রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০২:৫৭ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
সালতামি ২০১৭: বছর জুড়েই আলোচনায় ইসি : নতুন বছর ২০১৮তে ৬ সিটি ও একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার চ্যালেঞ্জ

ডেক্স প্রতিবেদন : চলতি বছরের মার্চে দায়িত্ব নেয়া কেএম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুরো বছরই ছিল নির্বাচনমুখী। উল্লেখযোগ্য ছিল সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনা। এ ছাড়া দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন কোনো প্রকার বিতর্ক ও সহিংসতা ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে। বছরের শুরুতে দায়িত্ব নেয়ার পর ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বহু দলীয় গনতন্ত্রের প্রব্যক্তা বলে প্রশংসা কুড়িয়েছেন বিএনপির।অন্য দিকে সরকারি দল আওয়ামীলীগ তাকে তিরস্কার করেছে। দাবি ওঠেছে জিয়াকে বহু দলীয় গণতন্ত্রের প্রব্যক্তা বলায় ইসির বিরুদ্ধে মামলার করার। কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসির সামনে আগামী ২০১৮ সালে ছয় সিটি ও আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার চ্যালেঞ্জ । দায়িত্ব নেয়ার বছরের বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু স্থানীয় সরকারের নির্বাচনও সম্পন্ন করার পাশাপাশি ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম পরিচালনা, নিজম্ব উদ্যোগে স্মার্টকার্ড তৈরি ও বিতরণ, ছিটমহলের বাসিন্দাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তিকরণসহ আরো বেশকিছু কাজ করেছে। চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নের প্রথম শুরুটাই হয়েছিল কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন দিয়ে। আর শেষ হয়েছে সদ্য সমাপ্ত রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আয়োজনে। ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রকাশ্য বা ঘরোয়া সভা-সমাবেশ আয়োজনে বাধা দূর করার চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করতে পারেনি ইসি। এছাড়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার মো. নুরুল হুদার অন্যতম চমক ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের প্রশংসা এবং তাঁকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বলার পরে আলোচনা আসেন।
এদিকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রোডম্যাপ তৈরি, রোডম্যাপের বাস্তবায়নে সংলাপ আয়োজনও ছিল বর্তমান কমিশনের অন্যতম সফলতা। তবে মাত্র ১০ মাসের মেয়াদে সরকারের পক্ষে আর বিরোধী দলের বিপক্ষে গিয়ে বারবার সমালোচিতও হয়েছে নয়া ইসি। সর্বশেষ সমালোচিত হয় সংলাপে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা ও বিএনপি সরকারের প্রশংসামূলক বক্তব্য দিয়ে। বছর জুড়ে বিভিন্ন কারণে বিক্ষোভ, কর্মবিরতির মতো ঘটনাও ঘটে।
চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি খান মো. নুরুল হুদার কমিশন দায়িত্ব নেয়ার আগে বিদায়ী কাজী রকিব কমিশনের বিতর্কিত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি’র দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইসির ভাবমূর্তিকে তলানিতে নিয়ে যায়। এরপর বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের আস্থাহীনতার মধ্যে কাটে বিদায়ী কমিশনের গোটা মেয়াদকাল। তবে, নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণ করে সঙ্গী আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে বিএনপি বর্তমান কমিশনের নানা সমালোচনা করে আসছে। এরই মধ্যে আসে কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। মার্চের এই নির্বাচন ছিল কমিশনের জন্য রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহলের সমালোচনা থেকে আলোচনায় আসার। একইসঙ্গে ফেরে কমিশনের হারানো আস্থা। সে নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপি প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু নৌকা প্রতীকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনজুম সুলতানাকে প্রায় ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। কমিশন মনে করে, কুমিল্লার নির্বাচনের পর কমিশন কিছুটা হলেও বিএনপির আস্থায় আসতে পেরেছে। তবে সর্বশেষ ২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দিয়ে বিএনপির সেই সমালোচনায় সঙ্গী থাকল ইসির। এ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর অবস্থান তৃতীয়। জাপার প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা প্রায় লক্ষাধিক ভোটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টুকে পরাজিত করেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ফলাফল