময়দানে, সকল ফ্রন্টে একটি পতাকা নিয়ে যাবো। আমরা তার পবিত্র রক্তের দোয়ায় বিদ্রোহের লড়াইয়ে জয় ছিনিয়ে আনবো।

হামলার হুমকি দিয়েছেন ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আমির হাতামিও। তিনি বলেছেন, সুলেইমানির অন্যায্য হত্যার বিধ্বংসী প্রতিশোধ নেয়া হবে।

এদিকে, মার্কিন হামলা নিয়ে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদিল আবদুল মাহদি সতর্ক করে বলেন, এই হামলা ইরাকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিপর্যয়কারী যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাবে। তিনি হামলাটিকে ইরাকের স্বার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন ও জাতীয় মর্যাদার ওপর আক্রমণ হিসেবে বর্ণনা করেন।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিংক্ট্যাংক মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের চার্লস লিস্টার বলেন, কাসেম সোলাইমানির হত্যা মধ্যপ্রাচ্যের কয়েক দশকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা। তার মৃত্যু ইরানের জন্য গুরুতর লোকসান। এতে যে প্রতিক্রিয়া আসবে তা তার মৃত্যুতে যে ক্ষতি হয়েছে তার সমানই হবে।

ইতিমধ্যে, তীব্র প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় ইরাক থেকে মার্কিন কর্মকর্তাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
কে ইরানের জেনারেল কাসেম সুলাইমানি?: ১৯৯৮ সাল থেকে কুদ্‌স ফোর্সের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। বিগত ২০ বছরে তার ওপর বহু হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল সহ বহু আরব গোয়েন্দা সংস্থা। কিন্তু বৃহসপতিবারের আগে কোনো হামলাই সফল হয়নি। গতবছরের শুরুর দিকেও খবর বের হয়েছিল যে, তাকে হত্যার পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র।

সোলাইমানি নেতৃত্বাধীন কুদ্‌স ফোর্স বিদেশে চোরাগুপ্তা অভিযান চালিয়ে থাকে। সিরিয়ায় বাহিনীটির হস্তক্ষেপের অভিযোগ স্বীকার করেছে ইরান। ২০১১ সালে সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ যখন গৃহযুদ্ধে হারার পথে ছিলেন তখন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যান কুদ্‌স ফোর্স প্রধান। পাশাপাশি বাশারের পক্ষে যুদ্ধ করতে অস্ত্র দিয়েছে কয়েক হাজার শিয়া মিলিশিয়াকে। এছাড়া, ইরাকে আইএস বিরোধী লড়াইয়েও তার ভূমিকা বিশাল। ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধকৌশলের জন্য বিশ্বজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি।

ইরানে সুলেইমানি বিখ্যাত তারকাদের চেয়েও জনপ্রিয়। ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে ইরানের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে তার নেতৃত্বাধীন কুদ্‌স ফোর্স। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পমেপও গত বছরের এপ্রিলে ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডস ও কুর্দস ফোর্সকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
১৯৯৮ সাল থেকে ইরানের সবচেয়ে ক্ষিপ্র, চতুর ও প্রভাবশালী বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন সোলাইমানি। প্রথমদিকে তার বাহিনীর তৎপরতা ছিল খুবই নগণ্য। সে সময় লেবাননে হিজবুল্লাহ, সিরিয়ায় আসাদ ও ইরাকে শিয়া মিলিশিয়াদের সঙ্গে সমপর্ক জোরদার করেন তিনি। সামপ্রতিক বছরগুলোয় লাইমলাইটে এসেছেন। প্রায়ই ইরানের সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ খোমেনি ও অন্যান্য প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে দেখা গেছে তাকে। তার নেতৃত্বে ইরানের বাইরে গোয়েন্দা, আর্থিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব অর্জন করে কুদ্‌স ফোর্স।

তবে সোলাইমানির উত্থান হয়েছে একেবারে সাধারণ একজন হিসেবে। তার জন্ম ইরানের পূর্বাঞ্চলে দরিদ্র পিতা-মাতার ঘরে। পরিবারকে সাহায্য করতে ১৩ বছর বয়স থেকেই কাজ শুরু করেন তিনি। ১৯৭৯ সালে ইরানে বিদ্রোহের সময় সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। মাত্র ছয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যাপক কৌশলগত ক্ষিপ্রতা ও চতুরতা প্রদর্শন করেন। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় তার অবদানের জন্য জাতীয় বীরের পরিচিত পান এ জেনারেল

২০০৫ সালে ইরাকে ফের সরকার গঠনের পর সেখানকার রাজনীতিতে প্রভাব বৃদ্ধি করেন সোলাইমানি। সে সময় ইরাকে গঠিত হয় শিয়াভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও প্যারামিলিটারি বাহিনী বদর অর্গানাইজেশন। দেশটিতে ইরানের সবচেয়ে পুরনো প্রক্সি বাহিনী হিসেবে পরিচিত তারা।

২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের সময় ইরাকি মিলিশিয়াদের আসাদ সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেন সুলাইমানি। এছাড়া, ইরাকে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস বিরোধী যুদ্ধে ইরান-সমর্থিত শিয়া প্যারামিলিটারি ইউনিটগুলো ও বিখ্যাত হাশদ আল-শাবি (পপুলার মোবালাইজেশন ফোর্সেস) ইরাকি মিলিটারির সঙ্গে মিলে লড়াই করে। এসব সংগঠনের অনেকগুলোই ছিল সুলেইমানির নিয়ন্ত্রণে।

এখন পর্যন্ত বহুবার সোলাইমানি নিহত হয়েছেন বলে গুজব ছড়িয়েছে। ২০০৬ সালে ইরানে এক বিমান দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। তখন গুজব ছড়ায় যে, সুলেইমানি মারা গেছেন। এরপর ২০১২ সালে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে এক বোমা হামলার পরও তার মৃত্যুর খবর ছড়ায়। ২০১৫ সালে গুজব ছড়ায় যে, আসাদপন্থি বাহিনীর নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সিরিয়ায় এক হামলায় নিহত বা গুরুতর আহত হয়েছেন সুলাইমানি।
গত বছরের আগস্টে সিরিয়াজুড়ে রেভ্যুলুশনারি গার্ডের ঘাঁটিগুলোয় ব্যাপক ড্রোন হামলা চালায় ইসরাইল। ইসরাইলের গোয়েন্দা বিষয়ক মন্ত্রী ইসরাইল কাতজ পরে জানান, সে সময় সোলেইমানিকে হত্যার চেষ্টা করছিল ইসরাইল। সর্বশেষ গত অক্টোবরে তেহরান দাবি করেছে, তারা সুলেইমানির ওপর ইসরাইলি ও আরব সংস্থাগুলোর একটি হামলা নস্যাৎ করেছে।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।