শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৮:৩৫ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
„শাহজালালে মানব :  পাচারে  ম্যানপাওয়ারের ৯ সরকারি কর্মকর্তা ইমিগ্রেশন পুলিশ জড়িত : তদন্ত প্রতিবেদনে ভয়াবহ তথ্য : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তালিকাভুক্ত  সিএএবি-বিমান-বিভিন্ন এয়ার লাইন্সের শতাধিক  নিরাপত্তারক্ষী এখনও বিমানবন্দরে বহাল, এদের বদলি করা হয় না, কেউ কেউ চাকরির শুরু থেকেই বিমানবন্দরে, কিউআর জিন্নাহ চাকরির শুরু থেকেই ‘ জিয়া থেকে শাহজালালে কর্মরত

নিউজ ডেক্স : মানব পাচারে সহায়ক ভূমিকায় জড়িয়ে গেছেন খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-এর কর্মকর্তারা। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আরব আমিরাতে গমনেচ্ছু কর্মীদের নামে অবৈধভাবে অতিরিক্ত প্রায় ৪ হাজার বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু করেছেন বিএমইটির ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী। এভাবে আরব আমিরাত যাওয়াদের বেশির ভাগই দুবাই থেকে যায় লিবিয়ায়, সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে যায় ইউরোপ। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

শাহজালালে মানব পাচারে বহুমুখি সংস্থা জড়িত। এদের মধ্যে ইমিগ্রেশন পুলিশ, সিএএ-বিমান- বিভিন্ন এয়ার লাইন্সের তালিকাভুক্ত শতাধিক নিরাপত্তারক্ষী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এদের তালিকাভুক্ত করে শাহজালাল থেকে বিতাড়িত করার নির্দেশ দিলেও তা গত ৩ বছরেরও আমলে নেয়া হয়নি সিএএবি কর্তৃপক্ষ। এদের মধ্যে কিউআর জিন্নহ চাকরির শুরু থেকেই শাহজালালে কর্মরত, রহস্যজনক কারণে তাকে বদলি করা হয় না। মানব পাচার করে জিন্নাহ চুনোপুটি রথকে প্রায় কোটি টাকার  সম্পদ গড়ে তুলেছেন। রাজধানিতে তার একাধিক ফ্লাট-প্লট রয়েছে বলে জানা যায়। তার সহযোগি মিজান।

অভিযোগ আছে, বিএম্ইটির ওই ৯ কর্মকর্তার যোগসাজশে একেকটি স্মার্টকার্ডের জন্য লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিদেশগামীর কাছ থেকে। সাধারণভাবে বিএমইটির স্মার্টকার্ডই হলো বিদেশে কাজের জন্য যাওয়া বাংলাদেশিদের সরকারি স্বীকৃতি। বিদেশে কর্মস্থল ও কাজের ধরনসহ সব ধরনের তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর এই কার্ড দেয় বাংলাদেশ সরকার। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও তদন্ত কমিটির প্রধান মো. আবদুল করিমের জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিএমইটি কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির যোগসাজশে একটি অবৈধ, দুর্নীতিপরায়ণ সিন্ডিকেটে পরিণত হয়। সরাসরি জড়িতদের মধ্যে রয়েছেন- সিস্টেম এনালিস্ট মো. সাইদুল ইসলাম, বহির্গমন শাখার জনশক্তি জরিপ কর্মকর্তা মো. ইমারত হোসেন মোল্লা, বহির্গমন শাখার প্রধান সহকারী শামীমা ফেরদৌসী, বহির্গমন শাখার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. সাইফুল ইসলাম, বহির্গমন শাখার সহকারী পরিচালক শেলীনা আক্তার, সহকারী পরিচালক লিটন কান্তি চৌধুরী, উপপরিচালক (বহির্গমন) মো. আবুল কালাম আজাদ, পরিচালক (বহির্গমন) যুগ্মসচিব হাসান মাহমুদ, পরিচালক (বহির্গমন) উপসচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ভূঁইয়া। শাহজালালে ম্যানপাওয়ার ডেক্সের এডি, অফিসার মঈনুলসহ ১০-১২ জন জড়িত। এডি ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি ২০২২ সালের ১২ মে পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্মী নিয়োগের জন্যে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ও বিএমইটির স্মার্টকার্ড ইস্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে এই সময়ে অবৈধভাবে ৩ হাজার ৯৭৮টি স্মার্টকার্ড ইস্যুর তথ্য উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে রিক্রুটিং এজেন্সি মাহবুব ইন্টারন্যাশনালের নামে ৯৭১ কর্মীর অনুমোদন থাকলেও ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত বিএমইটি স্মার্টকার্ড ইস্যু হয়েছে ২ হাজার ১৯৪টি। অর্থাৎ মাহবুব ইন্টারন্যাশনালের নামে অবৈধভাবে জালিয়াতি করে স্মার্টকার্ড ইস্যু করা হয়েছে ১ হাজার ২২৩টি। এই জালিয়াতি করেছেন বিএমইটির মো. সাইদুল ইসলাম, মো. ইমারত হোসেন মোল্লা, শেলীনা আক্তার ও লিটন কান্তি চৌধুরী।

