শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৪০ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
টিআই’র রিপোর্ট : বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেনি, অবস্থানের পরিবর্তন

ডেক্স রিপোর্ট : দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযান এবং সরকারের উচ্চস্তরের ঘোষণা সত্ত্বেও বাংলাদেশে দুর্নীতি কমছে না। এবার গতবারের মতো ২৬ স্কোর পেয়ে ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার সর্বনিম্ন থেকে গণনা অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম, যা ২০১৮ এর তুলনায় ১ ধাপ উন্নতি। আর সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী ১৪৬তম, যা ২০১৮ এর তুলনায় ৩ ধাপ উন্নতি। তবে আগের বছরের চেয়ে স্কোর (২৬) বাড়েনি, যা উদ্বেগজনক। জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচক বা করাপশন পারসেপশন্স ইনডেক্সে (সিপিআই)-২০১৯ এ চিত্র উঠে এসেছে।

গত ২৩ জানুয়ারি  সারা বিশ্বে একযোগে দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০১৯ প্রকাশ করেছে টিআই। রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবি কার্যালয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, টিআইবির চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল, উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (আউটরিচ কমিউনিকেশন) শেখ মঞ্জুর ই আলম।

প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। ধারণা সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের অবস্থা তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এবার বাংলাদেশ দুর্নীতি সূচকে নিম্নক্রম অনুযায়ী ১৪তম দেশ। সূচকের মোট ১০০ পয়েন্টের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬ পয়েন্ট। গত বছর এ অবস্থান ছিল ১৩তম। ২০১৮ সালে একই পয়েন্ট পেয়েই ১৪৯তম হয়েছিল বাংলাদেশ। অর্থাৎ, র‌্যাংকিংয়ে অগ্রগতি হলেও দুর্নীতির সূচক পয়েন্টে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি হয়নি, যা বিব্রতকর ও উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছে টিআইবি। তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। আর এশিয়ার ৩১ দেশের মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এবার এই ১৪তম অবস্থানে বাংলাদেশ ছাড়াও আছে অ্যাঙ্গোলা, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, ইরান, মোজাম্বিক ও নাইজেরিয়া।
তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে করা এই ইনডেক্সের গড় স্কোর ৪৩। দক্ষিণ এশিয়ায় শুধুমাত্র ভুটান এই বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। ৮৭ স্কোর করে তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ড। ১৮০টি দেশের তালিকায় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া, যার স্কোর ৯।

প্রতিবেদনটি তুলে ধরে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির ক্রমানুসারে আমরা এক ধাপ উন্নতি করলেও আমাদের স্কোর বাড়েনি। আগের বছর স্কোর ছিল ২৬, এবারও তা-ই রয়ে গেছে। স্কোরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কেউ হয়তো বেশি খারাপ করেছে, তাই আমরা এক ধাপ এগিয়েছি। এতে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। ২০১৯ সালের দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের স্কোর এবং অবস্থান উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও শুদ্ধাচার জরুরি।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গত বছর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সময় মানুষের মধ্যে একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এটা কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েই গেছে।
তিনি বলেন, ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত দুর্নীতিতে শীর্ষে থাকলেও টিআইবির প্রত্যাশা ছিল, দুর্নীতি দমনে বর্তমান সরকারের ?জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণার পর বাংলাদেশের অবস্থান আরো ভালোর দিকে যেতো। তবে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শুদ্ধাচার না থাকা, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে রাখা, তথ্য অধিকার আইনসহ নানা করণে বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো উন্নতি হয়নি।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গত বছরে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের একটা প্রভাব এই র‌্যাংকিংয়ে রয়েছে। সরকারের সংস্থাগুলোর জবাবদিহিতা আরো বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শুদ্ধাচার নিয়ে আসতে হবে।
স্বজনপ্রীতি ও ভয়ের ঊর্ধে থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স ঘোষণা, সামাজিক পরিচয় ও অবস্থান বিবেচনা না করে দুর্নীতিগ্রস্তদের বিচারের আওতায় আনায় দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশের স্থিতিশীল থাকার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, দুর্নীতির ভালো স্কোর করার মতো আইনি ও কাঠামোগত সক্ষমতা আছে। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার জন্যই স্কোরে এগোতে পারছে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি করেছে। দুর্নীতি থাকার ফলে এর সুফল মানুষ ঠিকমতো পাচ্ছে না।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ সূচকে উন্নতি করতে হলে দুদক, জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টরে স্বচ্ছতা আনতে হবে।

দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করছে কি না, জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইনিভাবে দুদক স্বাধীন। তবে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দৃঢ় মানসিকতার ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর নয় তারা। তাদের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে। সরকার মনে করে, এটি তারা প্রতিষ্ঠা করেছে, এজন্য এটি তাদের প্রতিষ্ঠান।
অনুষ্ঠানে টিআইবির চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির ব্যবহার হচ্ছে কোথায়, কার ভোগে যাচ্ছে, সেটা সঠিকভাবে বণ্টন হচ্ছে কী না তা দেখতে হবে। দুর্নীতি না থাকলে আমাদের আরো উন্নতি হতো।

প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক র?্যাংকিংয়ে- ভুটান ২৫তম (৬৮ পয়েন্ট), ভারত ৮০তম (৪১ পয়েন্ট), শ্রীলংকা ৯৩তম (৩৮ পয়েন্ট), নেপাল ১১৩তম (৩৪ পয়েন্ট), পাকিস্তান ১২০তম (৩২ পয়েন্ট), মালদ্বীপ ১৩০তম (২৯ পয়েন্ট) ও আফগানিস্তান ১৭৩তম (১৬ পয়েন্ট) অবস্থানে রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, ২০১৯ সালের সিপিআই অনুযায়ী বৈশ্বিক দুর্নীতি পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এবারের বৈশ্বিক গড় স্কোর ৪৩ হলেও সূচকে অন্তর্ভুক্ত ১৮০টি দেশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দেশই ৫০ এর কম স্কোর পেয়েছে। এর মধ্যে ৬০টি দেশের স্কোরের উন্নতি হলেও এবার স্কোর অপরিবর্তিত আছে ৫২টি দেশের এবং উদ্বেগজনকভাবে স্কোর কমেছে ৬৮টি দেশের।

মোট ৬টি তথ্যের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত সুবিধা বা লাভের জন্য ‘সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের’ ভিত্তিতে সিপিআই দুর্নীতি সূচক নির্ণয় করা হয়েছে। এগুলো হলো, দুর্নীতি ও ঘুষ আদান-প্রদান, স্বার্থের সংঘাত ও তহবিল অপসারণ, দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগ ও অর্জনে বাধা, ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক দলের স্বার্থে সরকারি পদমর্যাদার অপব্যবহার, প্রশাসন, কর আদায়, বিচার বিভাগসহ সরকারি কাজে বিধিবহির্ভূত অর্থ আদায় এবং অনিয়ম প্রতিরোধ ও দুর্নীতি সংঘটনকারীর বিচার করতে সরকারের সামর্থ্য, সাফল্য ও ব্যর্থতা। তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। এই অঞ্চলে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থা কেবল আফগানিস্তানের।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।