শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১০:১৪ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
প্রশাসনে দ্বিধাবিভক্ত আওয়ামীপন্থীরা : কেউ কেউ দলদাসে পরিনত:অনেক অফিসার আছেন যারা ইংরেজীতে চিঠি ড্রাফট করতে পারেন না: অথচ তারাই ডিসির ফিললিস্টে!

একুশে বার্তা ডেক্স :  প্রশাসনে আওয়ামীলীগ পন্থীরা দ্বিধাবিভক্ত, অনেকের পোয়বারো, অনেকে মকোণঠাসা। কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন ত্যাগীরা। এ ভাবে প্রশাসনে মানব সেবার পরিবর্তে  অফিসাররা দলদাসে পরিনত হওয়ার জনসেবা ব্যাহত হচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থ ও ভুলনীতির কারণে প্রশাসনে ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক ত্যাগী কর্মকর্তারা। বিএনপি সরকারের সময় নির্যাতিত ও হয়রানির শিকার হওয়া প্রথম সারির কর্মকর্তাদের যেভাবে মূল্যায়িত হওয়ার কথা, অনেক ক্ষেত্রে তার কিছুই হয়নি। শুধু পদোন্নতি আর যেনতেন পোস্টিং নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। কিন্তু তাদের ক্ষোভ এই ভেবে যে, সরকারকে ঠিকই প্রশাসন দলীয়করণের তকমা নিতে হচ্ছে।

অথচ বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। গত ৯ বছরে সচিব থেকে শুরু করে প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে দুর্নীতিবাজ, অদক্ষ ও সরকারবিরোধীদের নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রকট। এখনও তাই। তাদের আশঙ্কা, এ ধারা অব্যাহত থাকলে নির্বাচনের বছরে সরকার বড় ধরনের বিপাকে পড়লে তা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। ভুক্তভোগী কর্মকর্তাদের অনেকে এমন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

এদিকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সচিবালয়সহ প্রশাসনের সর্বত্র সরকারি দল সমর্থক কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থে দ্বন্দ্বে অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দলমত নিরপেক্ষ মেধাভিত্তিক দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা বিদ্যমান বাস্তবতায় দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। তবে দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে এখনও এ সারির যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন তাদেরকে সরকার সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হলে প্রশাসনে আরও বিপর্যয় নেমে আসবে। ভবিষ্যতে মেধাবীরা আর সিভিল সার্ভিসে আসতে আগ্রহ দেখাবে না।

সাবেক সচিব ও প্রশাসন বিষয়ক কলামিস্ট বদিউর রহমান  বলেন, প্রশাসনে এখন আওয়ামী ছাড়া কেউ নেই। সবাই তো আওয়ামী লীগ হতে চায়। এখানেই বিপদ। ভেজালের ভিড়ে সরকার যেমন বেকায়দায় আছে, তেমনি দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে যেসব দক্ষ কর্মকর্তা পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করতে চান, তাদের বেদনা আরও বেশি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউই দলীয়করণের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।

তারা সব সময় নিজস্বমনা এবং কর্মকর্তাদের নামের পাশে এ (আওয়ামী লীগ), বি (বিএনপি) ও জে (জামায়াত) থিউরিতে অটল আছে। আর এর মধ্যে যারা বুদ্ধিমান বা চালাক কর্মকর্তা বলে পরিচিত, তারা নিজের সুবিধা আদায়ে সব সময় রং বদলিয়েছে, খোলস পাল্টিয়েছে। তারা গিরগিটির চেয়েও ওস্তাদ। যখন যে রং লাগে সেটা ধরতে পেরেছে। ফলে তারা সব সময় সাকসেসফুল। দ্বিতীয় কথা হল- এই দুই দলের কেউই প্রশাসন নিরপেক্ষ হোক তা চায় না।

তাদের উদ্দেশ্য হল- বিচার বিভাগ হোক, পুলিশ হোক, প্রশাসন হোক, তাদের দরকার ক্ষমতায় থাকা। ক্ষমতায় থাকতে বা রাখতে পারলে এ রকম বদনাম যা কিছু হোক না কেন তাতে কোনো সমস্যা নেই।’ তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সরকার যদি প্রশাসনে কোনো দলীয়করণ না করত তাহলে সেটা রাজনৈতিক সরকারের জন্যই ভালো হতো। এটা বলছি এ কারণে যে, আমলারা যার পৃষ্ঠপোষকতাই করুক না কেন, সে তার সুবিধামতো রং বদলে চলে যায়।’

সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত প্রশাসনে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদককে বলেন, দীর্ঘদিন থেকে জনমনে অভিযোগ চাউর হয়েছে যে, সরকার প্রশাসনকে অতিমাত্রায় দলীয়করণ করে ফেলেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র অনেকটা উল্টো। বর্তমান সরকারের টানা দুই মেয়াদে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়সহ যারা গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং পেয়েছেন তাদের অনেকে ভিন্ন আদর্শের। কেউ আবার সুবিধাবাদী ও দুর্নীতিগ্রস্ত। দক্ষ তালিকায় থাকা আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদেরও যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। যাকে যেখানে সচিব করা উচিত ছিল তাকে সেখানে দায়িত্ব দেয়া হয়নি।

আবার যাদের আগে সচিব হওয়ার কথা তারা পড়ে আছেন পেছনের সারিতে। কোনো কারণ না থাকলে বলা হয়, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হবে বলে এখন সচিব করা হচ্ছে না। তাদের দাবি, বিএনপি ও জামায়াত সমর্থক ছাড়াও যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগ অনেকটা জনমনে স্টাবলিস্ট, বেছে বেছে তাদেরকেই সামনের সারিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের অনুযোগ, বিএনপি সরকারের সময় তো এসব পদে পদায়নের ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা দেখা হয়নি। সরকারের গুডবুকে থাকা একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, তার অধীনে কাজ করেন এমন অফিসার আছেন যিনি বা যারা একটি নোট ঠিকমতো লিখতে পারেন না।

ইংরেজিতে চিঠি ড্রাফ করা তো অনেক দূরের কথা। অথচ শুনছি, তারা নাকি ডিসি ফিটলিস্টে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তাহলে বুঝতেই পারছেন এ কর্মকর্তা ডিসি হলে কী করবেন। তিনি জানান, একটি অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে এমন একজন কর্মকর্তা চুক্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন যিনি তার দফতরের সাবেক মন্ত্রীকে অনেক বিপাকে ফেলে দিয়েছিলেন। আছে গুরুতর অনেক অভিযোগও। তিনি জানান, একজন কর্মকর্তার চাকরি আছে মাত্র চার মাস। অথচ তাকে সচিব করা হল! প্রশ্ন হল, এই চার মাসে তিনি কী করবেন? তাহলে কী আমরা এটাই ধরে নেব, প্রশাসনকে এখন পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে।

ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের ক্ষেত্রে আস্থাভাজন খোঁজার নামে এ রকম পলিসি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে তো অবস্থা আরও খারাপ। তাদের অভিযোগ- বিগত বিএনপি সরকারের সময় সব রকম ঝুঁকি নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে যারা কাজ করেছেন তাদেরকে পদোন্নতি ছাড়া তেমন আর কিছুই দেয়া হয়নি। উল্টো কারও কারও ভাগ্যে জুটেছে ডাম্পিং পোস্টিং। সরকারি দল সমর্থক হিসেবে পরিচিত হলেও ’৮৫ ব্যাচের একজন পেশাদার দক্ষ কর্মকর্তা  বলেন, এ বছর ৩২ জন সচিব অবসরে যাবেন। গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা দলীয়ভাবে তদন্ত করে দেখুক, এখানে বেশিরভাগ কর্মকর্তা কারা, কোন আদর্শের। তাহলে উত্তরটা সহজে মিলবে। এ ছাড়া নির্বাচনের বছর যারা অবসরে যাবেন তারা নিশ্চয় এ সরকারের কথা আর ভাববেন না। কারণ নিজের পিঠ বাঁচাতে বাতাস যেদিকে যাবে তারা সেদিকেই পাল তুলবেন। এটিই হয়ে আসছে। ’৮৪ ব্যাচের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, পদোন্নতি দেয়ার ক্ষেত্রে একটি বিষয় শুরু থেকেই ভুল হয়েছে। দল সমর্থক দাবিদারদের ঢালাওভাবে পদোন্নতি দিতে গিয়ে অনেক পেশাদার দক্ষ অফিসারকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আর যিনি একবার বঞ্চিত হয়েছেন তাকে ওই অজুহাতে পুনরায় পদোন্নতি থেকে বাদ দেয়া হয়। এতে করে দুটি ক্ষতি হয়েছে। একদিকে সরকার তথা দেশ মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তার যথাযথ সেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে, অপরদিকে তাকে জোর করে বিরোধী শিবিরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এমনিতে বেশিরভাগ আমলা কখনও কোনো দলের হয় না। পরিস্থিতির কারণে পদ ও পদোন্নতি পেতে তারা বাধ্য হয়ে কোনো একটা পক্ষ বেছে নেয়।

