নিউজ ডেক্স : সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন দাবি করেছেন, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে ‘লেথাল উইপন’ ব্যবহারের নির্দেশ সরাসরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে এসেছিল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেয়া জবানবন্দীতে তিনি বলেন, গত বছরের ১৮ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তাকে ফোন করে জানান, প্রধানমন্ত্রী লেথাল অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। এরপর তিনি তাৎক্ষণিকভাবে অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় জোয়ার্দারকে নির্দেশনা জানালে প্রলয় সারা দেশে সেই বার্তা পৌঁছে দেন।
মামুন বলেন, ‘এই নির্দেশনার পর থেকেই পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট বিশেষ করে ডিএমপি অস্ত্র ব্যবহারে আরো আগ্রাসী হয়ে ওঠে।’ তিনি আরো দাবি করেন, সে সময়ের ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান হারুনুর রশিদ ছিলেন লেথাল উইপন ব্যবহারের বিষয়ে সবচেয়ে ‘উৎসাহী’। তাদের নেতৃত্বেই আন্দোলন দমনে গুলিবর্ষণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যার মতো ঘটনা সংঘটিত হয়।
জবানবন্দীতে এমন সব আরো অজানা তথ্যের জট খোলেন আসামি থেকে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে ৩৬ নম্বর সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি।
গত ২ সেপ্টেম্বর /২৫ মঙ্গলবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে চৌধুরী মামুনের জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। এ দিন বেলা পৌনে ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তার সাক্ষ্য গ্রহণ চলে।
জবানবন্দীতে মামুন বলেন, আমি সাবেক আইজিপি, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। এই মামলায় আসামি হিসেবে জেল হাজতে রয়েছি। আমি ১৯৮৬ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৮৯ সালে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করি। আইজিপি হওয়ার আগে আমি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি, সিআইডির প্রধান, র্যাব মহাপরিচালক এবং সর্বশেষ আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট পর্যন্ত আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।
আমাকে এই মামলায় গ্রেফতার করার পর আমি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে গত ২৪ মার্চ তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন মেজিস্ট্রেট মো: জাকির হোসেনের নিকট প্রেরণ করেন। আমি সেদিনই তার নিকট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করি। এটি সেই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী। জবানবন্দীর প্রতি পৃষ্ঠায় আমার স্বাক্ষর রয়েছে।
পরে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠনের পর আমি দোষ স্বীকার করে পূর্ণাঙ্গ সত্য প্রকাশের অঙ্গীকার করে এপ্রোভার হওয়ার আবেদন করি এবং ট্রাইব্যুনাল সেই আবেদন মঞ্জুর করেন। আমি আজকে পূর্ণাঙ্গ সত্য প্রকাশের অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যে মাননীয় ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদান করছি।
আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমি সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম না। আমার পিতা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৯০ সালে শাল্লা উপজেলা, সুনামগঞ্জের চেয়ারম্যান ছিলেন। আমার ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি অবসর গ্রহণের কথা ছিল। আমাকে প্রথমে দেড় বছর এবং পরে আরো এক বছর আইজিপি হিসেবে এক্সটেনশন দেয়া হয়। ২০১৪ সালে নির্বাচনের পর পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক রাজনৈতিক মেরুকরণ হয় এবং গোপালগঞ্জকেন্দ্রিক বলয় সৃষ্টি হয়। পুলিশ অফিসাররা বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন এবং সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে ওঠেন। এসব কারণে সিনিয়র অফিসারদের পক্ষে পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় আমি ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ছিলাম। তখন আইজিপি ছিলেন জাবেদ পাটোয়ারী। আমি জানতে পারি, তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ৫০% ব্যালট ভর্তি করে রাখার পরামর্শ দেন। সরকারের পক্ষ থেকে সে মোতাবেক ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসিল্যান্ড, ওসি ও দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেয়া হয়। তারা সেই অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন করেন। যেসব পুলিশ অফিসার এই নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করেন, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপিএম ও পিপিএম পদক প্রদানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পুলিশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাব আরো বৃদ্ধি পায়। কিছু পুলিশ অফিসার প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তাদের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় প্রায়ই রাতে বৈঠক হতো এবং তা গভীর রাত পর্যন্ত চলত। যেসব পুলিশ অফিসার ওইসব বৈঠকে অংশগ্রহণ করতেন তাদের মধ্যে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুনুর রশিদ, এসবির অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম, ঢাকার ডিআইজি নুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার, অতিরিক্ত এসপি কাফি, ওসি মাজহার, ওসি ফরমান, ওসি অপুর্ব হাসানসহ আরো বেশ কিছু অফিসার ছিলেন। তাদের কেউ কেউ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন।
সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সাথে সরাসরি যোগাযোগ থাকার কারণে এইসব পুলিশ অফিসার চেইন অব কমান্ড মানতেন না। কিন্তু আমি চাইতাম যে তারা পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করুক। প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মূলত দু’টি গ্রুপ ছিল। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং অন্য গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম। তারা চাইতেন তাদের নিজস্ব বলয়ের লোকজন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোস্টিং পাক এবং ঢাকায় অবস্থান করুক।
১৪-০৪-২০২০ থেকে ৩০-০৯-২০২২ পর্যন্ত আমি র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।
র্যাবের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় আমি জানতে পারি যে, র্যাবের হেডকোয়ার্টার কর্তৃক পরিচালিত উত্তরাঞ্চলীয় র্যাব-১ এর কম্পাউন্ডের ভেতরে টিএফআই সেল (টাস্ক ফোর্স ইন্টারোগেশন সেল) নামে একটি বন্দিশালা ছিল। অন্যান্য র্যাব ইউনিটের অধীনে আরো অনেক বন্দিশালা ছিল। এসব বন্দিশালায় রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের আটক রাখা হতো এবং নির্যাতন করা হতো, যা একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল। অপহরণ, গোপন বন্দিশালায় আটক, নির্যাতন ও ক্রসফায়ারে হত্যার মতো কাজগুলো র্যাবের এডিজি (অপারেশনস) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের (র্যাব ইন্টেলিজেন্স) পরিচালকরা সমন্বয় করতেন। র্যাব কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে তুলে আনা, আটক রাখা কিংবা হত্যা করার নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে আসত বলে শুনেছি। এই নির্দেশনাগুলো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকীর মাধ্যমে আসত বলে জানতে পারি। এই নির্দেশনাগুলো চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করে সরাসরি এডিজি (অপারেশনস) এবং র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের (র্যাব ইন্টেলিজেন্স) পরিচালকদের কাছে পাঠানো হতো।
আমি র্যাবের ডিজি হিসেবে যোগদানের সময় আমার পূর্ববর্তী র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ আমাকে জানান যে, টিএফআই সেলে ব্যারিস্টার আরমান বন্দী আছে। আমি যোগদানের পর র্যাব ইন্টের ডিরেক্টর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেমও আমাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। র্যাবের এডিজি (অপারেশনস) ও র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ (র্যাব ইন্টেলিজেন্স) সাধারণত সেনাবাহিনীর অফিসার থেকে নিয়োগ দেয়া হতো। টিএফআই সেলে ব্যারিস্টার আরমানের বন্দী থাকার বিষয়টি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের নিকট একাধিকবার উপস্থাপন করি এবং এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানতে চাই। তিনি আমাকে পরে জানাবেন মর্মে অবহিত করেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি আর কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি।
আমি র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় পরবর্তী মহাপরিচালক খুরশীদ হোসেনকে ব্যারিস্টার আরমানের বিষয় সম্পর্কে অবহিত করি। র্যাবে অফিসারদের মধ্যে অ্যাডিশনাল এসপি আলেপ উদ্দিন ও এসপি মহিউদ্দিন ফারুকী নামে দুইজন অফিসারকে আমি চিনতাম, যারা বন্দীদের অপহরণ, নির্যাতন এবং হত্যার মতো কাজে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। আলেপ উদ্দিন প্রথমে নারায়ণগঞ্জে কর্মরত ছিলেন, পরে র্যাবের এডিজির (অপারেশনস) প্রস্তাব মতে তাকে র্যাব ইন্টেলিজেন্সে পদায়ন করা হয়।
আমি র্যাব ডিজির দায়িত্ব পালন করার সময় র্যাবের ডিরেক্টর ইন্টেলিজেন্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল খাইরুল ইসলাম এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মশিউর রহমান। এ ছাড়া এডিজি (অপারেশনস) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কর্নেল তোফায়েল, কর্নেল আজাদ এবং কর্নেল কামরুল।
আমার দায়িত্ব পালনকালে যদিও আমি র্যাব কর্তৃক মানুষকে বিনা বিচারে আটক, নির্যাতন এবং কারো ক্রসফায়ারে হত্যার মতো বিষয়গুলো জানতাম, তবুও আমি কোনো তদন্ত করিনি বা এসব বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্তগুলো বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে আসতো এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে চেইন অব কমান্ড মানা হতো না। র্যাবের এই সব কার্যক্রমের ফলে আমেরিকা স্টেট ডিপার্টমেন্ট র্যাব বাহিনীর উপর এবং আমিসহ কয়েকজন সাবেক র্যাব কর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা (স্যানশন) আরোপ করে।
