শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ১০:১৮ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
এবারের ঈদেও চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটবাজির আশংকা!সরকারি নজরদারি রুখতে পারে এ সিন্ডিকেডবাজি

নিউজ ডেক্স : দেশের ট্যানারিশিল্পের প্রধান উপাদান কাঁচা চামড়ার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই আসে কোরবানির ঈদে। কোরবানির চামড়ায় গরিবের হক। কিন্তু চামড়া ব্যবসায়ীরা কয়েক বছর ধরে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সেই গরিবের হক মেরে নিজেদের পকেট ভারী করছে। গতবারের মতো এবারো কোরবানির চামড়া নিয়ে সিন্ডিকেটবাজির আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল। বিশ্লেষকদের মতে, সরকার আগে থেকেই সিন্ডিকেটের বিষয়ে নজর না রাখলে এবারো চামড়া নিয়ে খেলা হবে; বঞ্চিত হবে এতিমরা।

দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে গার্মেন্টসশিল্পের পর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চামড়াশিল্প খাত। কিন্তু প্রায় এক দশকের বেশি সময় কোরবানির চামড়া নিয়ে কারসাজিতে আন্তর্জাতিক বাজারে এ শিল্প খাত ইমেজ সংকটে ভুগছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখা এখন চ্যালেঞ্জের বিষয়।

এদিকে, আসন্ন কোরবানির কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে কোরবানির আগে কাঁচা চামড়ার ‘হাব’ হিসেবে খ্যাত দেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ জেলায় চারটি মডেল সংরক্ষণাগার (গুদাম) নির্মাণ ও চালু করতে যাচ্ছে। এছাড়া মহামারি করোনার এ সময় যাতে পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করবে পাঁচ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত কমপ্রেহেনসিভ মনিটরিং টিম। পর্যায়ক্রমে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে চামড়া সংরক্ষণে সারাদেশে ৬০০ গুদাম নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। ‘কমিউনিটি পর্যায়ে প্রান্তিক ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের জন্য চামড়া সংরক্ষণাগার’- শীর্ষক প্রকল্প এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। আশা করা হচ্ছে, পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশে কাঁচা চামড়া নিয়ে কয়েক দশকের পুরনো সংকটের সমাধান হবে। এছাড়া এবার কাঁচা চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ কারণে পশুর কাঁচা চামড়া নির্ধারিত মূল্যে বেচাকেনা, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও মজুদে জোর দেয়া হবে। সিন্ডিকেট বাণিজ্য বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়াখাতের রপ্তানি বাণিজ্যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি হবে বলে জানা গেছে।

কোরবানির কাঁচা চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত করার পাশাপাশি এ শিল্প খাতটির বিকাশে ‘কমিটিনিটি পর্যায়ে প্রান্তিক ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের জন্য চামড়া সংরক্ষণাগার’ প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও করণীয় নির্ধারণে সরকারের ভূমিকা শীর্ষক এক বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দ্রুত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। এরই ধারবাহিকতায় সরকারি-বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বের (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ-পিপিপি) ভিত্তিতে প্রকল্পটি নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকার সহায়তাকারী হিসেবে বেশি ভূমিকা রাখবে। কিন্তু গুদামগুলো নির্মাণ ও দেখভালের পুরো দায়-দায়িত্ব থাকবে বেসরকারি খাতের ওপর। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা সরকারের সঙ্গে পিপিপির ভিত্তিতে প্রকল্পটিতে বিনিয়োগ করে লাভবান হবেন। প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সেবার বিনিময়ে নির্দিষ্টহারে সার্ভিস চার্জ দিবে। এতে করে সারাদেশে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চামড়াশিল্প বিকাশে বেশ কয়েকটি নীতিমালা এবং সাভারের হেমায়েতপুরে শিল্পনগরী গড়ে তোলা হলেও কোরবানির চামড়া নিয়ে অরাজকতা বন্ধ হয়নি। অথচ দেশের রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে চামড়া শিল্প খাত। ট্যানারিতে উৎপাদিত ক্রাস্ট ও ফিনিশড লেদারের পাশাপাশি চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে। এছাড়া দেশেও চামড়ার বিপুল চাহিদা রয়েছে। দেশের অর্থনীতি, শিল্প, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের স্বার্থে এ শিল্প খাতের অবদান অনেক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরাসরি চামড়া শিল্প খাতে পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আর এ পাঁচ লাখ মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৫ লাখ মানুষের ভাগ্য জড়িত। কিন্তু কুরবানি এলেই কমদামে চামড়া কেনার একটি প্রবণতা তৈরি হয়েছে। গত দুবছর ধরেই কুরবানির চামড়া বিক্রি হচ্ছে পানির দামে। চামড়া বেচতে না পেরে রাগে-ক্ষোভে দেশের সাধারণ মানুষ কুরবানির চামড়া খাল, নদী, রাস্তায় ফেলে দিচ্ছেন। এতে চরম সংকটে এ খাত। এ অবস্থায় সরকারি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল চামড়া। এটি বিনামূল্যে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ন্যায্য ও সঠিকদাম নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। এছাড়া ব্যবসায়ীরাও সরকারি এ উদ্যোগের পক্ষে বলে জানা গেছে।

