শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১০:৫৬ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
কাপড়ের দোকানদার, ক্রোকারিজ ব্যবসা থেকে গোল্ডেন মনিরের’ কালো অধ্যায় : এমপি আতাউরের গাড়ি ব্যবহার : স্বদেশ হাউজিংয়ের পরিচালক : পালাতে পারলেন না বিদেশে

নিউজ ডেক্স : প্রাসাদোপম এক আবাসিক ভবনে থাকতেন তিনি। নকশাখচিত প্রধান ফটক রাজবাড়ির সিংহদুয়ারের মতো। চলাফেরা করেন বিলাসবহুল গাড়িতে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ২০০ প্লট তার কবজায়। সব মিলিয়ে তার সম্পদের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ নব্বইয়ের দশকে তিনি ছিলেন কাপড়ের দোকানের এক সাধারণ বিক্রয়কর্মী। নানা ঘাটের জল ঘোলা করে জড়িয়ে পড়েন স্বর্ণ চোরাচালানে। অল্প দিনেই চোরাচালান কারবারের হোতা হয়ে ওঠেন। আলাদিনের চেরাগ আসে তার হাতে। দ্রুত বাড়তে থাকে সম্পদ। এই ব্যক্তির নাম মনির হোসেন। এক পর্যায়ে তিনি পরিচিতি পান ‘গোল্ডেন মনির’ নামে। স্বর্ণের হাত ধরে সোনালি উত্থানে নিজের জীবনের গল্প বদলে ফেলেন ‘গোল্ডেন মনির’। শুক্রবার রাতে রাজধানীর মেরুল বাড্ডার ১৩ নম্বর সড়কের ৪১ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৩। গতকাল শনিবার সকাল পর্যন্ত চলে ওই অভিযান।

অভিযান শেষে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও বিদেশি মুদ্রা রাখার দায়ে মনির হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার এক হাজার ৫০ কোটি টাকার মতো সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। হুন্ডি ব্যবসা, স্বর্ণ চোরাচালান, ভূমিদস্যুতার মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। রাজউকের বহু প্লট তার দখলে। বাড্ডা ছাড়াও গুলশান, নিকেতন ও উত্তরা এলাকায় তার ৩০টির মতো ফ্ল্যাট রয়েছে। তবে তিনি নিজে ১৩টির কথা স্বীকার করেছেন। তার বাসা থেকে জব্দ করা দুটি বিলাসবহুল প্রাডো গাড়ির দাম আনুমানিক তিন কোটি টাকা। এ ছাড়া তার গাড়ির শোরুম অটো কার সিলেকশন থেকে আরও তিনটি অবৈধ বিলাসবহুল গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে চালানো হয় এই অভিযান। মনিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিনটি মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে র‌্যাব। এর আগে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা ছিল। একটি মামলা দুদকে, অন্যটি রাজউকে। মনির হোসেনের অবৈধ কর্মকাণ্ডে কারা সহায়তা করেছেন তা অনুসন্ধানের জন্য দুদক, বিআরটিএ, সিআইডি ও এনবিআরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানানো হবে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

জব্দ মালপত্র: প্রায় সাড়ে ১২ ঘণ্টার অভিযান শেষে গতকাল সকালে সংবাদ সম্মেলনে রথ্যাব জানায়, বিদেশি একটি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি, চার লিটার বিদেশি মদ, ৩২টি নকল সিল, ২০ হাজার ৫০০ সৌদি রিয়াল, ৫০১ মার্কিন ডলার, ৫০০ চায়নিজ ইয়েন, ৫২০ রুপি, এক হাজার সিঙ্গাপুরের ডলার, দুই লাখ ৮০ হাজার জাপানি ইয়েন, ৯২ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, হংকংয়ের ১০ ডলার, ১০ ইউএই দিরহাম, ৬৬০ থাই বাথ মনির হোসেনের বাসা থেকে জব্দ করা হয়েছে। এগুলোর মূল্যমান আট লাখ ২৭ হাজার ৭৬৬ টাকা। এ ছাড়া ৬০০ ভরি স্বর্ণালংকার ও নগদ এক কোটি ৯ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসুর উপস্থিতিতে চালানো হয় তল্লাশি কার্যক্রম।

