মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:১৯ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
সিভিল এভিয়েশন উপপরিচালক (প্রশাসন) টু বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তয়-৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারি : পদোন্নতি পেয়েও পদাবনতি পদে দিব্যি চাকরি করছেন! বদলি না থাকায় ঘাঁটি গেড়ে দুর্নীতি : অভিন্ন নীতি জরুরি

একুশে বার্তা ডেক্স : বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ  সিভিল এভিয়েশনের উপপরিচালক পদ এবং জনপ্রশাসনসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত  নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারিদের চাকরিজীবনে বদলি না থাকায় এসব কর্মকর্তারা ঘাটি গেড়ে দুর্নীতিতে পাকাহস্ত বলে অভিযোগ ওঠেছে। অনেকে এসব পদে চাকরিকে নিজের বাড়ি বলে মনে করছেন আর অন্যরা সব ভাড়াটিয়া।

সিএএবির উপপরিচালক (প্রশাসন) পদে কর্মরত ব্যক্তিও কম যান না। তিনি এ পদে বসে নিয়োগ,বদলি, সংযুক্তি , টেন্ডার,  হজ্ব বাণিজ্র করে আংগুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে গোয়েন্দা রিপোর্ট গায়েব হয়েছে বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। তিনি গত বছর নিজে হজ্ব গাইড হিসেবে হজ্ব করে এসেছেন আর সরকারি থেকে পেয়েছেন প্রায় ১৫ লাখ। এ যেন রথ দেখাও হলো কলা বেচাও হল। চাকরিজীবনে বদলি না থাকায় তিনি অনেকটাই বেপোরোয়া। ইতিমধ্যেই কাওলার কবরস্থানের পাশে ১০ কাঠা জায়গার ওপর ১০ তলা বাড়ি নির্মাণাধীণ। দুদক এ ব্যাপারে নজর রাখছে। তবে দুদকের ৪৫ জনের তালিকায় ডিডি প্রশাসনের নাম নেই।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে স্টেনোগ্রাফার হিসেবে শওকত ওসমান চাকরিজীবন শুরু করেন ২২ বছর আগে। এখনো তিনি একই মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। দুই দশকের মধ্যে তাঁকে নিজের মন্ত্রণালয়ের অন্য কোথাও আর বদলি হতে হয়নি। তিনি কাজ করছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগে (এপিডি উইং)। বছর দুয়েক আগে শওকত ওসমান সহকারী সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী তখন তাঁকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছিল। সেই বদলি ঠেকিয়ে তিনি এখনো এপিডি উইংয়েই আছেন। গত দুই দশকে শওকত ওসমান তাঁর অবস্থান এমনভাবে পোক্ত করেছেন যে পদোন্নতি পেয়েও নিচের পদ অর্থাৎ ব্যক্তিগত কর্মকর্তার (পিও) পদে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শওকত সাহেব এই জায়গার পার্মান্যান্ট লোক। সচিব, অতিরিক্ত সচিবরা বদলি হন, কিন্তু তাঁকে কেউ বদলি করতে পারেন না।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিক্যাল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন ও অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের গাড়িচালক আব্দুল মালেকের কোটি কোটি টাকার সম্পদের খবর গণমাধ্যমে বের হওয়ার পর জানা গেছে, দুজনই যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে বছরের পর বছর ধরে অফিস সহকারী পদে কাজ করেছেন আব্দুর রহিম। এ সময় তাঁর বিরুদ্ধে দুইবার দুর্নীতির অভিযোগ যায় দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এখনো তিনি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন।

শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা ভূমি অফিসেই নয়, কেন্দ্র থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়—সর্বত্রই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দুর্নীতির খবর প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হয়ে কিভাবে শতকোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছেন এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, সরকারের বিদ্যমান কাঠামোতেই এমন দুর্নীতি করার সুযোগ রয়েছে। কারণ, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বদলির কোনো ব্যবস্থা নেই। যে মন্ত্রণালয়ে চাকরিজীবন শুরু করেন, সেখান থেকেই চাকরিজীবন শেষ করেন তাঁরা। ফলে ওই মন্ত্রণালয়ের সব ফাঁকফোকর নখদর্পণে থাকে ওই কর্মচারীদের।

অবশ্য গত বছর জুলাই-আগস্টে রীতিমতো বদলির হিড়িক পড়েছিল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার পর গত ৪৬ বছরে এত বড় আকারে বদলি হয়নি সরকারের উন্নয়ন দর্শন তৈরির দায়িত্বে থাকা এই মন্ত্রণালয়ে। ১৭ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের ১০৪ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছিল এক শাখা থেকে আরেক শাখায়।

