শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৮:০৩ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
পুলিশের খাতায় ‘পলাতক’ বোতল চৌধুরি ভিআইপি মর্যাদা পেতেন শাহজালাল বিমানবন্দরে , চার রঙের নিরাপত্তা পাস ব্যবহার করতেন : ছিলেন রিজেন্ট এয়ারের বড় কর্তা : বিমানের এমডি করার পায়তারাও করা হয়

নিউজ ডেক্স : পুলিশের খাতায় পলাতক, নিতেন ভিআইপি মর্যাদা, দাপিয়ে বেড়াতেন বিমানবন্দরের স্পর্শকাতর এলাকা। তিনি আর কেউ নন, তিনিই র‌্যাবের জালে আটকা বোতল চৌধুরি ওরফে আশিক চৌধুরি।তাকে নিয়ে দৈনিক আমাদের সময়ে প্রকাশিত বিস্তারিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-

চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত এক নম্বর আসামি আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী পুলিশের খাতায় ছিলেন পলাতক। অথচ গত ২৪ বছর ধরে প্রকাশ্যেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আসা-যাওয়া করতেন। তাও আবার ভিআইপি মর্যাদায়! এমনকি একাধিক এয়ারলাইন্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবেও করেছেন চাকরি। ভিআইপি কোটায় কব্জা করা চার রঙের নিরাপত্তা পাস ব্যবহার করে দাপিয়ে বেড়াতেন বিমানবন্দরের সর্বত্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করেই হাতিয়েছিলেন এ নিরাপত্তা পাস। শুধু নিজেই নন; আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদেরও বিমানবন্দরে ভিআইপি

সুযোগ-সুবিধা করে দিতেন বোতল চৌধুরী। বিনিময়ে পেতেন ‘আশীর্বাদ’। কখনো এমপির ভাই আবার কখনো মন্ত্রীর ভাতিজা পরিচয়ে দাপট দেখাতেন। তার ভয়ে বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও থাকতেন তটস্থ।

খুনের মামলার একজন চার্জশিটভুক্ত আসামি কীভাবে পুলিশ ক্লিয়ারেন্সসহ বিমানবন্দরের ডিউটি পাস পেয়ে দীর্ঘদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন- এমন প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সাবেক এক মন্ত্রীর আশীর্বাদে বেপরোয়া হয়ে উঠেন আশীষ রায় চৌধুরী। কয়েক বছর আগে তাকে বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বানানোরও কানাঘুষা শোনা যায়। তবে সরকারের একটি মহল ও বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে না নেওয়ায় বিষয়টি আর এগোয়নি।’

বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি আশীষ রায় চৌধুরী রিজেন্ট এয়ারওয়েজের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) হিসেবে বিমানবন্দরের ভেতরে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সবুজ, নীল, লাল ও কালো- এই চার রঙের নিরাপত্তা পাস ছিল তার। বিমানবন্দরের অল্প কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারই কেবল এই পাস রয়েছে, যা ব্যবহার করে বিমানবন্দরের যে কোনো জায়গায় নির্বিঘেœ যাওয়া যায়। আর এই পাসটি পাওয়ার আগে ওই ব্যক্তির বিষয়ে সশরীরে তদন্ত করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এমনকি বাবা ও মায়ের আত্মীয়দের ব্যাপারেও তদন্ত করা হয়। তবে অদৃশ্য শক্তির জোরে সব পরীক্ষায় উতরে ভিআইপি এ পাসটি নিজের কব্জায় নেন খুনের মামলার আসামি আশীষ রায়।

রাজধানীর কারওয়ানবাজারে নিজেদের মিডিয়া সেন্টারে গতকাল বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব জানায়, জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত পলাতক আসামি আশীষ রায় চৌধুরীকে মঙ্গলবার রাতে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ রাজধানীর গুলশানের ফ্ল্যাট থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে ২২ বোতল বিদেশি মদ, ১৪ বোতল সোডা ওয়াটার, একটি আইপ্যাড, ১৬টি বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড, দুটি আইফোন ও দুই লাখ টাকা জব্দ করা হয়। র‌্যাব বলছে, গত ২৮ মার্চ আশীষের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে ৭ এপ্রিল তিনি পালিয়ে কানাডায় চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন।

