মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০৪:৪৪ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
কালান্তরের মুখোমুখি একুশের চেতনা

আবুল মোমেন : আজ মহান শহীদ দিবস। আজ বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সেই ১৯৫২ সালে এদেশের ছাত্র-তরুণরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত ঘোষণা দিয়েছিল। সেদিন পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন পাঁচ জন তরুণÑ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও সালাহউদ্দিন। সেদিন ঢাকার অন্যান্য জায়গায় ও পরের দুদিনে আরও কয়েকজন ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন। বায়ান্নর আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পর ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি থেকে, যখন পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কেবল উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ বায়ান্নতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ছাত্র-তরুণদের মাধ্যমে সারাদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে এক অসাম্প্রদায়িক মানবিক দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দিয়েছিল সে আন্দোলন। তারই পরিণতিতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকারের ভরাডুবি ঘটে আর বিজয়ী হয় যুক্তফ্রন্ট। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট বাংলা ভাষার দাবিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনাকে সরকারে ও রাজনীতিতে ধারণ করেছিল এবং মাতৃভাষা বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে আপন গর্বের সম্পদ হিসেবে মর্যাদা দেয়। এর পর পাক সরকার বাধ্য হলো রাষ্ট্র্রের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলার অধিকারকে মর্যাদা দিতে। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেলেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বাঙালি ও পূর্ববাংলার বিরুদ্ধে বঞ্চনা ও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখল। ফলে একুশের চেতনা ক্রমেই সম্প্রসারিত হয়েছে। ততদিনে তৈরি হয়েছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সারাদেশে অনেক কলেজে নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার। আর এই মিনার ক্রমে রূপ পেয়েছে আপসহীন বাঙালির অধিকার আদায়ের চেতনার প্রতীকে। শহীদ মিনার আমাদের জাতীয় জীবনে মহৎ কাজের অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ব্যক্ত করার স্থান। শপথ গ্রহণের স্থান। তাই পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালির ছাত্র জনতা বারবার এসে দাঁড়িয়েছে শহীদ মিনারে। এখানে দাঁড়িয়ে ভাষাশহীদদের স্মরণ করে তারা জনগণের অধিকার আদায়ে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শপথ নিয়েছে বরাবর। বছরের যে কোনো সময় যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনার বাঙালি এই মিনারের বেদিমূলে এসে দাঁড়িয়েছে, শপথ নিয়েছে সংগ্রামে বিজয় পর্যন্ত অটল থাকার, প্রেরণা নিয়েছে প্রয়োজনে নিজের প্রাণ বিসর্জনের। এইভাবে এগোতে এগোতে বিপুল ত্যাগ আর বিরতিহীন সংগ্রামের মাধ্যমে বায়ান্নর সন্তানেরা, একুশের চেতনার গর্বিত উত্তরাধিকারীরা দেশকে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল শত্রুর দখল থেকে মুক্ত করেছে। প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পেছনে একুশের চেতনা শাশ্বত শিখা হয়ে জ্বলছিল বলেই এদেশ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিল এই চেতনার মূর্ত প্রতীক। একুশের চেতনা রাঙিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। বাংলাদেশ এই চেতনারই চূড়ান্ত ফসল। সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বেদিমূলে রচিত হলো বিজয়ের গাথা। উড়ল এবার শান্ত শ্যামল বাংলার সবুজ প্রেক্ষাপটে সংগ্রাম ও আশার লাল সূর্য শোভিত পতাকা। এবারে একুশে হয়ে উঠল বাঙালির মেধা, মনন ও সৃজনী শক্তির বিকাশের এক উৎসবময় উপলক্ষ। পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকেই শুরু হয়ে যায় ভাষার মাসের নানা আয়োজন, সবচেয়ে গুরুত্ব পায় বাংলা ভাষায় নতুন নতুন বইয়ের প্রকাশনা। একদিন অকূল প্রত্যাশায় আকুল হয়ে বাংলার তরুণ-তরুণীরা গেয়েছে মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা। একদিন এদেশের বয়োজ্যেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বলেছিলেনÑ একুশ মানে মাথা নত না করা। না, বাঙালি মাতৃভাষার গর্ব ছাড়েনি, বাঙালি কোনো বাধার কাছে মাথা নোয়ায়নি। তার বিজয় রথ সব বাধা চূর্ণ করে এগিয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের প্রতীক হয়ে উঠেছে। তবুু ভুলে যেন না যাই আমাদের একুশে চেতনার কথা, শহীদ মিনারে প্রতীকী মূল্যের কথা, একুশ থেকে একাত্তর অবধি বিস্তৃত আন্দোলনের ইতিহাস কিংবা তার পরবর্তী বাধাবিঘœ উত্থানপতনের কথা। আজ ইতিহাসের বাঁকবদল ঘটছে, নতুন এক কালান্তরের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে সমকাল, পুরো বিশ্ব। আজ মুক্তবাজার ও বিশ্বায়নের রমরমায় বিশ্ব এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের সামনে। এমন প্রযুক্তি সুলভে মিলছে যা আমাদের পৌঁছে দিচ্ছে বিশ্বের সকল তাজা খবর, চাইলে পাওয়া যায় প্রয়োজনীয় তথ্য ও জ্ঞান, যুক্ত হওয়া যায় পুরনো ও নতুন বন্ধুর সঙ্গে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে ভাষা ও সংস্কৃতি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ কোনো দুঃশাসক আমাদের জানাচ্ছে না, কেউ আমাদের পদানত করে রাখছে না। বাজার, জীবন, চাহিদা, গুরুত্ব, সাফল্য নানা কারণে মানুষ তার ভাষা-সংস্কৃতির বিষয়ে উদাসীন হয়ে পড়ছে, মাতৃভাষা ও দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করছে। একুশ নিয়ে, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এবং ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বইমেলাকে ঘিরে যে আবেগ-উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটে তা অর্থহীন হয়ে পড়ে, ফাঁপা বুলিতে পর্যবসিত হয়। বাঙালি কবি-গায়ক বলেছেনÑ বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ। কোনো জাতিই বড় হতে পারে না যদি সে তার নিজের মায়ের ভাষা আর মাটির সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে। একুশ কেবল চেতনা নয়, ইতিহাস, শহীদ মিনার জাতির জীবনে কেবল আবেগ নয়, চোখ ফোটানোর প্রতীক। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি আমরা শিখব, জ্ঞান ও কাজের সুবিধার জন্য আরও অন্যান্য ভাষাও শিখতে পারি, কিন্তু তা কখনো মাতৃভাষার বিনিময়ে হবে না, দেশীয় সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে হতে পারে না। আজ নতুন প্রেক্ষাপটে যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা অর্থাৎ এ দিনটির ঘটেছে আন্তর্জাতিকায়ন তেমনি আজকের বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমাদেরও বুঝে নিতে হবে নতুন যুগের নতুন চ্যালেঞ্জের অন্তর্নিহিত বাণী। আমাদেরও একুশের আন্তর্জাতিকতার মূলবাণী আপন আপন মাতৃভাষাকে লালন ও এর শ্রীবৃদ্ধির জন্য কাজ করার দায়টি বুঝে নিয়ে পালন করতে হবে। আজ সে কথা যেন না ভুলিÑ একুশের দিনে, ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে যেমন তেমনি সারাবছর একই চেতনায় চলতে হবে। তবেই একুশের অন্তর্নিহিত চেতনা এবং নতুনতর ব্যঞ্জনার প্রতিফলন আমাদের ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে ঘটবে।

 

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।