রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০১:৩৯ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ডিসি কাস্টমস জাহিদুল : গর্ভধারিণী মায়ের সঙ্গেও প্রতারনা

একুশে বার্তা ডেক্স : কাস্টমসের উপকমিশনার জাহিদুল ইসলাম হাই গত ৭ বছরের ব্যবধানে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। নামে-বেনামে এ সব সম্পত্তি মালিক হয়েছেন  তিনি। দুদক তাকে হাতের নাগালে পেয়েও ছাড় দিচ্ছে।  ডিসি জাহিদুল তার পরিবারের আপনজনদের সাথেও প্রতারনা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। তার মার থেকে প্রতারনা করে জমি লিখে নিয়েছেন। আপন ভাইকে জেলের ভাত খাইয়েছেন।  কাস্টমসের ভ্যাট কমিশনারেটের  ভ্যাট সার্কেল-৯  থেকে এই গুণধর ডিসিকে  বদলি করা হয়েছে।

অনুসন্ধ্যানে জানা গেছে , এই কর্মকর্তা ২০১১ সালের ১ আগস্ট বিসিএস ক্যাডারে যোগ দেন। মাত্র ছয় বছরেই ৭২টি দলিলের মাধ্যমে নিজ এলাকা পাবনায় ২০০ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন তিনি। এমনকি মায়ের নামে থাকা সম্পত্তি বাগিয়ে নিতে তিনি নিজের ভাইকে জেল পর্যন্ত খাটিয়েছেন।

জাহিদুল পাবনার ভাঙ্গুরা এলাকার মৃত রিয়াজুল ইসলামের ছেলে। এলাকায় কারো জমি বিক্রি করার দরকার পড়লে এখন তাঁর কাছেই যায় সবার আগে। কেননা অন্য যে কারো চেয়ে বেশি দাম দিয়ে হলেও তা কিনে রাখেন জাহিদুল। এত টাকা তিনি কোথায় পান?

সূত্রে জানা গেছে, সিনিয়র সহকারী কমিশনার হিসেবে কুমিল্লায় দায়িত্ব পালন করার সময় একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ দিয়ে তাদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ নিয়েছেন জাহিদুল। দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি মাঠপর্যায় থেকে তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাবনার ভাঙ্গুরা উপজেলার ভাঙ্গুরা, মাগুরা, মেন্দা, চৌবাড়িয়া ও ভবানীপুর মৌজার পাশাপাশি সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ায়ও জমি রয়েছে জাহিদুলের। স্থানীয়ভাবে ওই জমির বিঘাপ্রতি দাম সাড়ে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা। তবে রাস্তার পাশে হলে বিঘা ২০-৩০ লাখ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে থাকেন কাস্টমস কর্মকর্তা জাহিদুল। মাসে ৬০ হাজার টাকার মতো বেতন পান তিনি। বাড়িভাড়া, সন্তানদের পেছনে খরচ এবং অন্যান্য ব্যয় মিটিয়ে বাকিটা সঞ্চয় করলেও ছয় বছরে এত বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়া সম্ভব নয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পৈতৃক সূত্রে মাত্র ১৫ বিঘা জমি পেয়েছিলেন জাহিদুল। কাস্টমসে চাকরি পাওয়ার সময় জাহিদুলের ব্যাংক হিসাবে ছিল মাত্র ১১ হাজার টাকা। অথচ ছয় বছরের মধ্যে প্রায় ২০০ বিঘা জমি কিনেছেন  তিনি। নিজের পাশাপাশি স্ত্রী জুয়েলি খাতুন রুলি, শ্বশুর আলাউদ্দিন, স্ত্রীর বড় ভাই রফিকুল ইসলাম, ভাগ্নে সাহিদুর রহমান সাগরসহ বিভিন্নজনের নামে কেনা হয়েছে এসব জমি।

