শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১০:৩৪ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
বিতর্কিত ভূমিকায় ইসি

আলী মামুদ : পূর্বসূরি কাজী রকিব উদ্দিন আহমদের মতোই বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ইসি সরকারের ইচ্ছা পূরণের ইসি হিসেবেই এগিয়ে চলেছে। আবির্ভুত হয়েছে নতুন আরেক প্রশ্নবিদ্ধ ইসি হিসেবে। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন অর্থাৎ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও তার ব্যর্থতার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেছে। খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনেই ভোট গ্রহণ নানা রকম প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। এখন দোরগোড়ায় এসেছে রাজধানী সন্নিহত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) নির্বাচন। সরকারি দলের এক প্রতিনিধি দলের নসিহত অনুযায়ী নির্বাচন আচরণ বিধি মালা সংশোধন করে এমপিদের জিসিসি নির্বাচন প্রচারণা অংশ নেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এর আগেই বিএনপির পক্ষ থেকে এ নির্বাচন কমিশন যে নিরপেক্ষ নয়, বলা হয়েছিল তার প্রমাণ মেলে। এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সাবেক কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন দৈনিক দিনকালকে গতকাল বলেন, নির্বাচন কমিশন দফায় দফায় নির্বাচনী বিধিমালা যে ভাবে পরিবর্তন করছে, তা হওয়া উচিত নয়। সুশাসনের জন্য নাগরিক বা সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যথারীতি মাঠে ময়দানে থেকে নির্বাচনী হালচাল পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি বলেন, ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব একটি অগাধ, সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। কিন্তু বর্তমান ইসির আচরণই প্রশ্নবিদ্ধ। তারা যে আচরণ করছেন, তা হতাশা ব্যঞ্জক। উল্লেখ্য, ইতিমধ্যে রাজশাহী বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট নগরীতেও নির্বাচনী তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। সরকার দলের প্রার্থীদের পক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা শুরু করেছে তারা। : সরকারের ইচ্ছাই পূরণ করছে ইসি : বস্তুত সরকারের ইচ্ছাপূরণেই কাজ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ইসির বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন এই প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। ইসি সূত্র জানায়, সরকারি দল আওয়ামী লীগ গত এপ্রিলে ইসির বৈঠক করে তিনটি দাবি জানিয়েছিল। সেগুলো হলো সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারের সুযোগ  দেয়া, সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন না আনা এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংস্কারের আগে তা আরও পর্যালোচনা করা। ইসির একজন কমিশনারের আপত্তির মুখে সিটি নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারের সুযোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। আরপিও সংস্কারকাজও আরও পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তন না আনার দাবি পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে পূরণ করেছে ইসি। : খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগের আপত্তি ছিল। ইসি ঢাকা থেকে একজন যুগ্ম সচিবকে সমন্বয়কারী করে খুলনায় পাঠায়। বিএনপির দাবি ছিল, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. হুমায়ূন কবীর এবং গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদকে প্রত্যাহার করা। ইসি সেই দাবি আমলে নেয়নি। : আবার অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপে জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার, ‘না’ ভোটের বিধান আবার চালু, প্রবাসীদের ভোটার ও ভোটাধিকার  দেয়া, বিভিন্ন ধাপে সংসদ নির্বাচন করে এক দিনে ফলাফল ঘোষণা করা, সংসদীয় আসনের সীমানা পুননির্ধারণ করার বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মত, প্রস্তাব ও দাবি এসেছিল। এই বিষয়গুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল এই অজুহাতে ইসি সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছে। : এসব পদক্ষেপের কারণে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন এই সংস্থা এখন সরকারের ইচ্ছাপূরণে বা সরকারের দেখানো পথে হাঁটছে, এমন আলোচনা সামনে এসেছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইসির বিভিন্ন পদক্ষেপে মানুষের মনে সন্দেহ জেগেছে। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, সরকারি দল বলল আর ইসি তা করল। ইসি কীভাবে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করবে, তা তাদের ঠিক করতে হবে। : নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর কুমিল্লা ও রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করে কিছুটা হলেও প্রশংসা কুড়িয়েছিল। কিন্তু অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের জবরদখল, প্রকাশ্যে ভোট  দেয়ার ঘটনা ইসিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সর্বশেষ খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসির দুর্বলতা প্রকটভাবে প্রকাশ পায়। গণগ্রেপ্তার এবং বাড়ি বাড়ি অভিযান চালিয়ে এক পক্ষকে মাঠছাড়া করা, পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা, বিভিন্ন কেন্দ্রে বুথ দখল করে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা, বিএনপির প্রার্থীর পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়াসহ বিভিন্ন অনিয়মে নীরবতার কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে ইসিকে। আনসার বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। : বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি শুরু থেকে বলে এসেছে, এই কমিশন নিরপেক্ষ নয়। এখন তাদের বিভিন্ন পদক্ষেপে প্রমাণিত হচ্ছে, সরকার যা যা চাইছে, ইসি তা-ই করছে। বিএনপির কোনো দাবির প্রতি তারা কর্ণপাত করছে না। ক্ষমতাসীনদের