শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ১০:০৯ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
বিমানে পাইলট নিয়োগে অনিয়ম : পাইলটের ভাতিজা-স্ত্রীকে নিয়োগ : স্বীকার করলেন এমডি

একুশে বার্তা ডেক্স : বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সে পাইলট সংকট নিরসনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সংকট নিরসনে পাইলট নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলেও ধাপে ধাপে অনিয়মের কারণে বিপত্তি দেখা দিয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে একাধিকবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পরিবর্তন করা হয়েছে। নানা উপায়ে দুর্বল প্রার্থীকেও পাস করানো হয়েছে।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে সিপিএলধারীদের (কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্স) সঙ্গে বিশেষ এয়ারক্রাফট পরিচালনায় অভিজ্ঞ প্রার্থীর যোগ্যতা এক করে ফেলায় এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থায় দ্রুত পাইলট নিয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে বিমান।
ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের এক কর্মকর্তা  বলেন, বর্তমানে বিমানের বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, বোয়িং ৭৭৭ ও বি৭৩৭ এয়ারক্রাফট পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাইলট নেই। নিজস্ব বৈমানিকের অভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পরও বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার এয়ারক্রাফট দিয়ে ঢাকা-লন্ডন রুটে সারসরি ফ্লাইট চালানো যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বিমানকে উচ্চমূল্যের দেশি-বিদেশি পাইলট দিয়ে ফ্লাইট চালাতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহম্মেদ বলেন, কোনো বিশেষ প্রার্থীকে গ্রেস নম্বর দিয়ে পাস করানো হয়নি। ৫-৬ জন না, সবমিলে ৭৬ জন প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছে। তাদের মধ্য থেকে ৩২ জনকে নিয়োগ দেয়া হবে। প্রার্থীদের মধ্যে আপন ভাইয়ের ছেলে ও পাইলটের স্ত্রী-সন্তান আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আছে, তবে তারা নিজ নিজ যোগ্যতা ও লিখিত পরীক্ষায় পাস করেছেন।
জানা গেছে, ২০১৬ সালে ক্যাডেট পাইলট নিয়োগের জন্য সার্কুলার দেয় বিমান কর্তৃপক্ষ। সার্কুলার অনুযায়ী প্রার্থীর যোগ্যতা ছিল বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি অথবা সমমানের অঙ্ক এবং পদার্থবিজ্ঞানে ন্যূনতম গ্রেড বি অথবা জিপিএ-৩। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ (সিএএবি) থেকে কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্সধারীরাও (সিপিএল) যোগ্য হবেন। সে অনুযায়ী প্রার্থীরা আবেদন করেন।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, সিএএবি থেকে জিইডি ডিগ্রিধারী সিপিএলপ্রাপ্ত প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয়া হয়নি। যদিও সার্কুলারে এ বিষয়ে কিছুই বলা ছিল না। অভিযোগ আছে, ২০১৬ সালে একজন বিশেষ প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়ার জন্য অনেক বেশি সংখ্যক প্রার্থীকে পাস করানো হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে অনেকে নিয়োগ পাওয়ার পরও সিমুলেটর ট্রেনিংয়ে পাস করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে তাদের জন্য বারবার ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। এতে বিমানকে বিপুল অঙ্কের টাকা অতিরিক্ত গুনতে হয়েছে।
এ প্রশ্নের জবাবে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দিক আহেম্মদ বলেন, এরকম তিনজন পাইলট আছেন। তাদের একাধিকবার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এখন তারা নিজদের টাকায় সিমুলেটর ট্রেনিং করে আসবেন। গ্রেস নম্বর দিয়ে পাস করানোর কারণে এবারও অনেক দুর্বল প্রার্থী বের হয়ে আসতে পারেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবার যাতে কোনো দুর্বল প্রার্থীকে পাস করানো না হয়, সেজন্য মৌখিক পরীক্ষার পুরো চিত্র ভিডিও করা হয়েছে।
