শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ১০:৫৫ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
সমকালের বিশ্লেষণ : জীবন ওলটপালট করে গেল ‘আগ্রাসী’ এপ্রিল : তাপপ্রবাহে জাপানে ৬৫ জনের মৃত্যুতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘোষণা করলেও বাংলাদেশে ৯৫ জনের মৃত্যুতে ভাবছে না কোন সংস্থা

ডেক্স রিপোর্ট : ছকে বাঁধা জীবনের অনেক কিছুই ওলটপালট করে অবশেষে ‘আগ্রাসী’ এপ্রিলের যবনিকা। তাপদাহে পোড়া মানুষ ‘অচেনা’ এই এপ্রিলকে মনে রাখবে বহুদিন। মাসজুড়ে দেশের ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটারেই ছিল মরুর উষ্ণতা। খরতাপ একে একে ভেঙেছে অতীতের অনেক রেকর্ড। জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে গেল ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া তাপপ্রবাহের এমন রুদ্ররূপ অনেকেই আগে দেখেনি।

এক মাসের প্রবল গরমে জীবন ও সম্পদের হয়ে গেছে বড় ক্ষতি। নিভে গেছে ৯৫ প্রাণ। বিপর্যয়ে পড়েছে কৃষি, নেমেছে পানির স্তর। বেঁকে গেছে রেলপথ, বিটুমিন উঠে এবড়োখেবড়ো সড়ক। অনেকটাই থমকে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। জীবিকা হারান কোটি মানুষ। কমিয়ে দিয়েছে উৎপাদন ক্ষমতা, বেড়েছে অর্থনীতির ঝুঁকি। দীর্ঘমেয়াদি হুমকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। গরমে শুধু যাতায়াত ভাড়াই নয়, নানা খাতে টাকা পকেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরমে যত মানুষের মৃত্যু হয়, এর পুরো ছবি আদতে উঠে আসে না। শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কমে, কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিদ্যুতের ওপর চাপ পড়ে। পরিসংখ্যানে এসব বিষয়ে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। সব মিলিয়ে তাপপ্রবাহ ধীরে ধীরে ‘নীরব ঘাতক’ হয়ে উঠছে। ফলে তাপপ্রবাহকে দ্রুত দুর্যোগ ঘোষণা করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ তাদের।
এপ্রিলের হেঁয়ালি আচরণ

এপ্রিলে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা থাকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এবার মাসজুড়েই গড়ে সারাদেশে তাপমাত্রা ছিল ৩৭ ডিগ্রির ওপর। গতকাল মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ১৯৮৯ সালের পর গেল ৩৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে তপ্ত দিন ছিল গতকাল। এর আগে ১৯৮৯ সালে বগুড়ায় ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা। চুয়াডাঙ্গায় এদিন থার্মোমিটারের পারদ ওঠে ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলিসিয়াসে। আর ঢাকায় তাপমাত্রা ওঠে ৩৮ দশমিক ৬ ডিগ্রিতে। এর আগে ২০১৪ সালের ২১ মে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা এতদিন দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল। মঙ্গলবার তা ভেঙে গেল। আর স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের নথিভুক্ত ইতিহাসের সর্বোচ্চ।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এবারের এপ্রিলে টানা যতদিন তাপপ্রবাহ হয়েছে, তা গত ৭৬ বছরে দেখা যায়নি। টানা তাপপ্রবাহ শুরু হয় ১ এপ্রিল থেকে। মঙ্গলবারও তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। ফলে ৩০ দিনই তাপপ্রবাহ দেখল বাংলাদেশ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে ১৯৮১ সাল থেকে সর্বোচ্চ তাপপ্রবাহের উপাত্ত আছে। সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর আগে ২০১০ সালে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ২০ দিন তাপপ্রবাহ ছিল।

তবে তা টানা ছিল না। এবার তাপপ্রবাহের বিস্তৃতিও ছিল বেশি। এ বছর দেশের ৭৫ শতাংশ এলাকা দিয়ে টানা তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে, যা আগে কখনোই ছিল না।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১৯৮১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বজ্রঝড়ের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবারের এপ্রিলে মাত্র একটি বজ্রঝড় বা কালবৈশাখী হয়েছে। তাও হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলে। আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা প্রকৃতির এ আচরণকে অস্বাভাবিক বলছেন। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ৪৩ বছরে এপ্রিলে ৩৬৫টি বড় বজ্রঝড় হয়। সবচেয়ে বেশি ঝড় হয়েছিল ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে, ১৪টি। আর ১৯৯৯ ও ২০০৯ সালের এপ্রিলে সবচেয়ে কম চারটি করে ঝড় হয়। গত বছরের এপ্রিলে বজ্রঝড় হয়েছিল সাতটি। ২০২২ ও ২০২১ সালে হয় যথাক্রমে ৯টি ও ৮টি।

আবহাওয়াবিদ মো. তরিফুল নেওয়াজ কবির বলেন, অন্য বছর সাধারণত এপ্রিলে গড়ে আট দিন বৃষ্টি হয়। এ বছর ছিল ব্যতিক্রম। আবহাওয়া ও জলবায়ুর স্থানীয় ও বৈশ্বিক বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন এবং উষ্ণায়নের কারণেই এমনটা হচ্ছে। এর ছোঁয়া বাংলাদেশের জলবায়ুতেও লেগেছে। যে বছরগুলোতে এল নিনো সচল থাকে, সে বছর তাপমাত্রা বাড়ে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, এ রকম তাপমাত্রা অবস্থা আরও কয়েক দিন চলবে। তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রির আশপাশে বা এর বেশিও হতে পারে। বৃষ্টির কারণে ২ থেকে ৭ মের ভেতর তাপমাত্রা কমে আসবে। এ সময় পুরো দেশেই বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

