বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৪:৪৪ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
স্বাধীন এবং উদার সাংবাদিকতার প্রস্থান

আমীর খসরু: বিশ্ব বরেণ্য চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কির একটি তত্ত্ব বিশ্বজুড়ে বিকল্প চিন্তার জগতে বেশ আলোচিত এবং সমাদৃত। তত্ত্বটির নাম হচ্ছে ‘ম্যানুফেকচারিং কনসেন্ট’ বা সম্মতি জ্ঞাপনে পদ্ধতিগত ব্যবস্থা গ্রহণ বা আপনাকে এমন এক ব্যবস্থার মুখোমুখি করা হবে- যেখানে আপনি আপনা-আপনি সম্মতি জ্ঞাপনে বাধ্য হবেন অথবা প্রোপাগান্ডার বদৌলতে যা বলা হচ্ছে তা বিশ্বাস করবেন। এ কারণে ম্যানুফেকচারিং কনসেন্ট বা সম্মতি নির্মাণ অথবা আদায়ের পদ্ধতিটি যে কোনো জনবিরোধী কর্মকা-ে অভ্যস্ত অগণতান্ত্রিক অথবা তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসক ও সরকারগুলো গ্রহণ করে থাকে। নোয়াম চমস্কির গ্রন্থ ম্যানুফেকচারিং কনসেন্ট: দ্য পলিটিক্যাল ইকনোমি অব দ্য মাস মিডিয়া, ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এ গ্রন্থ ছাড়াও একই তত্ত্ব নিয়ে নোয়াম চমস্কি বিস্তর লেখালেখি ও আলোচনা করেছেন। নোয়াম চমস্কি বলছেন, সংবাদমাধ্যম এ সম্মতি জ্ঞাপন পদ্ধতি বা নির্মাণের কাজে বেশি মাত্রায় ব্যবহৃত হয় এবং এ সমস্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যম হয়ে ওঠে সংবাদমাধ্যম বা গণমাধ্যম। চমস্কি নানা বিশ্লেষণের পরে বলছেন, সংবাদমাধ্যম কার্যকরভাবে, প্রাতিষ্ঠানিক মোড়কে সরকার, শাসক ও এর সমর্থক তথাকথিত এলিট শ্রেণির হয়ে প্রোপাগান্ডাকে সমর্থন করে।

সংবাদমাধ্যম এভাবেই গণতন্ত্রের যে মূল্যবান জনস্বার্থের দিকটি তার বিপক্ষে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। চমস্কি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, সংবাদমাধ্যম তার পাঠক বা দর্শকশ্রোতাদের কথা বাদ দিয়ে শাসক, করপোরেট স্বার্থ এবং ওই গোষ্ঠীর বিশেষ স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়।

সংবাদমাধ্যম সরকার ও দেশের নিয়ন্ত্রক শ্রেণির স্বার্থে এমন কিছু সামাজিক নিয়মাবলী ও আচারণ তৈরি করে- যাতে মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। নোয়াম চমস্কির পুরো বইটিতে নানা বিষয় উঠে এসেছে। তিনি বলছেন, সংবাদমাধ্যম এমন খবরই ছাপে এবং তালাশ করে যা ক্ষমতাবান শ্রেণিটির পক্ষে শেষ-মেষ কাজ করে। এমনকি এমন বিশ্লেষকমন্ডলীর বক্তব্য দেয়া হয়- যাতে ক্ষমতাধর শ্রেণিটিরই লাভ হয়। আর এই ক্ষমতাধর শ্রেণীটিই কার্যত: সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে।

চমস্কি সব সময় এমবেডেড সাংবাদিকতার বিরোধিতা করছেন। ১৯৯১ সালে গালফ ওয়ার এবং ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান দখলের সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও এর সেনাবাহিনী ওই দেশটির জনগণের চাপের মুখে পড়েছিল। এ কারণে ২০০৩ সালে ইরাক দখলের সময় নতুন এক অপ-সাংবাদিকতার সূচনা হয়, যার নাম এমবেডেড জার্নালিজম। বিভিন্ন পন্ডিত ও সমালোচক এই এমবেডেড সাংবাদিকতাকে সাদা প্রোপাগান্ডা বা হোয়াইট প্রোপাগান্ডা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ১৯১৪ সালে তৎকালীন জার্মান সরকার কিছু ভুয়া তথ্য সাদা কাগজে সংবাদ মাধ্যমসহ সাধারণ্যে ছেড়ে দিয়েছিল। আর এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের অংশগ্রহণকে ত্বরান্বিত করেছিল। আর উদ্দেশ্যও ছিল তাই। সেই ভুয়া তথ্য থেকেই এই ধরনের সাংবাদিকতাকে হোয়াইট প্রোপাগান্ডা বা খোলা চোখে জলজ্যান্ত মিথ্যাচারের সাথে তুলনা করা হয়।

এই দীর্ঘ আলোচনাটি এ কারণে করা হলো- যাতে এই লেখার পাঠক বুঝতে পারেন যে, বাংলাদেশে সাংবাদিকতার নামে বর্তমানে আসলে কী হচ্ছে। কী এবং কীভাবে হচ্ছে সে বিষয়ে আমরা আলোচনায় যাব।