২০২৪ সালের জুলাইয়ে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন করা হয়। এরপর ১৯ জুলাই ২০২৪ থেকে প্রায় প্রতি রাতেই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের ধানমন্ডিস্থ সরকারি বাসায় কোর কমিটির মিটিং হতো। সেখানে আমাদের আন্দোলন দমনসহ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়া হতো। কোর কমিটিতে আমিসহ সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) টিপু সুলতান, অতিরিক্ত সচিব রেজা মোস্তফা, এসএসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ, র্যাব ডিজি ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, বিজিবি ডিজি মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, আনসার ডিজি মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক, এনটিএমসির প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, ডিজিএফআই প্রধান এবং এনএসআই প্রধানরা উপস্থিত থাকতেন।
কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয়। ডিজিএফআই এই প্রস্তাব দেন। আমি বিরোধিতা করেছিলাম, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে আমি রাজি হই। এর পর ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিজিএফআই এবং ডিবি তাদেরকে আটক করে ডিবি হেফাজতে নিয়ে আসে।
তাদেরকে ডিবি হেফাজতে এনে আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের সাথে আপস করার জন্য চাপ দেয়া হয়। তাদের আত্মীয়স্বজনকেও ডিবিতে নিয়ে এসে চাপ প্রদান করা হয়। সমন্বয়কদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে টেলিভিশনে বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করা হয়। এ ব্যাপারে ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ডিবি প্রধান হারুনকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘জিন’ বলে ডাকতেন, কারণ তিনি সরকারের নির্দেশনা পালনে পারদর্শী ছিলেন। আন্দোলনের একপর্যায়ে হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের নজরদারি, তাদের অবস্থান নির্ণয় এবং গুলি করে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করা হয়। হেলিকপ্টার ও ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে, যার পরামর্শ দিয়েছিলেন তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ।
পরে আন্দোলন দমনে সরাসরি লেথাল ওয়েপন ব্যবহার করে এবং আন্দোলন প্রবণ এলাকাগুলো ভাস করে ব্লকরেইড করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আমাকে ফোন করে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলন দমনে সরাসরি লেথাল ওয়েপন ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। তখন আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত ছিলাম এবং আমার সামনে অতিরিক্ত ডিআইডি প্রলয় জোয়ার্দার উপস্থিত ছিলেন। আমি প্রলয় জোয়ার্দারকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানালে তিনি আমার রুম থেকে বের হয়ে ডিএমপি কমিশনারসহ সারা দেশে এই নির্দেশনা পৌঁছে দেন।
এই নির্দেশনা দেয়া হয় ১৮-০৭-২০২৪ তারিখে এবং ওই দিন থেকেই লেথাল ওয়েপন ব্যবহার শুরু হয়। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান তার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের লেথাল ওয়েপন ব্যবহারের নির্দেশ দেন। লেথাল ওয়েপন ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল যেকোনো মূল্যে আন্দোলন দমন করতে হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ফজলে নূর তাপস, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মির্জা আজম, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন প্রধানমন্ত্রীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারে প্ররোচিত করতেন।
১৪-০৭-২০২৪ তারিখ শেখ হাসিনা চীন সফর শেষে দেশে এসে একটি সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিপুতিরা চাকরি পাবে না, তবে কি রাজাকারের সন্তান ও নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?’ এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার মধ্যে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং সমগ্র দেশে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। পর দিন ওবায়দুল কাদের ও নানক মন্তব্য করেন যে, আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রলীগ এবং যুবলীগই যথেষ্ট। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন পুলিশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ড্রোন, হেলিকপ্টার ও লেথাল ওয়েপন ব্যবহার করে আন্দোলনরত অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে আহত এবং নিহত করা হয়।
০৪-০৮-২০২৪ খ্রি: তারিখ সকাল ১১:০০ টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা সমন্বয় কমিটির একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তিন বাহিনীর প্রধান, এসবি প্রধান, ডিজিএফআই প্রধান, এনএসআই প্রধানসহ মোট ২৭ জন। আমি নিজেও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম। বৈঠকে আন্দোলন দমন এবং নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিস্থিতির রিপোর্ট পেশ করছিল। ইতোমধ্যে চারদিকে পরিবেশ পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হওয়ায় বৈঠকটি মুলতবি করা হয়।