সূত্র মতে, কমিউটিনিটি পর্যায়ে প্রান্তিক ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের জন্য চামড়া সংরক্ষণাগারের মাধ্যমে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে নির্মিত গুদামে চামড়া সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গুদামে লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণ করে তিন মাস ধরে তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হবে। এরপরও ভালো দাম না পেলে এসব লবণ দেয়া চামড়া বিদেশে রপ্তানির সুযোগ দিবে সরকার। এ প্রকল্প বাস্তাবয়ন হলে আগামী বছর থেকে চামড়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের ছিনিমিনি খেলা বন্ধ হবে। প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের আর চামড়া ফেলে দিয়ে মূল্যবান জাতীয় সম্পদ নষ্ট করতে হবে না। এ প্রকল্পে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ, সঠিক পদ্ধতি মেনে পশু থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নেয়া, নিয়ম মেনে লবণ দেয়া, বর্জ্র দ্রুত অপসারণ এবং স্থাস্থ্যবিধি রক্ষা করে চামড়া সংরক্ষণ করার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

জানা গেছে, চামড়াশিল্প খাতের বিকাশে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্পনগরী গড়ে উঠেছে। হাজারীবাগ থেকে সাভারে দেশের ১৫৪টি ট্যানারিশিল্প স্থানান্তরিত হয়েছে। ট্যানারিগুলো পুরোদমে ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া উৎপাদন করছে। এ চামড়ার ওপর ভিত্তি করে দেশে গড়ে উঠেছে জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ, বেল্ট ও জ্যাকেটের মতো চামড়াজাত পণ্যসামগ্রীর কারখানা। এসব পণ্য দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এছাড়া ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া রপ্তানি করা হয় ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। রূপকল্প-২০২১ সালের মধ্যে ৪৩ হাজার কোটি টাকার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু করোনাসহ নানা সংকটের কারণে চামড়া রপ্তানিতে তেমন সুখবর দিতে পারছে না উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি হাজারিবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের সময় অনেক ট্যানারি টিকতে না পেরে ঝরে পড়েছে। তবে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা একটি জরুরি বিষয়। পরিকল্পিতভাবে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ করা গেলে চামড়া পাচাররোধ করা সম্ভব হবে। এছাড়া ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়ার উৎপাদন বাড়বে।

কমপ্রেহেনসিভ মনিটরিং প্ল্যান : গতবছরের মতো এবারো কোরবানির চামড়া সংরক্ষণে কমপ্রেহেনসিভ মনিটরিং প্ল্যান করছে সরকার। কোরবানি সামনে রেখে পাঁচ মন্ত্রণালয় ও আরো কয়েকটি অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বিশেষ কমিটি কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও মজুদে বিশেষ কাজ করা হবে। কোরবানির চামড়া যথাযথভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিল্প, বাণিজ্য, পরিবেশ ও বন, ধর্ম, তথ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর, অর্থ বিভাগ, ট্যারিফ কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং চামড়াশিল্প সংশ্লিষ্টরা কাজ করবেন। এছাড়া লবণের সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণসহ সাপ্লাই চেইন স্বাভাবিক রাখতে সার্বক্ষণিক তদারকি করে বিষয়গুলো কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। শিগগিরই এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক করতে যাচ্ছে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।