যেভাবে উত্থান: র‌্যাব জানায়, নব্বইয়ের দশকে মনির ছিলেন গাউছিয়া মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী। পরে তিনি রাজধানীর মৌচাকের একটি ক্রোকারিজের দোকানে কাজ শুরু করেন। তখন ‘লাগেজ পার্টি’র একজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর মনিরও লাগেজ ব্যবসায় যুক্ত হন। ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে লাগেজে কাপড়, প্রসাধন, ইলেকট্রনিকস, মোবাইল ফোন, ঘড়ি, কম্পিউটার সামগ্রী আনা-নেওয়া শুরু করেন। মূলত ঢাকা-সিঙ্গাপুর-ভারত রুটে ছিল তার ব্যবসা। এই লাগেজ ব্যবসা করার সময় স্বর্ণ চোরাকারবারে জড়িয়ে পড়েন। অবৈধভাবে দেশে নিয়ে আসেন বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ। বায়তুল মোকাররম মার্কেটে তিনি একটি স্বর্ণের গহনার দোকানও দেন। চোরাচালানের স্বর্ণ ওই দোকান থেকে বিক্রি হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। চোরাচালানের দায়ে ২০০৭ সালে তার বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে একাধিক মামলা হয়।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, রাজউক থেকে প্লট-সংক্রান্ত সরকারি নথি চুরি করে এবং অবৈধভাবে রাজউকের কর্মকর্তাদের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করে পূর্বাচল, বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জে নামে-বেনামে অন্তত দুই শতাধিক প্লট নিজের দখলে নেন মনির। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ৩০টির বেশি প্লটের কথা স্বীকার করেছেন। রাজউকের ৭০টি ফ্ল্যাটের নথি নিয়ে গিয়ে আইনবহির্ভূতভাবে হেফাজতে রাখায় ২০১৯ সালে মনিরের বিরুদ্ধে রাজউক কর্তৃপক্ষ মামলা করে। এ ছাড়া দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করায় তার বিরুদ্ধে দুদকের মামলাও চলমান। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মনির জানান, ২০০১ সালে তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী, গণপূর্ত ও রাজউক কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল তার। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভূমি জালিয়াতি শুরু করে দেন।

র‌্যাব জানায়, ভূমিদস্যুতা ও প্লট জালিয়াতির হোতা মনির নিজের বসবাসের জন্য মেরুল বাড্ডার ডিআইটি প্রকল্পে বানিয়েছেন ছয়তলা আলিশান বাড়ি। এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা মিলে ডুপ্লেক্সে তিনি পরিবার নিয়ে থাকতেন। আর ওপরের তলাগুলো ভাড়া দেওয়া ছিল। তবে করোনাকালে ভাড়াটিয়ারা বাড়ি ছাড়েন। এ কারণে পুরো ভবনে শুধু মনিরের পরিবারই ছিল।

দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত গোল্ডেন মনির। তার মধ্যে রয়েছে- মনির বিল্ডার্স, গার্লস অটোকারস লিমিটেড, উত্তরার গ্র্যান্ড জমজম টাওয়ার ও স্বদেশ প্রপার্টিজের অন্যতম পরিচালক। জমজম টাওয়ারে মনিরের মালিকানার মূল্যমান প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। বারিধারায় গোল্ডেন গিয়ার নামে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের গাড়ির যন্ত্রাংশের দোকান রয়েছে তার। বাড্ডার ১১ নম্বর সড়কে সাড়ে তিন কোটি টাকা মূল্যের দুটি এবং দুই কোটি টাকা দামের প্লট রয়েছে। এমনকি বাড্ডায় ১০ নম্বর সড়কে একটি ছয়তলা শপিং সেন্টার নির্মাণের কাজ চলছে। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে মনিরসহ চারজনের অংশীদারিত্বে প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের পাঁচ বিঘা জমি রয়েছে। এর বাইরে কেরানীগঞ্জে প্রচুর জমিজমা ও প্লট আছে। চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে মনিরের ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য নেওয়া হয়েছিল। নানা জালিয়াতির বিষয়ে প্রমাণ মেলার পর তাকে আইনের আওতায় নেওয়া হয়।

রাজউক কার্যালয়ে অফিস: সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, গোল্ডেন মনিরের দোর্দণ্ড দাপট ছিল রাজউক কার্যালয়ে। তিনি সেখানকার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে রাজধানী ও আশপাশ এলাকার জমি দখল করেন। রাজউকের সাবেক এক চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলেও তথ্য রয়েছে। তার সহযোগিতায় মনির রাজউক কার্যালয়ে নিজের অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য একটি কক্ষও পান। দীর্ঘদিন তিনি কক্ষটি অফিস হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়া রাজউকের সিল জালিয়াতি করে বহু জমির দলিল নিজের নামে করে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।

