শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ০৮:৫৪ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
ডলার সংকট চরমে

বাণিজ্য ডেক্স : চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ডলার বাজার। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সময়মতো বিদেশি ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ফলে গুণতে হচ্ছে জরিমানা। বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতে যেয়ে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংকগুলো। আর এ অবস্থার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে। এদিকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বাজারে ডলার ছাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে তাতেও বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। বেড়ে যাচ্ছে ডলারের দাম। কমছে টাকার মান।

রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এমন অবস্থার তৈরি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। অন্যদিকে রেমিট্যান্স আয়েও আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। অন্যদিকে বিদেশি ঋণের সুদহারও এখন বাড়তির দিকে। ওইসব ঋণ এখন পরিশোধ করায় চাপ পড়ছে ডলারের উপর। এমন পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ঠিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার লেনদেনের বিষয়ে বিভিন্ন সীমা বেঁধে দিলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে সংকট ঘণীভূত হচ্ছে। যদিও এটাকে সাময়িক বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।

ডলার সংকট বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগের বছরে ব্যাপকহারে আমদানি হওয়ায় এখন ডলার সংকট হচ্ছে। ওই সময়ে রপ্তানির চেয়ে আমদানি অনেক বেশি ছিল। তবে বর্তমানে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ভাল হচ্ছে। আমদানিও কমতে শুরু করেছে। শিগগিরই অবস্থার উন্নতি হবে বলে তিনি মনে করছেন। তবে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্রিয় থাকার কোন বিকল্প নেই।

অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারি আমদানির বড় অংশের পেমেন্ট দেওয়া হয়। এ বিষয়ে এ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী শামস-উল-ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ২০ মিলিয়ন ডলার চাইলে, তারা যদি ১৫ মিলিয়ন ডলার দেয় বাকিটা ব্যাংকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মেটানো হয়। ডলার সংকটের এ অবস্থা সাময়িক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতার মাধ্যমে শিগগিরই অবস্থা ভাল হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, রপ্তানি, রেমিট্যান্স আয়ের সঙ্গে আমদানি ব্যয়ের একটা অসামঞ্জস্য হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এর ফলে দাম বেড়ে যাচ্ছে। আর চাহিদা অনুযায়ী ডলারও দিতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম আবারও বেড়েছে। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রতি ডলারে ৫ পয়সা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৪ টাকা ১৫ পয়সায়। গত মাসের শেষদিকেও প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা ১০ পয়সা। গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের দাম ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা মূল্য বেধে দেয়। এপর থেকে পর্যায়ক্রমে ডলারের দাম বাড়ছে। তবে এক রকম ঘোষণা দিয়ে আরেক দামে ডলার বিক্রির অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে। এর আগে মিথ্যা ঘোষণা দেওয়ার দায়ে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী বেশিরভাগ ব্যাংককে সতর্ক করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

ডলারবাজার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ১৫৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। আর ডলার বিক্রি করায় কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বর্তমানে রিজার্ভ কমে প্রায় তিন হাজার ১০০ কোটি (৩১ বিলিয়ন) ডলার হয়ে গেছে। যেখানে গত বছর একই সময়ে তিন হাজার ২২৭ কোটি (৩২ বিলিয়ন) ডলার ছিল।

গত বছরের ২১ মে থেকে ডলার ৮৩ টাকা ৭০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল। পরে ২৮ জুন থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তব্যাংক ডলারের মূল্য ছিল ৮৩ টাকা ৭৫ পয়সা। এভাবে পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে এখন ৮৪ টাকা ১৫ পয়সা হয়ে গেছে। এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের কাছে যে দামে ডলার বেচাকেনা করে, তা আন্তঃব্যাংক দাম হিসেবে বিবেচিত। টাকা-ডলার বিনিময় হার গত বছরের একই সময়ে ছিল ৮২ টাকা ৯৬ পয়সা। সে হিসাবে এক বছরে ডলারের দাম এক টাকা ১৯ পয়সা বেড়েছে। আর ২০১৬ সালের অক্টোবরের প্রথমে টাকা-ডলারের বিনিময় হার ছিল ৭৮ টাকা ৪০ পয়সা। সে হিসাবে সে সময়ের তুলনায় পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সা বেড়েছে। আন্তঃব্যাংক লেনদেনের বাইরে কার্ব মার্কেটে (খোলা বাজারে) ডলারের দাম আরো বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে দেখা গেছে, রেমিট্যান্স আয়ে প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত হচ্ছে না। মাঝে মাঝেই এ খাতের আয় অনেক কমে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৭৪৯ কোটি ৬৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা। এ সময়ে রপ্তানি আয়েও কাঙ্ক্ষিত গতি আসেনি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে আয় করেছে দুই হাজার ৫০ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আমদানিতে ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

এদিকে এখনো প্রচুর পরিমাণে আমদানি হচ্ছে। প্রেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এখন দৈনিক ৪৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করা হচ্ছে। আর বার্ষিক সাড়ে সাত লাখ মেট্রিক টন এলপিজি (তরলীকৃত প্রেট্রোলিয়াম গ্যাস) এখন আমদানি হয়। এর পাশাপাশি অন্যান্য আমদানি পণ্য তো রয়েছেই। এজন্য ডলার সংকট কতটা কাটবে সে বিষয়ে শঙ্কা রয়েই যাচ্ছে।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।