নথিতে দেখা গেছে, চাকরিতে যোগদানের এক বছর পর ২০১২ সালে ২৬৬৭, ২৫০৬ ও ১৯৩১ নম্বরের তিনটি দলিলে প্রায় সাত বিঘা জমি (২০৮ শতাংশ) কেনেন জাহিদুল। এরপর ৬৪৮, ১৯৩৮, ১৫৫৩, ৮৬, ১০৭৭, ১০৭৮, ১১৯২, ২৪৩৫ ও ১৫৩৯ নম্বর দলিলসহ নামে-বেনামে ওইসব জমির মালিক হয়েছেন তিনি।

তা ছাড়া নিজের তিন ভাই ও পাঁচ বোনের কাছ থেকে ৩৪টি দলিলের মাধ্যমে ২৮ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন জাহিদুল। রাজস্ব ফাঁকি দিতে এবং ঘুষের কালো টাকা সাদা করতে ভাই-বোনদের কাছ থেকে কেনা জমির হেবানামা (দানস্বত্ব) দলিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁর তিন ভাই।

জাহিদুলের এক ভাই সাইফুল ইসলাম  বলেন, ‘উপযুক্ত মূল্য পেয়েই ভাইয়ের কাছে আমরা জমি বিক্রি করেছি। ঘুষের টাকা সাদা করতে এবং রাজস্ব না দিতে হেবানামা দলিলে জমি কিনেছে জাহিদুল।’

জাহিদুলকে জমি কিনে দিয়েছেন এমন একজন বলেন, ‘শুধু পাবনা আর সিরাজগঞ্জই নয়, ঢাকার উত্তরা, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে জমি কিনেছেন জাহিদুল।

জাহিদুলের ঘুষের টাকায় শ্বশুরও কোটিপতি : জাহিদুলের শ্বশুর আলাউদ্দিনের বাড়ি চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে। স্কুলে শিক্ষকতা করে সংসারের চাকা সচল রাখতে হিমশিম খেতে হতো তাঁকে। কিন্তু জামাতার কল্যাণে রাতারাতি বদলে গেছে তাঁর জীবনও। তিনিও এখন কোটিপতি। তিনিও নিজের নামের পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে জমি কিনেছেন।

শ্বশুরের চেয়ে এগিয়ে ভাগ্নে : তবে জাহিদুলের অবৈধ অর্থে শ্বশুরের চেয়েও ‘বর্ণাঢ্য’ জীবন তাঁর (জাহিদুল) ভাগ্নে সাহিদুর রহমান সাগরের। জাহিদুলের মেজ বোনের ছেলে সাগর। বলতে গেলে এই ভাগ্নেই জাহিদুলের ডান হাত। এলাকার কোথায় জমি বিক্রি হবে, তার খোঁজ রাখেন সাগর। কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়ে গেলে জাহিদুল টাকা পাঠান। আর সেই টাকা হস্তান্তর করেন সাগর।

জানা গেছে, মামার দেওয়া অর্থে ঢাকা, পাবনা, সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় জমি কিনেছেন এই সাগর। এলাকাবাসী জানায়, মামার বদৌলতে সাগরও এখন কোটি টাকার মালিক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাহিদুল ইসলাম সাগর বলেন, ‘আমি মামার টাকায় মামার নামে জমি কিনে দিই, তাতে আপনার সমস্যা কি? আমি কি ভাগ্নে হয়ে মামাকে সাহায্য করতে পারি না।’

আপনার নামেও নাকি জমি কিনে দিয়েছেন আপনার মামা—এ প্রশ্ন শুনেই সাগর বলেন, ‘আমি এখন জরুরি কাজে ব্যস্ত আছি, পরে কল দেন।’ এরপর মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।

জালিয়াতি করে মায়ের জমিও লিখে নিয়েছেন জাহিদুল : অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতারণার মাধ্যমে জমি লিখে নেওয়ার অভিযোগে জাহিদুলের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন তাঁরই বৃদ্ধ মা সামছুন্নাহার। পাবনার ভাঙ্গুড়া সহকারী জজ আদালতে ওই মামলা হওয়ার পর মাকে সহযোগিতার অভিযোগে ছোট ভাই আশরাফুল ইসলামের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেন জাহিদুল। ওই মামলায় আশরাফুলকে জেলও খাটিয়েছেন তিনি। এমনকি ক্যাডার দিয়ে বৃদ্ধ মাকে তুলে নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজের নামে হওয়া মামলাটি প্রত্যাহার করিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ সামছুন্নাহারের অন্য সন্তানদের। জাহিদুলের মা সামছুন্নাহার এখন শয্যাশায়ী।