এত মৃত্যু, তবু দুর্যোগের স্বীকৃতি নেই : গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে হিট স্ট্রোক ও গরমজনিত রোগে মারা গেছেন ৯৫ জন। তবে গত ৩০ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে ৯ দিনে সারাদেশে হিট স্ট্রোকে ১১ জনের মৃত্যুর তথ্য জানানো হয়েছে। গত ২২ এপ্রিল থেকে সারাদেশের হাসপাতালে হিট স্ট্রোকের রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এদিকে সমকাল প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, গতকাল গরমে অসুস্থ হয়ে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। নাটোরেই ২৪ ঘণ্টায় মারা যান তিনজন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুধু হাসপাতালের তথ্য নিচ্ছে। অনেক মানুষ হাসপাতালে আসার আগেই মারা যাচ্ছেন। অনেক মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমেও আসেনি। মৃত্যু ও অসুস্থতার সঠিক তথ্যভান্ডার থাকা উচিত।

২০১৮ সালে জাপানে ৬৫ জনের মৃত্যুর পর তাপপ্রবাহকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘোষণা করে দেশটি। কিন্তু বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো তাপপ্রবাহ নিয়ে আলাদা পরিকল্পনা, নীতি ও বাজেট করেনি। সচেতনতা ছাড়া মানবিক সহায়তায়ও এগিয়ে আসেনি কোনো সংস্থা।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বলছে, ২১ জেলার অধিবাসীরা তাপপ্রবাহের উচ্চঝুঁকিতে রয়েছেন। দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ সবচেয়ে কষ্ট ও বিপদে আছেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান বলেন, এ সময় বিপদগ্রস্ত মানুষের জন্য সহায়তা দরকার। আমরা আপাতত মানুষকে সচেতন করছি। তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণা করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে। আমরা সেই প্রক্রিয়ায় হাঁটছি।

বড় অর্থনৈতিক ক্ষতি

টানা তাপপ্রবাহে দেশের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব পড়েছে। এমন কোনো খাত নেই, যেখানে গরমের আঁচ লাগেনি। বিশেষ করে কৃষি, পোলট্রি ও ডেইরি খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। ফসলের উৎপাদন ব্যাহতের শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, অতি তাপমাত্রার কারণে বোরো ধানের পরাগায়ন বিঘ্নিত হওয়ায় ধানে কমপক্ষে ১০ শতাংশ চিটা হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া প্রধান রবি ফসল মুগডালের উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। অন্য ফসলের উৎপাদন নিয়েও কৃষকরা দুশ্চিন্তায়। বিশেষ করে আম ২০ শতাংশ ও লিচুর উৎপাদন ২৫ শতাংশ কম হওয়ার শঙ্কা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও তাপপ্রবাহে কৃষিতে ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব এখনও তৈরি হয়নি বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস।

বাংলাদেশ এগ্রি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সভাপতি এ কে এম নাজিব উল্লাহ বলেন, গরমে সারাদেশে কৃষিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের ফোন পাচ্ছি আমরা। সেচ খরচ বেড়ে গেছে। ৫ মে আমচাষিদের অবস্থা দেখতে আমরা রাজশাহী যাব। সারাদেশের কৃষকের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে আমরা এ বিষয়ে চূড়ান্ত হিসাব তুলে ধরব।
বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানায়, গত ১৫ দিনে দেশে ১৫ লাখের বেশি ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি মুরগি মারা গেছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ছিল ব্রয়লার মুরগি। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকার মতো।

এদিকে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) হিসাবে ১৫ দিনে তীব্র গরম, লোডশেডিং ও বাদলা রোগে তিন হাজার গরু মারা গেছে। এক হাজারের বেশি গাভির সাত-আট মাসে গর্ভপাত হয়ে গেছে। গরু সুস্থ রাখতে খামারের খরচ বেড়েছে অন্তত ২০ শতাংশ। ৯৯ শতাংশের বেশি পশুর ওজন কমেছে ৩০ থেকে ৭০ কেজি পর্যন্ত। প্রতিটি গাভি থেকে দুধ উৎপাদন কমেছে ২০-২৫ শতাংশ। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। শুধু দুধে ক্ষতি হয়েছে আট হাজার কোটি টাকারও বেশি। ১৫ দিনে ১ লাখ ৪৫ হাজার টন দুধ কম উৎপাদন হয়েছে।

যশোর জেলা হ্যাচারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুর রহমান গোলদার বলেন, যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা। কয়েক দিনেই ক্ষতি হয়েছে ২০ কোটি টাকা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছরে তাপপ্রবাহের কারণে ঢাকা নগর ৬০ হাজার কোটি টাকার শ্রম উৎপাদনশীলতা হারাচ্ছে। এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটার্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আবহাওয়ার এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে প্রতিবছর ৩ হাজার ২০০ কোটি কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে দেশ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, গরমের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়টি আমাদের জন্য এক নতুন উপলব্ধি হয়ে আসছে। যে পরিমাণ উন্নতি হচ্ছে, তার একটি অংশ উল্টো অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ অবস্থায় ক্ষতি কমিয়ে আনতে পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের ওপর জোর দিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।