শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১১:০৭ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স : অবৈধ ল্যাগেজে কার্গো ব্যবসায় ধস : কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে বিমান

একুশে বার্তা ডেক্স : গোপন ও অবৈধ ‘অ্যাকসেস ল্যাগেজ’র চাপে বাংলাদেশ বিমানের সব রুটের কার্গো ব্যবসায় ধস নেমেছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, শুধু লন্ডন রুটেই প্রতিদিন গড়ে ১২ থেকে ১৫ টন কার্গো স্পেস খালি যাচ্ছে।

এতে একদিকে বিমান বড় অংকের টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে, অপরদিকে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী রাতারাতি ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ বনে যাচ্ছে। আর গোপন ল্যাগেজের কারণে প্রতিদিনই বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে বিমান উঠানামা করতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের আরও অভিযোগ, দিনের পর দিন স্পেস (ফ্লাইটে জায়গা) না পেয়ে তালিকাভুক্ত কার্গো সেলস এজেন্টরা (সিএসএ) পণ্য পরিবহনে বিমান ছেড়ে অন্য এয়ারলাইন্সের দিকে ঝুঁকছে। ‘অ্যাকসেস ব্যাগেজ’র পাশাপাশি সিএসএদের কার্গো স্লাব কমানো-বাড়ানো নিয়ে চলছে নানা অনিয়ম। এ কারণেও দিন দিন কার্গো কমে যাচ্ছে। ডিসেম্বরে কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ সিএসএর কমিশন ভিত্তিক ট্যারিফ স্লাব কমিয়ে দেয় বিমানের লন্ডন স্টেশন।
একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের কারণে এজেন্ট প্রতি সাড়ে ৩ হাজার কেজির স্লাবকে ১ হাজারে নামিয়ে আনা হয়। তাতে দেখা গেছে মুহূর্তে বড় ধরনের ধস নামে কার্গো পরিবহনে।

