শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৩:০৮ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
„বিমান : শুধু তিন সংস্থাই পাবে ১৮ হাজার কোটি টাকা : ৩ মাসের আয় দেখালেও দেনা জর্জরিত : নেপথ্যে দুর্নীতি- অপচয় : দুর্নীতির  লাগাম টানবে কে? 

নিউজ ডেক্স : দেনার জর্জরিত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। শুধু তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের দেনা ১৮ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। সুদ-আসলে এই দেনার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। দুর্নীতি ও অপচয়ের পাশাপাশি লাভজনক গন্তব্য সম্প্রসারণ এবং উড়োজাহাজের পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারাকে এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন এই খাতের বিশ্লেষকরা।জ্ঞাপন

তাঁরা বলছেন, বিমানকে দায়দেনা থেকে বের করতে কমাতে হবে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, নিতে হবে দূরদর্শী ব্যাবসায়িক পরিকল্পনা। লাগাম টানতে হবে দুর্নীতিতে।

কার কাছে কত পাওনা : বেবিচক : বিমানবন্দর ব্যবহারের বিভিন্ন ফি বাবদ বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছে মূল বিল, ভ্যাট, আয়কর, সারচার্জসহ বিমানের আট হাজার ৮০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বকেয়া আছে, যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে তাগাদা দেওয়ার পরও বিমান এই টাকা পরিশোধ করছে না বলে সম্প্রতি নিয়ন্ত্রক এ সংস্থার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

পদ্মা অয়েল : উড়োজাহাজের জ্বালানি জেট ফুয়েল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কম্পানি লিমিটেডের কাছে বিমানের দেনা এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বকেয়া আদায়ে পদ্মা অয়েলও চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

ঋণ : ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিমান ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০সহ মোট ১৬টি উড়োজাহাজ কিনেছে। সম্প্রতি কেনা এসব উড়োজাহাজে অর্থায়ন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। আর সোনালী ব্যাংককে এ অর্থ রিজার্ভ থেকে জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য ১৯ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে বিমান। এ পর্যন্ত বিমান ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছে ১১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। বর্তমানে বকেয়া আছে আট হাজার ২৯১ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে এখন তিন সংস্থার কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই বিমান সংস্থার দায়দেনার পরিমাণ ১৮ হাজার ১৭১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।

তিন মাসে এক হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা আয়ের হিসাব : বিমানের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা যাহিদ হোসেন সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এক হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা আয়ের খবর দিয়েছেন। তিনি জানান, গত তিন মাসে আট লাখ ৮০ হাজার যাত্রী পরিবহন করে এই আয় হয়েছে।

যাহিদ হোসেন বলেন, গত তিন মাসে রাজস্ব আদায়, যাত্রী হ্যান্ডলিং ও যাত্রীসেবায় প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়েছে। এ ধারা বজায় থাকলে এক বছরে ৩২ লাখ যাত্রী পরিবহন করবে বিমান। এতে রাজস্ব আরো বাড়বে। তবে তিনি সেখানে দায়দেনা কিংবা মুনাফার কোনো হিসাব দেননি।

আয়ের বিপরীতে দায় ও মুনাফা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও যাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টিকিট বিক্রিতে গত তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমাদের যে আয় হয়েছে, সেটি পাঁচ বছরে সর্বোচ্চ। লাভ-লোকসানের হিসাব ২০২৩ সালের জুনে গিয়ে বলতে পারব। সিভিল এভিয়েশন অথরিটির কাছে আমাদের যে বকেয়া আছে, সেটা ডিসপিউটেড অ্যামাউন্ট। অর্থাৎ তা মূল পাওনা থেকে সুদে-আসলে অনেক বেশি, যা নিয়ে আমাদেরও আপত্তি আছে। সারচার্জের ওপর সারচার্জ আরোপের বিষয়ে আমরা আপত্তি জানিয়েছি। আমরা প্রকৃত পাওনা পরিশোধ করতে চাই। আমরা এই বিষয় মন্ত্রণালয়ের কাছেও জানিয়েছি। ’

এদিকে করোনা মহামারিকে কারণ দেখিয়ে বেবিচকের কাছে সারচার্জ বাবদ দেনা তিন হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা মওকুফের আবেদন জানিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া পুঞ্জীভূত বকেয়ার ওপর প্রতি মাসে ৬ শতাংশ হারে সারচার্জ মওকুফের জন্য আবেদন জানিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বরাবর। এরপর গত ২০ অক্টোবর বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি পাঠান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উপসচিব। তবে মন্ত্রণালয়ের এই অনুরোধ বেবিচক কর্তৃপক্ষ আপাতত মেনে নিতে পারছে না বলে জানা গেছে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরের আট মাসে প্রতিষ্ঠানটি লাভ দেখায় ৩২৮ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে  বিমান ১৫৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা নিট লাভ দেখায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১৮ কোটি টাকা লাভ হয় সংস্থাটির। ২০১৭-১৮ সালে বিমানের লোকসান হয় ২০১ কোটি টাকার বেশি।