এবারও বিমানের পাইলট নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। যোগ্যতা হিসেবে এসএসসি কিংবা এইচএসসি অথবা অঙ্ক এবং পদার্থসহ সমমানের ন্যূনতম জিপিএ-৩ থাকার কথা বলা হয়েছে। সার্কুলার অনুযায়ী ‘ও লেভেল’ হলে গ্রেড বি এবং ‘এ লেভেল’ হলে যে কোনো দুটি বিষয়ে প্রার্থীরা অংশ নিতে পারবেন। তবে এবার প্রথম বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, জিইডি ডিগ্রিধারীরা এতে অংশ নিতে পারবেন না। সিএএবি থেকে সিপিএল নেয়া অথবা সিএএবি কর্তৃপক্ষ থেকে এনডোজ করা ব্যক্তিরা প্রার্থী হতে পারবেন। এবার সার্কুলারে সিপিএলধারী এবং বি-৭৩৭ ও ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ চালানোর অভিজ্ঞদের এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালের ওই সার্কুলার দেয়ার কিছু দিন পর আবারও সংশোধন আনা হয়। সংশোধিত সার্কুলারে বলা হয়, বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি অথবা গণিত কিংবা পদার্থবিজ্ঞানে গ্রেড বি অথবা জিপিএ-৩প্রাপ্তরা যোগ্য হবেন। অভিযোগ উঠেছে, এই সার্কুলারের মাধ্যমে বিমানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা-পাইলটের ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রী সুবিধা পেয়েছেন। খোদ বিমানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার পাইলট ভাইয়ের সন্তান বেশি সুবিধা পেয়েছেন।
শুধু তা-ই নয়, সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে জিইডি ডিগ্রিধারীদের ব্যাপারে কোনো কিছুই বলা হয়নি। ফলে তারাও আবেদনের সুযোগ পেয়েছেন এবং লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। অনেকে পাসও করেছেন। তবে এখন তাদের বাদ দেয়ার জন্য বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনার ছক আঁকছেন কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে বিমানের এমডি বলেন, বিমানের এবারের সার্কুলারে কিছু ভুল ছিল, এ কারণে সংশোধন করা হয়েছে। জেনারেল এডুকেশন ডিগ্রিধারীদের (জিইডি) বিমানে পাইলট হিসেবে নেয়া যাবে না- এ রকম কোনো শর্ত অর্গানোগ্রামে নেই। তাহলে ২০১৬ সালে কেন ১২ জন জিইডিধারীকে লিখিত পরীক্ষায় সুযোগ দেয়া হয়নি- এর জবাবে তিনি বলেন, এটা দেখতে হবে।
এছাড়া বিজ্ঞপ্তিতে বোয়িং ৭৩৭ এবং ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ চালানোর অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের ক্ষেত্রে আবেদনের যোগ্যতা সর্বোচ্চ ৩০ বছরের (মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের ক্ষেত্রে ৩২ বছর) পরিবর্তে ৪০ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিমান এমডি বলেন, এখন বি৭৩৭ ও ড্যাস-৮ এর পাইলট সংকট আছে। নিয়োগের পর একজন প্রার্থীকে ঠিকঠাক করতে কমপক্ষে ২ বছর সময় লাগে। তাই সার্কুলারে অভিজ্ঞ প্রার্থীদের অগ্রাধিকার ও বয়সসীমা ৪০ বছর করা হয়েছে। এটা কোনো বৈষম্য তৈরি করবে না, অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী এটা করা যাবে।
এর আগে ড্যাশ-৮ এর জন্য ২৪ জন ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ করেও সঠিক সময়ে তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করতে পারেনি বিমান। অথচ এ প্রশিক্ষণ শেষ করতে সর্বোচ্চ ৭ মাস সময় লাগার কথা ছিল। সঠিক সময়ে পাইলট তৈরি না করে বিমান জরুরি ভিত্তিতে চড়া মূল্যে বেসরকারি একটি উড়োজাহাজ সংস্থা থেকে পাইলট ভাড়া করেছিল। বেসরকারি বিমান সংস্থা থেকে আনা ৫ জন পাইলটকে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে মাসে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দেয়া হতো। সেখানে বিমানের একজন নিজস্ব ফার্স্ট অফিসারের বেতন ২ লাখ টাকার বেশি নয়। এজন্য প্রতি মাসে বিমানকে অনেক টাকা গচ্চা দিতে হয়েছে।
এর আগে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একজনেরও প্রশিক্ষণ শেষ করতে না পারায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলেন। সে সময় জানতে চাইলে তিনি এই ব্যর্থতার সঠিক ব্যাখ্যাও দিতে পারেননি। বলেছেন, হয়ে যাবে খুব শিগগির। বেসরকারি এয়ারলাইন্স থেকে চড়া দামে পাইলট ভাড়া করা প্রসঙ্গে বিমান এমডি বুধবার বলেন, ফ্লাইট অপারেশন ঠিক রাখতে বিমানকে বাধ্য হয়ে পাইলট ভাড়া করতে হয়েছে। তিনি বলেন, পাইলট সংকটের কারণে এখন ড্রিমলাইনার দিয়ে লন্ডন রুটে ফ্লাইট চালানো যাচ্ছে না। ১৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে ৬টির পরিবর্তে ৪টি ফ্লাইট চালাতে হবে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী বলেন, সময় মতো পাইলট তৈরি করতে না পারায় বিমানকে বেসরকারি এয়ারলাইন্স থেকে পাইলট ভাড়া ও বিদেশি পাইলট নিয়োগ দিতে হচ্ছে চড়া দামে। এটা বিমানের ফ্লাইট অপারেশন শাখার চূড়ান্ত ব্যর্থতা। একজন ক্যাডেট পাইলটকে গ্রাউন্ড ট্রেনিং, সিমুলেটর ট্রেনিং ও রুট চেক করতে কিছুতেই ৭ মাসের বেশি সময় লাগে না। তার মতে, এবারও পাইলট নিয়োগ নিয়ে নানা অনিয়ম-অসংগতির অভিযোগ আছে বিমানের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, পাইলট হচ্ছে বিমানের প্রাণ। শত শত মানুষের জীবন ও হাজার কোটি টাকার এয়ারক্রাফট নিয়ে তাদের আকাশে পাড়ি দিতে হচ্ছে। কাজেই পাইলট নিয়োগে অবশ্যই বিমানকে স্বচ্ছ থাকতে হবে।

যুগান্তর

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।