মেনে নিলেও কারচুপির অভিযোগে ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচনের ফলাফল বর্জন করেন বিএনপির প্রার্থী। তবে, বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফল সবার গ্রহণ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন। কুমিল্লা ও রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার মাধ্যমে যতটা না আলোচনায় উঠে আসে কেএম নুরুল হুদার কমিশন, তার চেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল সংলাপের উদ্যোগ নিয়ে। বছর জুড়ে ইসিসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে চলে সংলাপ সংলাপ খেলা। যার রেশ এখনো কাটেনি। তবে, প্রাথমিকভাবে সব অংশীজনদের সংলাপে বসাতে পেরে যতটা স্বস্তিতে ছিলেন, তারও বেশি অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে সংলাপের উত্থাপিত কয়েটি স্পর্শকাতর ইস্যুতে। যার পক্ষ ইসি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ নিয়েও সমালোচনায় পড়ে ইসি। সংলাপে বিরোধী দল বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী রাখার পক্ষে এবং ইভিএম না রাখার পক্ষে মত দেয়। অপরদিকে, সেনাবাহিনীর বিপক্ষে এবং ইভিএমের পক্ষে মত দেয় ক্ষমতাসীনরা। দল দুটির এ দাবির ক্ষেত্রে পক্ষ নেয় ইসি। বিএনপির কোনো দাবিই না মেনে ইভিএম আরওপিওতে অন্তর্ভুক্ত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা (ইসি)। পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত না করার পক্ষে কঠোর অবস্থানে রয়েছে ইসির। এ ছাড়া সংলাপে ইসি প্রায় ৪শ’ সুপারিশ থেকে মাত্র ২৫টি সুপারিশ আমলে নেয়। যার পুরোটাই সরকারের পক্ষে। এর মধ্যে ঋণখেলাপিদের ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র দাখিলের একদিন আগে ঋণ পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়েছে। সংলাপে অংশ নেয়া এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, সংলাপে বসে মনে হয়েছিল তাদের (ইসি) লক্ষ্য হচ্ছে অবাধ, প্রশ্নমুক্ত, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দেয়া। কিন্তু সংলাপ-উত্তর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) কিছু কিছু কথায় মনে হয়েছে, আসলে ওই সংলাপ পর্ব ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তারপরও প্রত্যাশা করি ইসি যেন একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রশ্নমুক্ত, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে সক্ষম হয়। চলতি বছরে ইসির জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা ছিল স্মার্টকার্ড বিতরণ এবং কার্যক্রমে স্থবিরতা তৈরি হওয়া। স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র মুদ্রণ ও বিতরণ প্রতিষ্ঠান ওবার্থুর ব্যর্থতা কমিশনকে সাধারণ মানুষের সংকটে ফেলে। তবে এখন সেই স্মার্টকার্ড মুদ্রণ ও বিতরণের দায়িত্ব সরকার নিয়েছে। আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে ১০ কোটি ৬০ লাখ অর্থাৎ সব ভোটার এই কার্ডটি পেয়ে যাবে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইনি কাঠামো গুলো পর্যালোচনা ও সংস্কার, নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও যুগোপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ গ্রহণ, সংসদীয় এলাকার নির্বাচনী সীমানা পুনর্নিধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ, বিধি অনুসারে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ এই ৭টি করণীয় বিষয়ে কর্ম-পরিকল্পনা নির্ধারণ করে চলতি বছরের ১৬ জুলাই রোডম্যাপ ঘোষণা করে বর্তমান কমিশন। এতেও তারা বিভিন্ন মহলে প্রশংসা পায়। তবে এত কম সময়ে কীভাবে করবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। যদিও বিএনপি এর সমালোচনা করেছে।এসব বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা আশা প্রকাশ করে বলেন, রাজনৈতিক দলসহ সবার কমিশনের প্রতি আস্থা রয়েছে। নিরপেক্ষ থাকলে সবার কাছে ভালো হওয়া যায় না এবং সবাইকে খুশি করা যায় না। আগামী সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমরা উপহার দিতে পারব।
তবে কমিশনের এই সাফল্য নতুন বছরেও অব্যাহত থাকবে কিনা এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রত্যাশা বাড়তে শুরু করেছে। কারণ উত্তর সিটির মেয়র পদে উপনির্বাচনের পর গাজীপুর, বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট সিটিতে ভোট আয়োজন করতে হবে ইসিকে। এসব নির্বাচনে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা দেখাতে পারলে জাতীয় নির্বাচনে সব দলকে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে প্রতিবন্ধকতা বাধা হয়ে দাঁড়াবে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।