অত্যাধুনিক ড্রিমলাইনারসহ ১৮টি উড়োজাহাজ আছে বিমানের বহরে। ১৭টি আন্তর্জাতিক রুট, শাহজালাল বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও হজ ফ্লাইট—এ তিনটি খাত থেকেই আসে সংস্থাটির বেশির ভাগ আয়। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ঋণের কিস্তি, উড়োজাহাজ ভাড়ার কিস্তি আর রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতি মাসে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকার মতো খরচ হয় বিমানের।

বিমানের বহরে নতুন প্রজন্মের ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ যুক্ত করার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইউরোপ-আমেরিকার মতো লম্বা দূরত্বে ফ্লাইট চালু করা। কিন্তু এসব উড়োজাহাজের কার্যকর ব্যবহার হচ্ছে না; বরং দীর্ঘ দূরত্বে পরিচালনার জন্য আনা এসব উড়োজাহাজ দিয়ে স্বল্প ও মাঝারি দূরত্বের ফ্লাইট পরিচালনায় বিমানের সাইকেল নষ্ট করা হচ্ছে, কমছে আয়ুষ্কাল।

অগ্রগতির পেছনে বাধা দুর্নীতি অপচয় : নব্বইয়ের দশকে ক্রমাগত লোকসানের মুখে বিমান বাংলাদেশকে বেসরকারীকরণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০০৭ সালে বিমানকে একটি পাবলিক লিমিটেড কম্পানিতে পরিণত করা হয়, কিন্তু তার পরও বিমানের আর্থিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি।

বিমানের টিকিট বিক্রি, কার্গোতে হিসাব কম দেখানো, বিদেশে জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে টিকিট বিক্রি, উড়োজাহাজ লিজ নেওয়া, যন্ত্রপাতি কেনা, ভুয়া বিল-ভাউচারসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে বিমানে দুর্নীতি হচ্ছে বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। মিসর থেকে দুটি বোয়িং উড়োজাহাজ ভাড়ায় এনে সাত বছরে এক হাজার ১৬১ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে বিমান। দুর্নীতি ও অনিয়মের পরও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দাখিল করা একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বিমানের ২৮ খাতে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমানের স্টাফরা স্বর্ণসহ অন্যান্য পণ্য চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যা বলছেন : পদ্মা অয়েল কম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) নুমান আহমেদ তাপাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, জ্বালানি তেল বাবদ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কাছে পদ্মা অয়েলের বকেয়া পড়ে আছে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এই বকেয়া মহামারি করোনা শুরুর আগের। করোনা মহামারি শুরু হওয়ায় পর ক্ষতির মুখে পড়ায় বিমান বকেয়া টাকা সঠিক সময়ে পরিশোধ করতে পারেনি। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে বাকিতে জ্বালানি তেল দেওয়া হচ্ছে না। নগদ টাকার বিনিময়ে জ্বালানি তেল দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে নতুন করে এখন আর বকেয়া রাখার কোনো সুযোগ নেই।

বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনা মহামারির পর ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়া বাড়িয়েছে এয়ারলাইনসগুলো, এতে সবার মতো বিমানেরও আয় বেড়েছে। ডলারের বিনিময় হার প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় টাকার অঙ্কে আয়ও বেড়ে গেছে। বিমানের খুব কৃতিত্ব নেই, পরিস্থিতির কারণে তারা গত তিন মাসে আয় বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। তারা আয়ের কথা বলেছে, কিন্তু এর বিপরীতে কোন কোন খাতে কত ব্যয় হয়েছে, তা জানায়নি। পৃথিবীর সব দেশের এয়ারলাইনসগুলো তাদের আর্থিক প্রতিবেদন সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশে এটা করা হয় না। সে ক্ষেত্রে তাদের লাভ নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

তিনি বলেন, ‘আয়-ব্যয়ের সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্য আছে, সেটা দেখার বিষয়। তারা বেবিচক, তেলের টাকা দিয়েছে কি না, সরকারি কোষাগারে যে টাকা জমা দেওয়ার কথা, সেগুলো দিয়েছে কি না—এসব বিষয়ে আমরা বিমানের কাছ থেকে কিছুই জানতে পারি না। বিশাল দেনার বিপরীতে আয়ের দেনার হিসাব সংগতিপূর্ণ নয়। ’কালের কন্ঠ

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।