এদিকে সোহেল চৌধুরীর হত্যা মামলার পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কপি থানায় গেলেও অজ্ঞাত কারণে সেটি গায়েব হয়ে যায় বলে অভিযোগ ওঠে। এতে আশীষ রায়ের কোনো হাত ছিল কিনা জানতে চাইলে র‌্যাব কর্মকর্তা কমান্ডার মঈন বলেন, ‘পরোয়ানার তথ্য পেয়ে কাছের মানুষদের সঙ্গে পরামর্শ করেন আশীষ রায়। তারা আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেওয়ার পরামর্শ দেন। তবে তিনি কানাডায় পালাতে চেয়েছিলেন। পরোয়ানার কপি থানা থেকে নিখোঁজ হওয়া বা দাপ্তরিক কোনো জটিলতা হয়ে থাকলে তা সংশ্লিষ্টরা খতিয়ে দেখবে। আমরা অবশ্য পরোয়ানার কপি স্ব-উদ্যোগে সংগ্রহ করেছি।’

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘আশীষ রায় চৌধুরী ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত একটি এয়ারলাইন্সের ডিরেক্টর (অপারেশন্স) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি আরেকটি এয়ারলাইন্সের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। ২০১৩ থেকে এ পর্যন্ত তিনি স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি অসংখ্যবার বিদেশে গেছেন। কানাডায় ছিলেন ৪-৫ বছর। একই মামলায় কানাডায় পলাতক থাকা বান্টি ইসলাম, থাইল্যান্ডে পলাতক থাকা আজিজ মোহাম্মদ ভাই, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেখিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়া আদনান সিদ্দিকীর সঙ্গেও তার যোগাযোগ রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘গত ২৮ মার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়ার পর গ্রেপ্তার আতঙ্কে ছিলেন আশীষ রায় চৌধুরী। এ জন্য ৭ এপ্রিল কানাডায় পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। নিজের বাসা ছেড়ে গুলশানে একটি ভাড়া বাসায় উঠেন, যেটি একটি পাঁচতারকা হোটেলের এমডি ভাড়া করে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে কানাডায় যেতে তিনি একটি এয়ারলাইন্সেরও টিকিট কাটেন।’

আশীষ রায়ের বিরুদ্ধে নতুন কোনো মামলা হবে কিনা বা পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ কী জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, ‘মাসে সাত লিটার মদ পান করার লাইসেন্স রয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। যদিও সেটি দেখাতে পারেননি। আমরা অভিযানের সময় তার ভাড়া বাসা থেকে ২২ বোতল বিদেশি মদ জব্দ করেছি। এ জন্য নতুন করে তার বিরুদ্ধে মাদক আইনে একটি মামলা করা হবে। পাশাপাশি সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় তাকে থানায় সোপর্দ করা হবে।’

যে কারণে নায়ক সোহেল চৌধুরী খুন : আশীষের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, ১৯৯৬ সালে বনানীর আবেদীন টাওয়ারে আশীষ ও আসাদুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলামের যৌথ মালিকানায় ট্রাম্পস ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়। ভোররাত পর্যন্ত নানান অসামাজিক কার্যকলাপ হতো সেখানে। একপর্যায়ে ক্লাবটি আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন ও গ্যাং লিডারদের বিশেষ আখড়ায় পরিণত হয়। সেখানে যাতায়াত ছিল আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়েরও। আন্ডারওয়ার্ল্ডের চক্রগুলোর সঙ্গে মিটিং করতেই তিনি ওই ক্লাবে যেতেন। সেই সুবাদে বান্টি ও আশীষের সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদের সখ্য তৈরি হয়। পরে তিনজন ক্লাব ব্যবহার করে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। ক্লাবের পাশে ছিল বনানী জামে মসজিদ। সোহেল চৌধুরী মসজিদ কমিটিকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাবের অসামাজিক কার্যক্রম বন্ধে কয়েকবার চেষ্টা চালান। এতে আজিজ মোহাম্মদের স্বার্থে আঘাত লাগে। ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাই তার সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর তর্ক ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। প্রতিশোধ নিতে বান্টি, আশীষ ও আজিজ শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনকে দিয়ে সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করেন। ১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে ট্রাম্পস ক্লাবের নিচেই গুলি করে নায়ক সোহেলকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের মামলায় আসামি ফারুক, লিটন, ইমন ও তারেক সাঈদ বর্তমানে জেলে রয়েছেন।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।