শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০৮:৫৫ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
‘ওয়ান-ইলেভেন’ সম্পর্কে এতোদিন পর প্রকাশ করলেন ড. ইউনুস

ডেক্স রিপোর্ট :  বাংলাদেশে ‘ওয়ান ইলেভেনের’ সময় দীর্ঘ মেয়াদের জন্য কেয়ারটেকার সরকার প্রধান হওয়ার আকাঙ্খার কথা জোর গলায় অস্বীকার করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনুস।

এ বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি আবার নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে গবেষক-লেখক মহিউদ্দীন আহমেদের একটি লেখাকে কেন্দ্র করে। এই লেখায় গবেষক মহিউদ্দীন আহমেদ দুজন সেনা কর্মকর্তার বরাত দিয়ে লিখেছেন, মুহাম্মদ ইউনুস কেয়ারটেকার সরকার প্রধান হওয়ার প্রস্তাবে রাজী না হওয়ার প্রধান কারণ ছিল এই সরকারের স্বল্প মেয়াদ।

কিন্তু ইউনুস সেন্টার থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, ‘সেনাবাহিনীর প্রস্তাবে আমি কেন রাজী হইনি এ বিষয়ে যে কারণ তারা উল্লেখ করেছেন তা একেবারেই কল্পনাপ্রসূত। একেবারে হদ্দ বোকা না-হলে একজন অরাজনৈতিক বেসামরিক ব্যক্তি সেনাবাহিনীর নিকট তাঁকে দীর্ঘমেয়াদের জন্য একটি সরকারের প্রধানের পদে রাখার এরকম আবদার করার কথা কখনো চিন্তা করতে পারবে না।’

মুহাম্মদ ইউনুসের দীর্ঘ বিবৃতিতে ওয়ান ইলেভেনের সময় কিভাবে সেনা প্রধান মইন ইউ আহমেদ তাঁকে কেয়ারটেকার সরকার প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেন, কিভাবে এ নিয়ে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সেনা কর্মকর্তা জেনারেল মাসুদের সঙ্গে তার দীর্ঘ সময় বৈঠক হয় এবং কিভাবে তিনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।

বিবৃতিতে মুহাম্মদ ইউনুস বলছেন, ২০০৭ সালের ১০ জানুয়ারি বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তিনি সেনাপ্রধানের কাছ থেকে প্রথম টেলিফোন পান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি সে সময়ে আমার অফিসে গ্রামীণ ব্যাংকের দু’জন উর্দ্ধতন কর্মকর্তার সাথে আলাপ করছিলাম। সেনাপ্রধানের সাথে আমার কোনো পূর্ব পরিচয় ছিল না। তিনি তাঁর পরিচয় দিয়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেন। তিনি বললেন, দেশকে এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে রক্ষা করতে দেশ পরিচালনার জন্য সেনাবাহিনী একটি নতুন কেয়ারটেকার সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তাঁরা আমাকে এই সরকারের প্রধান করতে চান।’

মুহাম্মদ ইউনুস দাবি করছেন, তিনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং এজন্যে অন্য কাউকে খুঁজে নিতে বলেন।এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বোধহয় তিনি এমন একটি জবাবের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, বরং এমনটি আশা করছিলেন যে, আমি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে তাঁর প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাবো। তিনি তাঁর প্রস্তাবটা আবারো ঘুরিয়ে করলেন; সম্ভবত এমনটা ভেবে যে, আমি বোধহয় তাঁর প্রস্তাবটি বুঝতে পারিনি। আমি আবারো প্রস্তাবটা নাকচ করে দিলাম এবং বললাম যে, তাঁরা তাঁদের দ্বিতীয় পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়ে অগ্রসর হতে পারেন।’

মুহাম্মদ ইউনুসের ভাষ্য অনুযায়ী, এই টেলিফোন আলাপের সময় তার সামনে গ্রামীণ ব্যাংকের যে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন, তারা পুরো ঘটনা শুনে হতভম্ব হয়ে যান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, আমি এমন একটা প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছি যা কিনা অন্য যে-কেউ হলে তাৎক্ষণিকভাবে লুফে নিতো। আমি আমার সহকর্মীদের বললাম যে, আমি একেবারে সঠিক কাজটিই করেছি। কিন্তু তাঁরা আমার জবাবে খুবই বিস্মিত ও হতাশ হলেন।’

জেনারেল মাসুদের সঙ্গে বৈঠক: মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে এরপর একজন উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার যে দীর্ঘ বৈঠক হয় এই কেয়ারটেকার সরকার প্রধান হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে, বিবৃতিতে তিনি সেটিরও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর আমি আরেকটি টেলিফোন পেলাম। আমি তখনো অফিসে। জেনারেল মাসুদ বললেন যে, তিনি আমার সাথে দেখা করতে আমার বাসায় আসতে চান। যেহেতু সাক্ষাৎ করতে ‘না’ করার কোনো উপায় ছিল না, আমি তাঁকে আটটায় আসতে বললাম।’

এরপর সেনাবাহিনীর সেসময়ের খুবই প্রভাবশালী একজন কর্মকর্তা জেনারেল মাসুদউদ্দীন চৌধুরী কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং জওয়ানকে নিয়ে মুহাম্মদ ইউনুসের বাসায় যান। মুহাম্মদ ইউনূস তার বিবৃতিতে বলেন, ‘জেনারেল মাসুদ ব্রিগেডিয়ার আমিন ও পাঁচ-ছয়জন জওয়ানসহ গ্রামীণ ব্যাংক কমপ্লেক্সে আমার বাসভবনে এলেন। আমি তাঁদের স্বাগত জানালাম এবং একটি ছোট কক্ষে নিয়ে গেলাম। তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিলেন এবং অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁদের আসার উদ্দেশ্য জানালেন। আমি আমার অপারগতার কথা যতবারই বলতে থাকলাম, তাঁরাও তত বেশী বিনয়ী ও নাছোড়বান্দা হতে থাকলেন।’