জাহিদুলের ছোট ভাই আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘মা যে মামলা করেছিল সেই মামলায় মাকে সঙ্গে নিয়ে সাক্ষ্য দিতে যাওয়ার সময় আমাকে ডিবি পুলিশ দিয়ে পাবনা কোর্ট চত্বরে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায় জাহিদুল। সে কাস্টমস কর্মকর্তা হওয়ায় তার ঘনিষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা দিয়ে আমাকে কয়েকটি মামলায় জেল খাটায়। এখন সব আল্লাহর কাছে ছেড়ে দিয়েছি। একদিন তার বিচার হবেই।’

এলাকায় সরেজমিনে গেলে জাহিদুলের মেজ ভাই সাইফুল ইসলাম  বলেন, ‘গোপনে আমার মায়ের সম্পত্তি লিখে নিয়েছে ছোট ভাই জাহিদুল। আমাদের ভাই-বোনদের বঞ্চিত করে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের বিশাল মার্কেটসহ জমি জালিয়াতি করে হাতিয়ে নিয়েছে। তার ভয়ে আমরা এখন মুখ খুলতেও পারি না।’

যাদের কাছ থেকে জমি কেনা হয়েছে : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভাঙ্গুরা উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের ভবানীপুর মৌজায় শফিকুল ইসলাম মেম্বার ও তাঁর স্বজনদের কাছ থেকে সাড়ে ছয় বিঘা জমি ৮৫ লাখ টাকায় কেনেন জাহিদুল। জমিটি নিজের নামে দলিল না করে স্ত্রীর বড় ভাই রফিকুল ইসলামের নামে দলিল করেছেন।

এ বিষয়ে জমির মালিক সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিক্রি করা জমি নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না, আবার কোন ঝামেলায় পড়ি।’

ভবানীপুর গ্রামের মুকুল  জানান, জাহিদুলের কাছে তাঁর ভাই জমি বিক্রি করেছে। প্রায় ২৩ শতাংশ জমি ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। জাহিদুল নিজেই উপস্থিত থেকে তাঁর নামেই এই জমি কিনে নেন।

চরভাঙ্গুরা গ্রামের জোত্স্না বেগম জানান, তাঁর প্রায় এক বিঘা জমি কেনার জন্য প্রথমে জাহিদুল মোবাইল ফোনে দরদাম করেন। পরে তাঁর বোনের জামাই বাবলু জমি কেনার সময় উপস্থিত ছিলেন। ওই জমি জাহিদুলের স্ত্রীর নামে দলিল করা হয়। তবে একজন মুহুরীর মাধ্যমে টাকা দেন জাহিদুল। বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামেই জমিটি তিনি কিনে নিয়েছেন। জোত্স্না বেগম আরো বলেন, ‘শুধু আমার জমিই নয়, গ্রামের অনেকের জমিই হাই কিনে নিচ্ছে।’

ভবানীপুর গ্রামের আবুল কালাম জানান, তিনিসহ তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে প্রায় দেড় বিঘা জমি কিনে নেন জাহিদুল। বিঘাপ্রতি চার লাখ টাকায় এসব জমি কিনে নিয়েছেন। জাহিদুলের নামে এই জমি কেনা হলেও টাকা-পয়সা লেনদেন করেন তাঁর ভাগ্নে সাগর।

এ ছাড়া ভবানীপুর গ্রামের আব্দুর রহিমের কাছ থেকে চার লাখ ২০ হাজার টাকা বিঘা দরে দেড় বিঘা এবং আব্দুর রউফের কাছ থেকে সাড়ে ১০ লাখ টাকায় প্রায় ১০ শতাংশ বাড়ির জমি কিনেছেন জাহিদুল। এই ভবানীপুর মৌজার বাসিন্দা রফিকুল ইসলামের কাছ থেকে ৩১ শতাংশ জমি জাহিদুল তাঁর স্ত্রীর বড় ভাই রফিকুল ইসলামের নামে কিনে দেন।