দুবাই পালানোর পরিকল্পনা: জানা যায়, র‌্যাবের অভিযানের প্রস্তুতির মধ্যেই দুবাই পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন মনির। গত ২১ নভেম্বর শনিবারই তার দেশত্যাগের পরিকল্পনা ছিল। কোনোভাবে গ্রেপ্তার এড়াতে পারলে তিনি শনিবার সকাল ১১টার এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে দেশত্যাগ করতেন।

নিরাপত্তার নামে নিজের সঙ্গে দুটি লাইসেন্স করা অস্ত্র রাখতেন মনির। এর মধ্যে একটি পিস্তল ও একটি শটগান। বিদেশ যাওয়ার জন্য লাইসেন্স করা দুটি অস্ত্র বাড্ডা থানায় জমাও দিয়েছিলেন। এর পাশাপাশি একটি অবৈধ পিস্তলও ছিল তার দখলে। গ্রেপ্তারের সময় তার বাসা থেকে সেটি জব্দ করা হয়।

এদিকে মনিরের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, চিকিৎসার জন্য দুবাই যাওয়ার কথা ছিল তার। তার ছেলে মোহাম্মদ রাফি বলেন, ‘বাবা চিকিৎসার জন্য মাঝেমধ্যেই দুবাই যান। এবারও চিকিৎসার জন্য তার যাওয়ার কথা ছিল। এজন্য তার ফ্লাইট কনফার্ম ছিল। আমার বাবার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে, সব ভিত্তিহীন। তিনি একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। আমরা আইনিভাবে সব মোকাবিলা করব।’

বিএনপির অর্থের জোগানদাতা: মনিরের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে র‌্যাব জানিয়েছে, তিনি একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। সেই দলটির অর্থের জোগানদাতা হিসেবেও তিনি কাজ করেন।

তবে অন্য একটি দায়িত্বশীল সূত্র সমকালকে জানায়, ঢাকায় ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা সাবেক কমিশনার এমএ কাইয়ুমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন মনির। বলা হয়, তার ছত্রছায়ায় উত্থান ঘটে মনিরের। অবশ্য মনিরের ছেলে রাফি দাবি করেছেন, তার বাবা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। এ ছাড়া শীর্ষ সন্ত্রাসী মুরগি মিলনের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। চোরাচালানে জড়িত হওয়ার সময় মিলনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

মনির ব্যবহার করতেন এমপির গাড়ি: জানা গেছে, মনির শেরপুর-১ আসনের সরকারদলীয় এমপি আতিউর রহমান আতিকের দামি গাড়ি ব্যবহার করতেন। মনিরের হেফাজতে পাওয়া ওই গাড়িটি আতিকের নামে নিবন্ধন করা। এ ছাড়া কুড়িগ্রামের আরেক এমপির গাড়িও মনিরের কাছে ছিল।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শেরপুরের এমপি আতিউর রহমান আতিক সমকালকে জানান, তার ল্যান্ড ক্রুজার ব্রান্ডের গাড়ি মনিরের কাছে মাঝেমধ্যে থাকে। তার সঙ্গে যাতায়াত রয়েছে। ঠিকঠাক করার জন্য মনিরের কাছে তার গাড়ি দিয়েছেন। গাড়িটি মনিরের গ্যারেজে ছিল।

মনির হোসেনের বাড়ির দারোয়ান আবু তাহের জানান, মেরুন রঙের গাড়িটি মনির নিজেই ব্যবহার করতেন। কালো রঙের আরেকটি গাড়ি কয়েকদিন আগে এনে রাখা হয়। তবে এটার মালিকানা নিয়ে কিছু জানি না।

বাজুসের প্রতিবাদ: বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, মনির হোসেনকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্বর্ণ ব্যবসায়ী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এতে দেশের সাধারণ স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের মান ক্ষুণ্ণম্ন হচ্ছে। কারণ বাজুসের তথ্যমতে, মনির কোনো স্বর্ণ ব্যবসায়ী নন।

সমিতির সভাপতি এনামুল হক খান ও সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাজুস বা এর কোনো সদস্য এ ধরনের কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন না। অধিকন্তু তারা এসব কার্যকলাপ দমনের জন্য সরকারের সংশ্নিষ্ট মহলকে সাধুবাদ জানাচ্ছে। ভবিষ্যতে যদি প্রয়োজন হয়, তবে এ ধরনের সব অবৈধ কর্মকাণ্ড রোধে তারা সরকারের পাশে থাকবেন।সমকাল

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।