দীর্ঘকাল ধরে সাংবাদিকতাকে স্থান দেয়া হয় ফোর্থ স্টেট হিসেবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ- আইন সভা, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগ যথাযথভাবে কাজ করছে কিনা, অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্র যথাযথভাবে কার্যকর রূপে চলছে কিনা- তা দেখাই হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব। সে কারণে ১৭৮৭ সালে আইরিশ বংশোদ্ভুত বৃটিশ রাজনীতিক বাগ্মী, পন্ডিত এ্যাডমন্ড বার্ক সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ অঙ্গ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু বার্ক সাহেব এখন যদি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার হাল-হকিকত দেখতে পেতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন আমরা কোথায় আছি, কোথায় আছে সাংবাদিকতা!
সারা দেশে হাজার-লক্ষ মানুষ এখন করোনা আক্রান্ত। হাজার হাজার মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছেন- যাদের অধিকাংশই যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এখনো যারা আক্রান্ত হয়ে বাঁচার লড়াই করছেন, তাদের কতজন চিকিৎসা পাচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতে রোগীর ঠাঁই মিলছে না। আর্থিক, মানসিকসহ সব দিক দিয়ে কি নিদারুণ দু:সহ যন্ত্রণা রোগী এবং তার স্বজনরা ভোগ করছেন, তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। করোনা ভ্যাকসিন দেয়ার কথা শুনছি। শুনছি কোটি কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আসছে। কিন্তু কোথায়? বরং দেখছি নানা তেলেসমাতি। স্বাস্থ্য দপ্তরের দুর্নীতির খবরও শুনছি। একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে সীমাহীন হেনস্তা করা হয়েছিল। গণটিকার নামে গণহয়রানির খবর মিলছে। করোনাকালে লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। প্রবাসী জনশক্তির বিশাল এক অংশ আর কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারেননি, চাকরি হারিয়েছেন। গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, করোনাকালে নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছেন এবং যাচ্ছেন বিশাল সংখ্যার মানুষ। বর্তমানে আবার যুক্ত হয়েছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব।

জনগণের এসব অভাব অভিযোগ, দু:খকষ্ট এবং শাসকদের ব্যর্থতা নিয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর ও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দৃষ্টি ফেরানোর উদ্যোগে সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রক ও এর কর্তাব্যক্তিদের দিক থেকে নানা আয়োজন চলছে। কারণ সংবাদমাধ্যম এখন সাধারণ মানুষের দিকে নয়, ইশারা ইঙ্গিত ও নির্দেশনার জন্য তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে। ম্যানুফেকচারিং কনসেন্ট বা জনগণের সম্মতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি করাই এখন তাদের কাজ। সাংবাদিকতার বেশি গভীরে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহে শাসক, শাসক শ্রেণীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ লাভবান শ্রেণীসহ সামান্য সংখ্যক মানুষের দারুণ বিপদ। এই কারণেই সত্য ও ন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছে সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রকেরা।

এ কারণে আসল ছেড়ে নতুন ধারার এক সাংবাদিকতা পরিপূর্ণ গ্রাস করেছে সংবাদমাধ্যমকে। এর নাম পরীমনি সাংবাদিকতা। এখন কয়েকদিন পর পর পরীমনিরা সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়। শিরোনাম হয় মৌ, পিয়াসা, হেলেনাসহ বেশকিছু নাম। একটি কথা মনে রাখতে হবে, সমাজের আসল অসুখ আড়াল করতে গিয়ে নানা উপসর্গ দেখানো হচ্ছে। এ কারণেই স্বাধীন জনবান্ধব ও উদার সাংবাদিকতার স্থান দখল করেছে পরীমনি সাংবাদিকতা। পাঠক একবার চিন্তা করুন, তাহলে আপনারই এর জবাব পেয়ে যাবেন যে, কেন চলছে বিনাশী এসব আয়োজন। আপনারই চিন্তা করুন, কেন কয়েক মাস আগে ছিল ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির হাঁক-ডাক।

আসল সংকটকে ধামাচাপা দেয়ার অপকৌশলের একটি সুগভীর গর্তে পড়ে বিদায় নিয়েছে সৎ, স্বাধীন, জনবান্ধব ও উদার সাংবাদিকতা। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট দিয়েও নিশ্চিত না হওয়ার কারণে সাংবাদিকতার নতুন ধারার সূচনা হয়েছে। শাসকদের সাথে এই সন্ধিও এমবেডেড সাংবাদিকতার নতুন ধরন।

অথচ সাংবাদিকতার এ ধারাটি এক সময় মূল ধারার ধারে কাছেও ছিল না। ৫০ থেকে ৮০-এর দশক পর্যন্ত কমবেশি জনবান্ধব স্বাধীন, উদারপন্থি সাংবাদিকতা ছিল এ দেশে। সবটুকু ছিল এটুকু না বললেও সামগ্রিক প্রচেষ্টা যে ছিল তাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সংবাদ-মাধ্যম স্বাধীনতা সংগ্রামের সহায়ক শক্তি ছিল। কিন্তু সেই সাংবাদিকতার প্রস্থান ঘটেছে। নতুন এই সাংবাদিকতায় এখন জনগণের প্রতি কোনো দায় নেই, জবাবদিহিতা নেই। একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে সাংবাদিকতার সেই মূল ধারা ও ঐতিহ্যের প্রস্থানে শোক করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
(আমীর খসরু: সিনিয়র সাংবাদিক এবং প্রধান নির্বাহী, স্টাডি গ্রুপ অন রিজিওয়ানাল অ্যাফেয়ার্স, ঢাকা)/মানবজমিন

মতামত লেখকের নিজস্ব

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।