জাহিদুলকে একাধিক স্থানে ১৭ থেকে ১৮ বিঘা জমি কিনে দিয়েছেন তাঁদের গ্রামের মজনু। তবে মজনুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

ভাঙ্গুরা গ্রামের ডা. জাফরের ছেলে বুলবুল ও খাজা এবং ওয়াব মেম্বার ও তোরাব মেম্বার; হানিফ সর্দারের ছেলে রেজাউল, ময়দান হাজির জামাতাসহ অনেকের কাছ থেকেই জমি কিনেছেন জাহিদুল।

তা ছাড়া এলাকাবাসীর দাবি, মাগুরা গ্রামেই ৫০ থেকে ৬০ বিঘা জমি কিনেছেন জাহিদুল।

জাহিদুলের টাকার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে ভবানীপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব মিজানুর রহমান বলেন, ‘কাস্টমসের চাকরি যেন আলাদিনের চেরাগ। মাস গেলেই লাখ লাখ টাকা আয় করছেন। আর এই গ্রাম ওই গ্রামে জমি কিনছেন। শুনতাছি ঢাকায়ও নাকি অনেক সম্পত্তির মালিক হইছে।’

জাহিদুলের বক্তব্য : বিপুল জমি, বিশেষ করে ভাই-বোনদের কাছ থেকেও জমি কেনার ব্যাপারে জানতে চাইলে জাহিদুল দাবি করেন, তাঁর ভাইয়েরা তাঁকে জমি দান করেছেন।

কিন্তু আপনার ভাইয়েরা যে বলছে টাকার বিনিময়ে জমি বিক্রি করেছেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে জাহিদুল কোনো জবাব না দিয়ে আরো বলেন, ‘ভাই এগুলো নিয়ে কেন আপনি ঘাঁটাঘাঁটি করছেন।’

স্ত্রীর নামে জমি কেনা প্রসঙ্গে জাহিদুল বলেন, ‘আমার স্ত্রীর নিজস্ব মাছের ঘেরসহ বিভিন্ন ব্যবসা আছে। তাঁর টাকায় সে কিনেছে।’

কিন্তু বিয়ের আগে তো আপনার স্ত্রীর কোনো ব্যবসাও ছিল না। এমনকি আপনার শ্বশুর একজন সাধারণ শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তিনি টাকা পেলেন কোথা থেকে? এ প্রশ্নে জাহিদুল কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

স্ত্রীর ভাইয়ের নামে জমি কেনার কথা অস্বীকার করে জাহিদুল বলেন, ‘আমি কেন তাঁদের নামে জমি কিনব? আমার স্ত্রীর ভাই একজন কানাডা প্রবাসী। তাঁর টাকায় তাঁরা জমি কিনছেন।’

আর মায়ের জমি জালিয়াতি করে নেওয়া বিষয়ে জানতে চাইলে জাহিদুল প্রথমে অস্বীকার করেন। পরে আবার তিনি দাবি করেন, ‘আমি মায়ের জমি লিখে নিইনি। মা খুশি হয়ে আমাকে লিখে দিয়েছেন।’

তাহলে আপনার মা কেন আপনার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন—এ প্রশ্নে জাহিদুল বলেন, ‘আসলে কি মাকে ভুল বুঝিয়ে আমার অন্য ভাইয়েরা মামলাটি করিয়েছে। সেই মামলাটি শেষ পর্যন্ত মা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।’

ছোট ভাইকে ‘মিথ্যা’ মামলা দিয়ে হয়রানি এবং মাকে তুলে নিয়ে নিজের নামে হওয়া মামলা প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জাহিদুল বলেন, ‘আমি ভাইদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করিনি। তাদের অপকর্মের কারণেই মামলা হয়েছে। কালের কন্ঠ

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।