জানা গেছে, ওই ঘটনায় এক নাগাড়ে ১১টি ফ্লাইট লন্ডন থেকে দেশে এসেছিল কার্গো ছাড়া। একপর্যায়ে আবার স্লাব বাড়িয়ে দিলে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেয়া সম্ভব হয়।
বিমান প্রধান কার্যালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ডিসেম্বরে ফ্লাইট খালি আসার ঘটনাটি তদন্ত করা হবে। কেন এবং কাদের জন্য ওই সময় স্লাব কমিয়ে দেয়া হয়েছিল সেটা তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে অ্যাকসেস বাগেজের বিষয়টিও তদন্ত করা হবে।
বিমানকে বাঁচাতে হলে ‘অ্যাকসেস ব্যাগেজ’র এ অনিয়ম-দুর্নীতি সম্পূর্ণ বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, সব ফ্লাইটের প্রতি ইঞ্চি জায়গা যাতে ব্যবহৃত হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।
জানা গেছে, প্রতি বছর ঈদ মৌসুমে প্রবাসী যাত্রীদের ‘অ্যাকসেস ব্যাগেজ’ আনার প্রবণতা বেড়ে যায়। একজন যাত্রী সর্বোচ্চ ৩০ কেজি ওজনের লাগেজ নেয়ার সুযোগ থাকলেও ঈদ মৌসুমে প্রবাসী যাত্রীরা ৫০-৬০ কেজি করে ব্যাগেজ নিয়ে দেশে ফিরছেন। এ সুযোগে আন্তর্জাতিক স্টেশনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মোটা অংকের টাকা নিয়ে যাত্রীদের অতিরিক্ত ব্যাগেজ সুবিধা দিচ্ছেন। অপরদিকে সেই পরিমাণ কার্গো পরিবহন কমিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু অ্যাকসেস ব্যাগেজের টাকা বিমানের কোষাগারে জমা হচ্ছে না। গত ১ সপ্তাহ ধরে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সন্দেহজনক অতিরিক্ত ওজনের লাগেজ তল্লাশি করে এ তথ্য পেয়েছে খোদ বিমান ম্যানেজমেন্ট। এ ঘটনায় বিমানের কয়েকটি স্টেশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ বিমানের সিকিউরিটি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী আন্তর্জাতিক রুটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবৈধ ‘অ্যাকসেস ব্যাগেজ’ আসছে লন্ডন স্টেশন থেকে। এরপর রয়েছে সৌদি আরব, দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া অন্যতম। বিমান সিকিউরিটির একজন কর্মকর্তা বলেন, এক শ্রেণীর যাত্রীদের সঙ্গে যোগসাজশে বিমানেরই কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা এ অনিয়ম করছেন। ইতিমধ্যে এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তার মতে, কার্গো বুকিংয়ের সঙ্গে বিমান কর্মকর্তাদের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকায় এর ওজন নিয়ে কোন নয়-ছয় করতে পারে না কেউ। তাছাড়া কার্গো পন্য দেশে আসার পর সেগুলো কাস্টমসসহ ৩ স্তরে পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়। কিন্তু যাত্রীদের ব্যাগেজ বুকিংয়ের সঙ্গে বিমানের স্থানীয় অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পৃক্ততা থাকায় এখানে নানা অনিয়ম হচ্ছে। আর অতিরিক্ত অ্যাকসেস ব্যাগেজ দেয়ার কারণে পর্যাপ্ত স্পেস থাকলেও ফ্লাইটের ওজন সমন্বয় করতে গিয়ে বেশিরভাগ ফ্লাইটে ১২ থেকে ১৫ টন কার্গো দেয়া সম্ভব হয় না।
বিমানের লন্ডন রুটের একজন কার্গো সেলস এজেন্ট বলেন, এ রুটে প্রতিটি ফ্লাইটে গড়ে ২৫ থেকে ২৭ টন কার্গো পাঠানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃপক্ষ ১৫ থেকে ১৭ টনের বেশি কার্গো পণ্য পাঠাতে পারছে না। এতে প্রতি ফ্লাইটেই ১২ থেকে ১৫ টন কার্গো স্পেস খালি যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে প্রতিদিনই শেষ মুহূর্তে অর্থাৎ ফ্লাইট ছাড়ার ৪-৫ ঘণ্টা আগে এজেন্টদের টেলিফোনে কার্গো দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে হয় বিমান কর্তাদের। কিন্তু পর্যাপ্ত কার্গো থাকার পরও ওই মুহূর্তে সময় ও নানা নিয়ম-কানুনের কারণে এজেন্টদের পক্ষে কার্গো দেয়া সম্ভব হয় না। যার কারণে প্রতিদিনই খালি স্পেস নিয়ে লন্ডন থেকে ঢাকায় আসছে বিমানের অধিকাংশ ফ্লাইট। এতে শুধু একটি রুটে মাসে কমপক্ষে ২ থেকে ৩ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে বিমান।
লন্ডনের অপর এক কার্গো এজেন্ট বলেন, ফ্লাইটে যাত্রী কম হলে কার্গো স্পেস বেড়ে যায়। বর্তমানে ঢাকা-লন্ডন রুটে ৪১৯ আসনের একটি উড়োজাহাজে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০-এর বেশি যাত্রী হয় না। এ কারণে কার্গো স্পেস গড়ে ২৭ টন পর্যন্ত হয়ে যায়। এছাড়া স্টেশন ম্যানেজমেন্টের নানা অদক্ষতা, ফাঁকিবাজির কারণেও প্রতিদিন কার্গো স্পেস খালি থাকছে। তিনি বলেন, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে হঠাৎ কোনো ধরনের ঘোষণা না দিয়েই এজেন্ট প্রতি কার্গোর ট্যারিফ স্লাব কমিয়ে দেয়ায় একনাগাড়ে ১১টি ফ্লাইট খালি আসে। দেখা গেছে, তখন অনেক সিএসএ বিমান ছেড়ে অন্য এয়ারলাইন্সে কার্গো পণ্য পাঠিয়েছিল। পরে বাধ্য হয়ে স্লাব বাড়িয়ে দিলে এখন গড়ে ১৭ থেকে ২০ টন পর্যন্ত কার্গো পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে লন্ডনে বিমানের তালিকাভুক্ত সিএসএ রয়েছে ১১ জন। এর মধ্যে একমাত্র জেএমজি কার্গো ছাড়া বাকি এজেন্টগুলো সপ্তাহে ২-৩টির বেশি ফ্লাইটে কার্গো পণ্য দিতে পারে না। তাও এজেন্ট প্রতি তাদের সর্বোচ্চ ৩ টনের বেশি কার্গো হয় না। অভিযোগ আছে, যখন কোনো সিএসএ কার্গো পণ্য বুকিংয়ের জন্য বিমানের কাছে যাচ্ছে তখন বলা হচ্ছে স্পেস খালি নেই। অপরদিকে ফ্লাইট ছাড়ার আগ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টন কার্গো স্পেস খালি নিয়ে আকাশে উড়ছে বিমান। আবার বিমান কর্মকর্তাদের মাসোয়ারা না দেয়ার কারণেও অনেক এজেন্টের কাছে পর্যাপ্ত কার্গো পণ্য থাকলেও সেগুলো বুকিং নিচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রতি মাসে বড় অংকের টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে বিমান।
লন্ডন-ঢাকা রুটে ১০ মে ৪১৯ আসনের একটি ফ্লাইটে যাত্রী হয়েছিল ৯০ জন। পরের দিন ১১ মে যাত্রী হয়েছিল ১০১ জন। ১২ মে যাত্রী ছিলেন ১০৯ জন। ১৫ মে ওই ফ্লাইটে যাত্রী ছিলেন ১১০ জন। যা গড়ে আসন সংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ। এতে ফ্লাইটগুলোতে পর্যাপ্ত স্পেস থাকলেও শুধু সঠিক ম্যানেজমেন্টের কারণে অনেক জায়গা ফাঁকা রেখেই ফ্লাইট আকাশে উড়েছিল। ওই রুটের জেএমজি কার্গোর এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রতিটি ফ্লাইটে গড়ে ১২ থেকে ১৫ টন কার্গো দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে তাদের। কিন্তু বিমান কর্তৃপক্ষ অন্য এজেন্টকে সুযোগ দেয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে গড়ে ৭-৮ টনের বেশি কার্গো নিচ্ছেন না। অথচ শেষ পর্যন্ত অন্য সব এজেন্ট মিলে ৭-৮ টনের বেশি কার্গো হয় না। এতে গড়ে প্রতি ফ্লাইটে ৭ থেকে ১০ টন কার্গো ফাঁকা যাচ্ছে। অথচ আগে থেকে তাদের জানালে এ স্পেস ফাঁকা যেত না আর বিমান রাজস্ব হারাত না।
বিমানের মার্কেটিং বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করতে আন্তর্জাতিক স্টেশনের কার্গো পরিবহন অটোমেশন করা হবে। তখন কোনো এজেন্টের কাছে কতটুকু কার্গো আছে তা আগেই জানা যাবে। একই সঙ্গে প্রতি ফ্লাইটে কত টন স্পেস খালি আছে তাও আগে থেকে জানা যাবে। এতে সমন্বয় সহজ হবে। ফলে কোনো অনিয়ম থাকবে না। আর কার্গো পণ্য থাকার পরও যদি স্পেস খালি রেখে কোনো স্টেশন ফ্লাইট ছাড়ে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সহজ হবে। একই সঙ্গে দূর হবে অ্যাকসেস ব্যাগেজের অনিয়ম।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।