রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৩:৪৭ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
গরিবের চক্ষু হাসপাতাল ; বাংলাদেশ আই ট্রাস্ট হাসপাতাল

নিউজ ডেক্স : পাবনার সুজানগরে বাস করেন রহিতন। নিজের বয়স নিজে বলতে পারেন না। দারিদ্র্য আর নানা রকম রোগের কারণে বয়সের চেয়ে বেশি বুড়িয়ে গেছেন। গত কয়েক বছর ধরে তিনি চোখে দেখতেন না। পরিবারের ওপর বোঝাতো হয়েই ছিলেন। আবার নিজের কাজ নিজে করতে পারতেন না বলে অনেক অমানবিক জীবন-যাপন করতে হয়েছে। কেউ খেতে দিলে আগে মাটি হাতরে নোংরা ঘেঁটে ভাতের প্লেটে হাত দিয়েছেন। কিন্তু চোখের দৃষ্টি ফিরে পেয়ে আজ যেন নতুন জীবনের শুরু বলে মনে করছেন তিনি।

চোখে-মুখে আনন্দ নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি জানান, এখন আমি নিজের কাজ নিজে করতে পারব। আর তার চিকিত্সক ডা. মাহজিবা রহমান চৌধুরী বলেন, যে মুহূর্তে রহিতন চোখে দেখতে পেলেন সে মুহূর্তে তার হাসিময় মুখখানা ভোলার নয়। এমন আর কোনো ঘটনা কি তার কর্মজীবনে আছে জানতে চাইলে তিনি জানান, অনেক ঘটনাই আছে। তবে এই মুর্হূতে মনে পড়ছে সিরাজগঞ্জ থেকে আসা এক দম্পতির কথা। তাদের ছোট্ট ছেলে ছানির কারণে দেখতে পাচ্ছিল না। তারা ভাবছিলেন অন্ধ ছেলে জীবনে কি আর করতে পারবে। কিন্তু যখন তার ছানি অপসারণ করা হয়, আর সে দেখতে পায় তখন পৃথিবীর সব আনন্দ ধরা দেয় এই বাবা-মা কাছে।

রাজধানীর রায়ের বাজার ঢালে অবস্থিত বাংলাদেশ আই ট্রাস্ট হাসপাতালে কথা হচ্ছিল তাদের সঙ্গে। এখানেই দরিদ্র প্রান্তিক মানুষের চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া হয় ফ্যাকো সার্জারির মাধ্যমে। ফ্যাকো বিশ্বের সর্বাধুনিক পদ্ধতি। বাংলাদেশ আই ট্রাস্ট হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে এই অপারেশনসহ অত্যাধুনিক অক্লোপ্লাস্টি বা জন্মগত বাঁকা চোখের চিকিত্সা করা হয়। গত ছয় বছরে বিনা মূল্যে ১০ হাজার প্রান্তিক মানুষের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছে তারা।

এখানে বিনা মূল্যে ছানি অপারেশন আয়োজন করতে ১৪ জন চিকিত্সকের একটি দল আছে। ডা. মাহজিবা রহমান চৌধুরী এই দলের সমন্বয়ক। তিনি জানান, অভিজ্ঞ ও শীর্ষ চিকিত্সকরা এখানে অপারেশন করেন এবং রোগী দেখেন। মানুষকে অন্ধত্ব থেকে বাঁচাতে তারা দেশের যে সব এলাকায় চোখের ভালো চিকিত্সা ব্যবস্থা নেই সে সব এলাকায় ক্যাম্প করে রোগী নিয়ে আসেন।

হাসপাতালে এনে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিতে পরীক্ষা করে তাদের সর্বাধুনিক চিকিত্সা দেওয়া হয়। কীভাবে তা সম্ভব জানতে চাইলে বাংলাদেশ আই হাসপাতাল এবং বাংলাদেশ আই ট্রাস্ট হাসপাতালের অন্যতম পরিচালক ইশতিয়াক আনোয়ার ইত্তেফাককে বলেন, আমরা তিন ভাবে এই হাসপাতালের ব্যয়ভার বহন করি। প্রথমত হাসপাতালটা একটু পেছনের দিকে রায়ের বাজার ঢালে, বাসাভাড়া কম। কিছু পেইং সেকশন রাখা হয়েছে, মধ্যবিত্ত অনেক রোগী অন্য হাপাতালের তিন ভাগের একভাগ খরচে এখানে চিকিত্সা করান। বছর জুড়ে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে আয় করা হয়।