০৪-০৮-২০২৪ তারিখ রাতে আবার আমাদেরকে গণভবনে ডাকা হয়। সেখানে আমি, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের ডিজি লে. জেনারেল মুজিব উপস্থিত ছিলাম। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী এবং তার বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন। ডিজিএফআই প্রধান ও এসবি প্রধান মনিরুল বাইরে অপেক্ষমাণ ছিলেন। ওই বৈঠকে ৫ আগস্ট আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি প্রতিহত করার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, পুলিশ ও সেনাবাহিনী সমন্বিতভাবে দায়িত্ব পালন করবে।
এর পর আমরা সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যাই। সেখানে আমি, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, র্যাবের ডিজি, লে. জেনারেল মুজিব, ডিজিএফআই প্রধান, এসবি প্রধান মনিরুল ও ডিএমপি কমিশনার উপস্থিত ছিলাম। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ঢাকা শহরের প্রবেশ মুখগুলোতে ব্যাপক ফোর্স মোতায়েন করে কঠোর অবস্থান নেয়া হবে। মিটিং শেষে রাত ১২টা ৩০ মিনিটে আমরা অপারেশন কন্ট্রোল রুম ত্যাগ করি।
৫ আগস্ট সকালে আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আমার দফতরে যাই। ইতোমধ্যে উত্তরা, যাত্রাবাড়ী এবং বিভিন্ন পথ দিয়ে স্রোতের মতো ছাত্র-জনতা ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে শুরু করে। দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে জানতে পারি, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে তিনি কোথায় যাবেন, সে বিষয়ে আমাদের কিছু জানা ছিল না। বিকেলের দিকে হেলিকপ্টারে করে আমাদের পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে প্রথমে তেজগাঁও বিমানবন্দরের হেলিপ্যাডে এবং সেখান থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অফিসার্স মেসে নিয়ে যাওয়া হয়। হেলিকপ্টারে আমার সাথে ছিলেন এসবি প্রধান মনিরুল, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিআইজি আমেনা। পরবর্তী শিফটে অ্যাডিশনাল ডিআইজি প্রলয়, অ্যাডিশনাল আইজি লুৎফুল কবিরসহ অন্যদেরও সেখানে আনা হয়।
৬ আগস্ট ২০২৪ তারিখে আইজিপি হিসেবে আমার নিয়োগ চুক্তি বাতিল করা হয়। ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকালীন ৩ সেপ্টেম্বর আমাকে গ্রেফতার করা হয়।
আন্দোলন চলাকালীন ২৭ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র সচিব, ডিএমপি কমিশনার এবং আমি আন্দোলনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে নারায়ণগঞ্জ যাই। যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে কিছুক্ষণ অবস্থান করি। সে সময় ওয়ারী জোনের ডিসি ইকবাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মোবাইলে একটি ভিডিও দেখান। ভিডিওটি দেখিয়ে ইকবাল বলেন, ‘গুলিতে একজন মারা যায়, একজন আহত হয়ে পালিয়ে যায়, বাকিরা আর আগায় না।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে সরকারের নির্দেশে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে আন্দোলনকারীদের আহত ও নিহত করায় আমি পুলিশ প্রধান হিসেবে লজ্জিত, অনুতপ্ত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। জুলাইয়ের আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ ব্যাপক নৃশংসতার কারণে আমি গভীর অপরাধ বোধে ভুগছি। বিবেকের তাড়নায় আমি এপ্রুভাল হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ট্রাইব্যুনালে এসে স্বজন হারানো মানুষদের কান্না, আহাজারি, চিকিৎসা প্রদানে বাধা দেয়ার ঘটনায় ডাক্তার ও ভিকটিমদের বক্তব্য এবং ভিডিওতে দেখা নৃশংসতাগুলো আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। বিশেষ করে, হত্যাকাণ্ডের পর লাশগুলো একত্র করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার বিভৎসতা আমাকে ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে।
মামুন বলেন, আমি সাড়ে ৩৬ বছর ধরে পুলিশের চাকরি করেছি। এই চাকরি খুবই চ্যালেঞ্জিং। সব সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। কিন্তু আমার চাকরি জীবনে কখনো আমার বিরুদ্ধে কোনো গুরুতর অভিযোগ আসেনি। আমি সব সময় মানবিকতা ও সচেতনতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এ ধরনের গণহত্যা আমার দায়িত্বকালীন সময়ে সংঘটিত হয়েছে, এই দায় আমি স্বীকার করছি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। আমি এই গণহত্যার শিকার প্রতিটি পরিবার, আহত ব্যক্তিবর্গ, দেশবাসী এবং ট্রাইব্যুনালের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। (এই পর্যায়ে সাক্ষী আবেগপ্রবণ ও অশ্রুসজল হয়ে পড়েন।) আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন। আমার এই সত্য ও পূর্ণাঙ্গ বর্ণনার মাধ্যমে যদি সত্য উদঘাটিত হয় এবং আল্লাহ যদি আমাকে আরো হায়াত দান করেন, তবে বাকি জীবনটা অন্তত কিছুটা হলেও এই অপরাধ বোধ থেকে মুক্ত থাকতে পারব।