শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০১:০৫ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
যেভাবে জন্ম আ’লীগের

আজাদ খান ভাসানী :১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তানের যেদিন জন্ম হয় মওলানা ভাসানী সেদিন আসামের কারাগারে। স্বাধীন পাকিস্তানে ফিরেই তিনি ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে ঢাকায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ইষ্ট হাউসের দক্ষিণ দিকের মাঠে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় সর্বপ্রথম ভাষণ দান করেন।

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণ টাঙ্গাইলের একটি আসন থেকে তিনি মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। আইন পরিষদের সদস্য হিশেবে তিনি পরিষদ অধিবেশনে বাংলায় কথা বলার দাবী উত্থাপন করেন।

১৯ মার্চ বাজেট অধিবেশনের আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্যে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম?’

‘৪৮-এর ২৭ রমজান লালবাগ পুলিশ হত্যার ঘটনা এবং শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট তাঁকে মুসলিম লীগের ভাবগতি নিয়ে সন্দিহান করে তোলে। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁর বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু করলে তিনি এর প্রতিবাদ স্বরূপ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

১৯৪৯ সালের মার্চে তিনি কয়েক দিনের জন্য আসাম গমন করেন এবং ১৭ মার্চ সেখানে গ্রেফতার হন। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তিনি জেলখানা থেকে ছাড়া পান এবং দেশে ফিরে আসেন।

মুসলিম লীগ সেসময় তাঁর মুক্তির জন্য বিশেষ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রগতিশীল ছাত্র যুবক অংশটি তাঁর মুক্তির দাবিতে মিছিল সমাবেশ করেছে। এহেন পরিস্থিতিতে তিনি দেশে ফিরে এসে সারা দেশ ঘুরে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন।

ইতিমধ্যেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম লীগ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ১৫ জুন এক বিবৃতিতে ২৩ ও ২৪ জুন মুসলিম লীগের বিক্ষুব্ধ কিছু তরুন কর্মীদের নিয়ে ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক সম্মেলন আহ্বান করেন।

২৩ জুন শুরু হওয়া সম্মেলনে আতাউর রহমান খান সভাপতিত্ব করেন। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মওলানা ভাসানী। শেরে বাংলা ফজলুল হকও কিছুক্ষণের জন্য উপস্থিত হয়ে সংক্ষিপ্ত এক ভাষণ দিয়েছিলেন। সভায় উপস্থিত প্রায় শ’তিনেক প্রতিনিধির সম্মতিতে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।

চল্লিশ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হলেন মওলানা ভাসানী; সহ-সভাপতি যথাক্রমেঃ আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমদ এমএলএ, আলী আমজাদ খান এবং আবদুস সালাম খান; সাধারণ সম্পাদকঃ শামসুল হক; সহ-সম্পাদক যথাক্রমেঃ খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান ও এ কে রফিকুল হোসেন; কোষাধ্যক্ষঃ ইয়ার মোহাম্মদ খান…প্রমূখ।

২৪ জুন সদ্যগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় আরমানিটোলা মাঠে। সভায় সভাপতির ভাষণে মওলানা ভাসানী সরকারের বাইশ মাসের অপকীর্তির খতিয়ান তুলে ধরে সবাইকে আওয়ামী মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান।

১১ অক্টোবর তিনি আরমানিটোলা মাঠে এক জনসভায় খাদ্যসমস্যা সমাধানে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনের ব্যর্থতার জন্য তাঁর পদত্যাগ দাবী করে বক্তব্য রাখেন। সভা শেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবীতে ভুখামিছিল বের করলে ১৩ অক্টোবর বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।

১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ২৪ ডিসেম্বর তিনি আরমানিটোলা ময়দানে বিশাল জনসভায় ভাষণ দান করেন । ঐ দিন একই সময়ে পল্টন ময়দানে লিয়াকত আলীর জনসভায় হাতেগোনা মানুষের উপস্হিতি তখনকার সময়ে মওলানা ভাসানী ও আওয়ামী মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা জানান দেয়।

১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ‘৫৩ সালের কাউন্সিল অধিবেশনেই তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ পার্টিতে পরিণত করতে ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণের প্রস্তাব করেন।

সোহরাওয়ার্দী সাহেব দ্বিমত পোষণ করলেও শেখ মুজিব তখন তাঁর প্রস্তাবকে সমর্থন দিলেন। তারপর ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়।

সেসময়ের একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলেন, ‘মওলানা ভাসানীর বর্ণনাতীত ও অপরিসীম ত্যাগ ও কঠোর পরিশ্রমই আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান দখলে সক্ষম করে। অত্যাচারী জালেম মুসলিম লীগ সরকারের আমলে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সরকারী চাকরী এডভোকেট জেনারেলের পদ গ্রহণ করেন।

জনাব আতাউর রহমান খান স্বীয় ওকালতি পেশায় অধিকাংশ সময়ই মগ্ন ও স্বীয় পরিবার পরিজনদের তত্ত্বাবধানে ব্যস্ত ছিলেন। অবসর সময়ে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতেন। ফলে সরকারী অত্যাচার, নির্যাতন, জেল, জুলুম, আর্থিক কষ্টভোগ সবকিছুই সহ্য করিতে হইত সর্বত্যাগী মওলানা ভাসানীকেই।

মজলুম নেতার উপযুক্ত পার্শ্বচর ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তরুন নেতা শামসুল হক ও যুগ্ম-সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালে ঢাকা কারাগারে আটকাবস্থায় জনাব শামসুল হক মানসিক ভারসাম্য হারাইয়া ফেলেন ও মানসিক ব্যধিগ্রস্ত অবস্থায় কারামুক্তি লাভ করেন।

জনাব শামসুল হক ১৯৫২ সালে কারান্তরালে থাকা বিধায় যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৫৩ সালে সভাপতি মওলানা ভাসানীর অনুরোধক্রমে জনাব শামসুল হকের স্থলে শেখ মুজিবর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়।’

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।