এই আলোচনা নাকি চলেছিল প্রায় তিন ঘন্টা ধরে। কিন্তু মুহাম্মদ ইউনুস তাদের প্রস্তাবে রাজী না হয়ে বরং বিকল্প হিসেবে অন্য কিছু নাম প্রস্তাব করেন। সেই তালিকা থেকেই তাঁর বন্ধু ড: ফখরুদ্দীন আহমেদকে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান করা হয়।

জেনারেল মইন ইউ আহমেদের ভাষ্য: মুহাম্মদ ইউনুসকে কেয়ারটেকার সরকার প্রধান করার প্রস্তাব নিয়ে এই ঘটনার বর্ণনা মইন ইউ আহমেদের নিজের লেখা একটি বইতেও আছে। ‘শান্তির স্বপ্নে’ নামে বইটি প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। এতে জেনারেল আহমেদ লিখেছেন, বঙ্গভবনেই প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দীন তাদের দুটো নাম প্রস্তাব করেছিলেন, একজন শান্তিতে নোবেল-জয়ী মুহাম্মদ ইউনুস, অপরজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমেদ।

প্রফেসর ইউনুসকে প্রথম ফোনটি করেন জেনারেল আহমেদ। প্রফেসর ইউনুস অস্বীকৃতি জানান। ‘তিনি বললেন, বাংলাদেশকে তিনি যেমন দেখতে চান সেরকম বাংলাদেশ গড়তে খণ্ডকালীন সময় যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশকে আরো দীর্ঘ সময় ধরে সেবা দিতে আগ্রহী। সেই মুহূর্তে ড. ইউনুসের কথার মর্মার্থ বুঝিনি……..পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি তিনি একটি রাজনৈতিক দল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন যদিও পরিস্থিতির কারণে তাকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়েছিল।’

ড. ফখরুদ্দীন আহমেদকে ফোন করে ঘুম থেকে জাগানো হয় গভীর রাতে। প্রধান উপদেষ্টা হবার আমন্ত্রণ পেয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার জন্য সময় চান তিনি। আধ ঘণ্টা পর ফিরতি ফোনে সম্মতি জানান। ওই দিনটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনাবহুল দিন নাইন-ইলেভেনের মত করে এক-এগারো হিসেবে অভিহিত করার সিদ্ধান্তও তারাই নিয়েছিলেন বলে বইতে লিখেছেন মইন ইউ আহমেদ।

এতদিন পরে কেন প্রতিবাদ: যার লেখার সূত্র ধরে মুহাম্মদ ইউনুস ওয়ান ইলেভেনের ঘটনাবলী সম্পর্কে তাঁর ভূমিকার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেই গবেষক-লেখক মহিউদ্দীন আহমেদ অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, এতদিন পর কেন মুহাম্মদ ইউনুস এই ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।

বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, মুহাম্মদ ইউনুস যে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান হতে আকাঙ্খা প্রকাশ করেছিলেন, সেই কথা বহুদিন ধরেই রাজনৈতিক মহলে আলোচনায় আছে। জেনারেল মইন ইউ আহমেদের লেখা বইতেও এর উল্লেখ আছে।

এতে বলা হয়, ‘এ বিষয়টা কিন্তু পাবলিক ডিসকাশনে ছিল। গুঞ্জন হিসেবেই হোক, যেভাবেই হোক। অধ্যাপক ইউনুস কেন এগারো বছর পর মুখ খুললেন আমি জানি না। তবে এই প্রথম এই বিষয়ে আমরা তার বক্তব্য পেলাম। এখন কে ঠিক বলছেন, কে বলছেন না, সেটা বিচার করা মুশকিল।’

মহিউদ্দীন আহমেদ জানান, প্রথম আলোতে প্রকাশিত যে লেখাটির সূত্র ধরে এই বিতর্ক শুরু হয়েছে, সেটি তাঁর প্রকাশিতব্য একটি গবেষণামূলক বইয়ের অংশ। তিনি বলেন, ‘এক এগারো নিয়ে আমি একটি গবেষণার কাজ করছি।সেখানে আমি এক এগারোর সঙ্গে সম্পর্কিত অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। প্রথম আলোতে প্রকাশিত লেখাটি এই বইয়েরই খসড়ার একটি অংশ।’

মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, এই গবেষণার অংশ হিসেবে তিনি সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ এবং ডিজিএফআই এর সাবেক একজন কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফজলুল বারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অতি সম্প্রতি। মুহাম্মদ ইউনুস সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন, তা মূলত এই দুজনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে লেখা।

এতে তিনি আরও লিখেছেন, ‘এই সাক্ষাৎকারে তারা জানিয়েছেন, কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান করার প্রস্তাব নিয়ে তারা মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে যান, কিন্তু তিনি এত অল্প সময়ের জন্য কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান হতে চাননি। তখন বিকল্প হিসেবে তারা ড: ফখরুদ্দীন আহমেদের কাছে যান।’

মহিউদ্দীন আহমেদ জানান, তিনি এই গবেষণার জন্য তিনি ওয়ান ইলেভেনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র জেনারেল মাসুদ উদ্দীন চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সাক্ষাৎকার পাওয়া যায়নি। তার বইটি শীঘ্রই প্রকাশিত হবে বলে তিনি আশা করছেন।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।