নীলনকশা বাস্তবায়নে কাজ করছে ইসি। : তবে সরকারের ইচ্ছাপূরণে ইসি কাজ করছে, এ কথা মানতে নারাজ ইসির সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। তিনি মিডিয়াকে বলেন, সরকারের ইচ্ছাপূরণে ইসি কাজ করছে না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ইসির অংশীজন। তারা যেকোনো বিষয়ে প্রস্তাব দিলে তা গ্রহণযোগ্য মনে হলে ইসি বিবেচনা করে। : তড়িঘড়ি বিধি সংশোধন : সাবেক আমলা প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল গত ১২ এপ্রিল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রচারের সুযোগ  দেয়ার দাবি জানায়। এর দেড় মাসের মাথায় অংশীজনদের কারও সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই সিটি করপোরেশন নির্বাচন আচরণ বিধিমালা সংশোধন করে নির্বাচন কমিশন। একজন নির্বাচন কমিশনার আপত্তি করলেও সেটা আমলে নেয়া হয়নি। : সীমানা নিয়ে পিছু হটা : গত জুলাইয়ে ইসির ঘোষিত কর্মপরিকল্পনায় আগামী নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছিল। এ জন্য নতুন করে আইন করার উদ্যোগও নিয়েছিল ইসি। তখন আওয়ামী লীগ সংলাপে অংশ নিয়ে জানিয়েছিল, তারা আগামী নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানায় পরিবর্তনের বিপক্ষে। এরপর ইসির নতুন আইন করার উদ্যোগ থেমে যায়। : : বিদ্যমান আইনে ৪০টি সংসদীয় আসনে পরিবর্তন প্রস্তাব করেছিল ইসি। প্রভাবশালী মন্ত্রী-সংসদ সদসদের অনেকে এই পরিবর্তনের প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হন। শুনানি শেষে শেষ পর্যন্ত মাত্র ২৫টি আসনে পরিবর্তন আনে ইসি। যেসব মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য তাঁদের সংসদীয় এলাকার সীমানায় পরিবর্তন প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, তাঁদের এলাকায় পরিবর্তন প্রস্তাব কার্যকর হয়নি। : ঝুলে গেছে আইন সংস্কার : ইসির ঘোষিত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী গত বছরের ডিসেম্বরে আইন সংস্কারের খসড়া প্রস্তুত এবং এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়ার কথা ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইসির আইন ও বিধিমালা সংস্কারসংক্রান্ত কমিটি আরপিওতে ৩৫টি সংশোধনী আনার সুপারিশ করেছিল। এগুলো নিয়ে গত ৯ ও ১২ এপ্রিল দুই দফা আলোচনা করে কমিশন। এরপর ১২ এপ্রিল বিকেলে আওয়ামী লীগ ইসিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, আরপিও সংস্কারের খসড়া যেন আরও পর্যালোচনা করা হয়। এ দাবি জানানোর ঘণ্টা দুয়েক আগেই ইসি সিদ্ধান্ত নেয় আরও পর্যালোচনা করার। সুপারিশগুলো আবার কমিটিতে ফেরত পাঠানো হয়। আগামী নির্বাচনের আগে আইন সংস্কার হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। : সরকারের দিকে তাকিয়ে : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত বছর নিজেদের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, নারীনেত্রী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপ করে ইসি। এতে আসা সুপারিশগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করে সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রস্তাব, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল প্রস্তাব এবং ইসির এখতিয়ারভুক্ত প্রস্তাব। এর মধ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার করা না-করা, ‘না’ ভোটের বিধান আবার চালু ও প্রবাসীদের ভোটার করার মতো আলোচিত সুপারিশগুলোকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় বলছে ইসি। : আরপিওতে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সেনাবাহিনীকে বিচারিক (ম্যাজিস্ট্রেসি) ক্ষমতা  দেয়ার দাবি ছিল বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলোর। আওয়ামী লীগসহ তাদের সমমনা কয়েকটি দলের অবস্থান এর বিপক্ষে। বিএনপির দাবি পূরণ করতে হলে আরপিও সংশোধন করতে হবে। সরকার না চাইলে তা সম্ভব নয়। সীমানা পুননির্ধারণ বাদে একইভাবে অন্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেও আইন সংশোধনের প্রশ্ন আছে। তবে ইসির আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটি আরপিও সংশোধনের যে প্রাথমিক খসড়া করেছে, তাতে সশস্ত্র বাহিনীকে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সংজ্ঞাভুক্ত করার কোনো সুপারিশ নেই। : আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হোক। বিএনপি এর বিপক্ষে। আরপিও সংশোধনীর খসড়ায় ইভিএমে ভোট নেয়ার সুযোগ রাখার বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবেও ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু ইসি তা আমলে নিচ্ছে না। : ইসির আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ ড. বদিউল আলম : সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মিডিয়াকে বলেন, ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা। এ জন্য যা যা প্রয়োজন তা তাদের করতে হবে, সিদ্ধান্ত বা উদ্যোগ নিতে হবে। যেগুলো সরকারের হাতে, সেগুলো সরকারকে প্রস্তাব দিতে হবে। কিন্তু ইসির পুরো আচরণ এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তারা বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। তারা যে আচরণ করছে, তা হতাশাব্যঞ্জক। : ইসির ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে- ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত : নির্বাচন কমিশনের সাবেক কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত সাখাওয়াত হোসেন গতকাল বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন দফায় দফায় যেভাবে বিধিমালা পরিবর্তন করছে তাতে প্রশ্ন ওঠায় স্বাভাবিক। এতে করে তাদের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠবে। এ রকম হওয়া উচিত না, বলেও তিনি অভিমত দেন। দৃশত: মনে হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে যা যা বলা হচ্ছে এই কমিশন তাই করছে। অথচ সামনে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন রয়েছে। জনগণ চায় নির্বাচন কমিশন জনগণের পক্ষে কাজ করুক।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।