জানা গেছে, বদলি হওয়া ১০৪ কর্মকর্তার মধ্যে অনেকেই চাকরিজীবন যে শাখায় শুরু করেছিলেন, বদলি হওয়ার আগ পর্যন্ত সেই শাখায় ছিলেন। কোনো কোনো কর্মকর্তা ১০ বছর, কেউ ১৫ বছর একই চেয়ারে ছিলেন।

মন্ত্রণালয়ের সচিব কিংবা কোনো সংস্থার মহাপরিচালক কেন কর্মচারীদের এক শাখা থেকে আরেক শাখায় বদলি করেন না এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, যদি সচিব কিংবা মহাপরিচালক দুর্নীতিবাজ হন, তিনি কর্মচারীকে বদলি করবেন না—এটাই স্বাভাবিক। আবার সচিব কিংবা মহাপরিচালক দুর্নীতিবাজ নন, কিন্তু মেরুদণ্ডহীন বা চেয়ার আঁকড়ে থাকার বাসনা থাকে, সে জন্যও তিনি কর্মচারীদের ঘাঁটাতে যান না। কর্মচারীদের দুর্নীতি দেখেও না দেখার ভান করেন। তার ওপর অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠনের চাপ তো রয়েছেই।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, প্রথম গ্রেড থেকে নবম গ্রেডের একজন সরকারি কর্মকর্তা কোনো একটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগে সর্বোচ্চ তিন বছর থাকার নিয়ম। তিন বছর হয়ে গেলে তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হয়। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের কারণে কিংবা তদবির করে কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের তিন বছরের বেশি থাকতে দেখা যায়। একজন কর্মকর্তা তিন বছরের বেশি সময় থাকলে আধিপত্য তৈরি করতে পারেন, অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে পারেন—এমন আশঙ্কা থাকে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে কর্মকর্তাদের সরকারি কোনো দপ্তরে তিন বছরের বেশি থাকতে দেওয়া হয় না। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারী যে মন্ত্রণালয়ে চাকরিতে প্রবেশ করেন, চাকরিজীবন শেষ করেন একই মন্ত্রণালয় থেকে। এই দুই শ্রেণির একজন কর্মচারী গড়ে ৩০ বছর চাকরি করেন। চাকরিজীবনে বদলি বাণিজ্য থেকে শুরু করে এমন কোনো ফাঁকফোকর নেই যে ওই কর্মচারী জানেন না। তাঁদের এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে বদলির কোনো সুযোগ নেই। ফলে অনিয়ম করার সুযোগ তৈরি হয়।

সরকারের বর্তমান ও সাবেক অন্তত পাঁচ সচিবের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে তাঁরা নিজেরাও স্বীকার করেন যে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বদলি না হওয়া একটি দুর্বলতা। এতে দুর্নীতি করার অফুরন্ত সুযোগ তৈরি হয়। তাঁরা বলছেন, একজন সচিব চাইলে তাঁর মন্ত্রণালয়ের অধীন যত অধিদপ্তর বা সংস্থা আছে কর্মচারীদের সেখানে বদলি করতে পারেন। কিন্তু সেটিও করা হয় না।

জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র সচিব নূরুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে বদলি করার সুযোগ আছে। সেটি করা হয় কি না সেটা দেখার বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে করা হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে বদলি করা হয় না।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে বদলির বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিভিন্ন সময় আলোচনা হয়েছিল। এমনকি তাঁদের বদলির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কর্মচারীদের প্রতিবাদের মুখে তা আর করা হয়নি। কর্মচারীদের বক্তব্য ছিল, তাঁরা কম বেতন পান। পরিবার নিয়ে কোনোমতে সংসার পরিচালনা করতে হয়। যদি বদলি করা হয়, তাহলে তাঁদের খরচ বেড়ে যাবে। যে টাকা বেতন পান, তা দিয়ে সংসার চলবে না।

জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে বদলির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কর্মচারীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সেটি আর অগ্রসর হয়নি।’

প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিয়োগবিধি সংশোধন করে কর্মচারীদের বদলির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এটি কোনো আইন নয় যে মন্ত্রিসভা এবং সংসদে যাওয়ার দরকার আছে। মন্ত্রণালয় চাইলে পরিবর্তন করতে পারে।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিম্নমান সহকারী, সাঁটলিপিকার, এমএলএসএস, ডেসপাস রাইটার বা অফিস সহকারী পদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নিয়োগবিধি রয়েছে। যার একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। অভিন্ন নিয়োগবিধির উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি কার্যকর হয়নি এখনো।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।