দেশের ৮০ জন চিকিত্সক ট্রেনিং নেন। তারা গত এক বছরে ২০ হাজার রোগীর অপারেশন করেন। এর বাইরে ১৩টি দেশের ৩৯ জন চিকিত্সক এখানে ট্রেনিং নিয়েছেন। তাদের মধ্যে নাইজেরিয়া , জার্মানি, সৌদি আরব, কাতার এসব দেশের চিকিত্ক আছেন। এছাড়া কিছু বন্ধু দাতা আছেন। তিনি জানান, প্রতি মাসে পাঁচ-সাতটি ক্যাম্প করে ৭০০ অপারেশন করা হয় এই হাসপাতালে। কিন্তু কোভিডের জন্য এখন ১০০ থেকে ১৫০টি অপারেশন করা হচ্ছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি এখানে ব্যবহার করা হয়। চোখের অন্য কোনো সমস্যা নিয়ে এলে কি তাদের ফিরে যেতে হয়—এমন প্রশ্নের জবাবে কর্তৃপক্ষ জানায়, চোখের ছানির পাশাপাশি কর্ণিয়াসহ অন্য যে কোনো সমস্যা নিয়ে এলেও কাউকে ফিরে যেতে হয় না। বাংলাদেশ আই হাসপাতালে নিয়ে তাদের যথাসম্ভব কম খরচে চিকিত্সা করা হয়। কেউ একেবারে টাকা না দিতে পারলে হাসপাতালের চিকিত্সকরা নিজেদের খরচে তাদের চিকিত্সা করান।

কীভাবে শুরু হয় এই আই ট্রাস্ট হাসপাতাল তা জানালেন, বাংলাদেশ আই হাসপাতাল ও আই ট্রাস্ট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়াজ আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, অন্য চিকিত্সকের সঙ্গে চক্ষু চিকিত্সকের একটা বড় পার্থক্য হল তাদের চিকিত্সা করতে অনেক দামি যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু অনেক চক্ষু চিকিত্সকের এমন দামি যন্ত্রপাতি কেনার সামর্থ থাকে না।

আমার ও আমার বন্ধু বড় ভাই ডা. মাহবুবুর রহমানের ভালো প্র্যাকটিস ছিল। আমরা এমন একটা হাসপাতাল করার কথা ভাবি যেখানে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতিতে আমাদের চিকিত্সকরা চিকিত্সা করতে পারবেন। দশ জনের শক্তি অনেক বেশি। এসময় চোখের আধুনিক চিকিত্সার জন্য অনেক মানুষ দেশের বাইরে যেতেন। আমরা আধুনিক চিকিত্সা দেশে দিতে পারলে তারা বিদেশে যাবে না। এই ভাবনা থেকে ধানমন্ডি ৬-এ ২০০৪ সালে ছোট করে শুরু হয় বাংলাদেশ আই হাসপাতাল। তখন বহু মানুষ দেশে চিকিত্সা করান। আমরা ২০১২ সালে ২৭ নভেম্বরে নিজেদের ভবনে আসি।

অন্য হাসপাতালের সঙ্গে এর পার্থক্য হল এখানের প্রত্যেক চিকিত্সকই এর মালিক। আমাদের সঙ্গে ক্রমেই অন্য অনেকে যোগ দেন। এভাবে এখন খুলনা চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় ৯টি শাখা হয়। আমরা অনুভব করি আমদের এই চিকিত্সাটা একটু ব্যয়বহুল। দামি যন্ত্রপাতি দিয়ে কমদামে চিকিত্সা আমরা দিতে পারি না। তাই সাধারণ মানুষ সুযোগ পায় না। এই ভাবনা থেকে বাংলাদেশ আই ট্রাস্ট হাসপাতাল হয়। ট্রাস্ট হাসপাতালে এই যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে। তাই পরিচালকরা তাদের দুই বছরের লভ্যাংশ না নিয়ে ফান্ড গঠন করেন।

২০১৪ সালে ট্রাস্ট হাসপাতালের পথ চলা শুরু জানিয়ে নিয়াজ আব্দুর রহমান বলেন, আমরা গরীব, অসহায় রোগীর কাছ থেকে কোনো অর্থ না নিয়ে বিনা পয়সায় চিকিত্সা সেবা দেই। এখন পর্যন্ত ট্রাস্ট হাসপাতালের কোনো গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স নেই। কিন্তু স্বপ্ন আছে একদিন ট্রাস্ট হাসপাতাল এমন একটি হাসপাতাল হবে যেখানে দেশের উচ্চ থেকে নিম্নবিত্ত মানুষ আধুনিক চক্ষু চিকিত্সা পাবেন।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।