একইভাবে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের এজেন্সির ৪৩৫ জনের অনুমোদন থাকলেও স্মার্টকার্ড ইস্যু হয়েছে ১০১০ জনের। গত বছরে ৪ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত অবৈধভাবে এই ৫৭৫টি স্মার্টকার্ড ইস্যু করেছেন শেলীনা আক্তার, মো. ইমারত হোসেন মোল্লা ও মো. সাইদুল ইসলাম। রিক্রুটিং এজেন্সি হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের নামে ৫১টি অতিরিক্ত অবৈধ স্মার্টকার্ড ইস্যু করার জন্য তদন্ত কমিটির কাছে দায়ী হয়েছেন সাইদুল ইসলাম, ইমারত হোসেন মোল্লা, লিটন কান্তি চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, মিজানুর রহমান ভূঁইয়া। ডালাস ওভারসিজের নামে অবৈধভাবে অতিরিক্ত ৪৪৯টি স্মার্টকার্ড ইস্যু করেছেন সাইদুল ইসলাম, শামীমা ফেরদৌসী, ইমরাত হোসেন মোল্লা, সাইফুল ইসলাম, শেলীনা আক্তার, লিটন কান্তি চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ। আল মোবারক ইন্টারন্যাশনালের নামে অবৈধ অতিরিক্ত ৩১০টি স্মার্টকার্ড ইস্যু করেছেন সাইদুল ইসলাম, শামীমা ফেরদৌসী, ইমারত হোসেন মোল্লা ও আবুল কালাম আজাদ। আইডিয়া ইন্টারন্যাশনাল লি.এর নামে ৪৯৪টি অতিরিক্ত স্মার্টকার্ড ইস্যু করেছেন সাইদুল ইসলাম, শামীমা ফেরদৌসী, ইমারত হোসেন মোল্লা, শেলীনা আক্তার, আবুল কালাম আজাদ, হাসান মাহমুদ ও মিজানুর রহমান ভূঁইয়া। মেসার্স এম আক্তার অ্যান্ড সন্সের নামে অবৈধভাবে ২০৪টি স্মার্টকার্ড ইস্যু করেছেন সাইদুল ইসলাম, ইমারত হোসেন মোল্লা, শামীমা ফেরদৌসী, লিটন কান্তি চৌধুরী। আল ফাত্তাহ ইন্টারন্যাশনাল লি.-এর নামে অনুমোদনের বাইরে অতিরিক্ত ৬৭২টি অবৈধ স্মার্টকার্ড ইস্যু করেছেন সাইদুল ইসলাম, ইমারত হোসেন মোল্লা, লিটন কান্তি চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, মিজানুর রহমান ভূঁইয়া।

বিএমইটির এই সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট ৮টি রিক্রুটিং এজেন্সির মধ্যে ৬টিকে দোষী করা হয়েছে। কিন্তু ট্রেড ফেয়ার ইন্টারন্যাশনাল ও আইডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সম্পর্কে তদন্ত প্রতিবেদনে নথির যাচাই-বাছাই করে বলা হয়েছে, তারা এ বিষয়ে জড়িত নয় বলে প্রতীয়মান হয়। তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিএমইটিতে বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যুর ক্ষেত্রে ছয় ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এগুলো হলো- অতিরিক্ত বহির্গমন ছাড়পত্র অবৈধভাবে ইস্যু করা হয়েছে, সফটওয়্যার এর তথ্য এডিট বা ডিলিট করে নথিতে মিথ্যা তথ্য, ভুল তথ্য উপস্থাপন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের (মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পরিচালক-এর) অনুমোদন নিয়ে এবং অনুমোদন ছাড়া অবৈধভাবে বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যু করা হয়েছে, কোনো কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের অনুমোদনপ্রাপ্ত সব কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্র না নেওয়ায় অনুমোদনপ্রাপ্ত অনেকগুলো সংখ্যা ফাঁকা ছিল। ওই সব অনুমোদনপ্রাপ্ত ফাঁকা সংখ্যার বিপরীতে এবং অতিরিক্ত আরও বহির্গমন ছাড়পত্র ওই সব রিক্রুটিং এজেন্সির নামে অবৈধভাবে ইস্যু করা হয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো অবগত নয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তদন্ত কমিটি গত ৩০ মে দায়িত্ব পাওয়ার পর বিএমইটির ওয়েবসাইটের তথ্য সংগ্রহ করে। এতে অনিয়মের চিত্র ধরা পড়ে। পরে তদন্ত চলার খবর পেয়ে ওয়েবসাইটে তথ্য পরিবর্তন করা হয়। তদন্ত কমিটি ৬ জুলাই পুনরায় তথ্য সংগ্রহ করে এই পরিবর্তন দেখতে পায়। অর্থাৎ তদন্ত এড়াতে চেষ্টাও করে সংশ্লিষ্টরা। সার্ভারের এই তথ্য পরিবর্তনের একমাত্র ক্ষমতা সার্ভার এনালিস্টের কাছে থাকায়, বাকি সবাই তাদের সাক্ষ্যে দায় সার্ভার এনালিস্টের ওপর চাপিয়ে দেয়। বিএমইটি মহাপরিচালক শহীদুল আলম তদন্ত কমিটিকে দেওয়া বক্তব্যে বলেছেন, বিএমইটি মহাপরিচালকের কাছে আসার আগে এ ধরনের ফাইল পাঁচটি টেবিলে দেখা হয়। প্রথমত সার্ভারের দায়িত্বে রাজস্বের কোনো কর্মকর্তা নেই। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের কর্মকর্তারা পালাক্রমে সার্ভার দেখেন। সার্ভারের অ্যাডমিন ও পাসওয়ার্ড সিস্টেম এনালিস্ট দায়িত্বে থাকে। ইমিগ্রেশন দেখার জন্য একজন পরিচালক ও একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (বহির্গমন) দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অতিরিক্ত স্মার্টকার্ড ইস্যু করার বিষয়ে কোনো সভায় বা পৃথকভাবে মহাপরিচালকের নজরে আনা হয়নি। কেউ জানালে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করতাম।

 

 

 

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।