১০তম ব্যাচ থেকে ২০তম ব্যাচ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা  বলেন, প্রশাসনের অনেক কিছু বাহ্যিকভাবে বোঝা যায় না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিটি দফতরে গেলে যে কারও মনে হতে পারে, সবাই আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা। তাহলে বিএনপি আমলে প্রশাসনে ৭০ ক্ষেত্রেবিশেষে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত যেসব কর্মকর্তাকে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী বলে ধরে নেয়া হয়েছিল, তারা এখন গেল কই? এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করলে যা পাওয়া যাবে তা সুখকর কিছু নয়। দেখা যাবে ব্যক্তিগত সুবিধা নেয়ার জন্য অনেকে আওয়ামী লীগ সেজে বসে আছেন।

তারা বলেন, এসব জরিপ যেই সিগন্যালই দিক না কেন, সংসদীয় সরকারের সময় থেকে প্রশাসনে দলীয়করণের যে কালো অধ্যায় শুরু হয়েছে তার ছেদ ঘটনা আর হয়তো কোনোদিন সম্ভব হবে না। বরং বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের উচিত ছিল- শুরু থেকেই বিশদ স্টাডি করে দীর্ঘমেয়াদি একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা। কিন্তু সেটি হয়নি। বরং পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা হল, সময়ে সময়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। এমনকি শেষমেশ এমন ঘটনাও ঘটেছে শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদে যাওয়া নিয়ে পর্দার আড়ালে ঠাণ্ডা লড়াই হয়েছে। এতে অনেক সময় যার যেখানে পোস্টিং পাওয়ার কথা তিনি একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে জানতে পারেন, তারই ঘনিষ্ঠ ব্যাচমেটের কারণে তিনি সেখানে যেতে পারেননি।

এভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসাব করতে গিয়ে প্রকারান্তরে সরকারের ভীষণ ক্ষতি করছেন। আর এতে করে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, সরকারের শেষ বছরে এসে সরকার সমর্থক কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। তারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। একসময় যারা ঘনিষ্ঠ ব্যাচমেট ছিলেন, তাদের মধ্যে এখন মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ।

এ প্রসঙ্গে একজন সচিব শনিবার প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই সবকিছু তো খোলাসা করে বলতে পারছি না। তবে বলব একদিন।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমি সেখানে গেলে তো তার কথামতো চলব না। এ জন্য আমার যাওয়া হয়নি।’ এ কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, ‘দুঃখ একটাই আওয়ামী লীগ শত্রু ও বন্ধু কোনোটিই সময়মতো চিনতে পারে না।’ একজন উপসচিব বলেন, ‘আমাকে তো ওই অফিস থেকে বের করে দেয়া হল অনেকটা ষড়যন্ত্র করে। কারণ আমি থাকলে তো তাদের আশা পূর্ণ হতো না। এখন ওখানে আমাদের মতো ডেডিকেডেট কেউ আর নেই। যারা আছেন তারা সবাই জি হুজুর মার্কা অফিসার।’ তিনি বলেন, ‘অথচ দেখবেন কোনো সংকট হলে শেষ পর্যন্ত আমরাই পাশে থাকব। জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করার চেষ্টা করব। কিন্তু এরা কেউ থাকবে না। সবার আগে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে।’

প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রশাসনের সাবেক প্রভাবশালী সচিব ও প্রশাসন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আবু আলম শহিদ খান শনিবার  বলেন, ‘কর্মকর্তাদের এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমার প্রথম কথা হল- এ অভিযোগ যারা করছেন, তারা সিভিল সার্ভিসের মৌলিক বিশেষত্বকে ভুলে যাচ্ছেন। সিভিল সার্ভিস কোনো দলের নয়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাদেরকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করা হয়; সেটা প্রশাসন হোক, বিচার বিভাগ হোক, পুলিশ হোক বা অন্য যে কোনো কাজে নিয়োজিত থাকুক; তাদের মূল দায়িত্ব সংবিধানে বলা আছে। তাদের কাজ হল সংবিধান অনুযায়ী সব সময় জনগণের সেবা করা। কোনো দলের সেবা করা বা দলদাস হওয়া তাদের কাজ না। সুতরাং এসব কথা যারা বলেন, তারা ঠিক বলছেন না এবং এভাবে যারা বর্তমানে কাজ করছেন তারাও ঠিক করছেন না। আর একজন সাবেক গণকর্মচারী হিসেবে আমার সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে আপনারা সংবিধানসম্মতভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন।’যুগান্তর

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।