মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ০১:১৩ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
তথাকথিত ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকারান্তে একেকটি কারাগার : অরিত্রি কত প্রশ্ন রেখে গেল!

ভিকারুননিসা স্কুলের ছাত্রী অরিত্রি আত্মহত্যা করেছে। যে কারণেই করুক, ঘটনাটা দুঃখজনক, বেদনাদায়ক। স্কুল কর্তৃপক্ষের বরাতে সংবাদমাধ্যম বলছে, পরীক্ষায় মোবাইল ফোনে নকল করেছিল অরিত্রি। এ জন্য তার বাবা-মাকে কর্তৃপক্ষ স্কুলে ডেকে পাঠায়। বাবা-মার অনুরোধ ও অরিত্রির পায়ে-পড়াতেও কাজ হয়নি। মেয়েটিকে টিসি দিয়ে স্কুল থেকে বহিস্কার করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, লজ্জা ও বাবা-মার অপমান সে সইতে পারেনি। গলায় ফাঁস দেয় অরিত্রি। এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে। মামলা হয়েছে। তদন্ত কমিটি হয়েছে। সবাই দায়ী করছেন শিক্ষকদের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষকদের ধুয়ে দেওয়া হচ্ছে। কসাই বলা হচ্ছে। পেশায় শিক্ষক হিসেবে আমি এ ঘটনায় অত্যন্ত বিব্রত ও লজ্জিত। কিন্তু সরলীকরণ করে শিক্ষকদের এককভাবে দায়ী করাকেও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। শিক্ষকদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বটে; কিন্তু ঘটনার পেছনে সক্রিয় অন্য কারণগুলোকে উপেক্ষা করা হবে অন্যায়।

একটি বিশেষ পরিস্থিতি অরিত্রিকে আত্মহননের দিকে নিয়ে গেছে। সে ঘটনায় শিক্ষক প্রাসঙ্গিক ছিলেন বলে দায় পড়ছে তার ওপর। কিন্তু এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়, কার্যকারণ ছাড়া ঘটে না। শিক্ষকদের দায় মাথা পেতে নিয়েও বলা যায়, অরিত্রির মৃত্যু আমাদের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার বিষময় ফল। অরিত্রির মৃত্যু আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধে ধস নামার ফল। অরিত্রির মৃত্যু আমাদের আনন্দ ও আশাহীন জীবন চেতনার ফল।

আমাদের দেশের তথাকথিত ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকারান্তরে একেকটি কারাগার। আমার ছোট ছেলে মতিঝিলের এমনি একটি নামকরা কারাগারের কয়েদি। আমি জানি, কী নিরানন্দ তার স্কুলজীবন! বাড়ির কাজ আর পরীক্ষার চাপে তার জীবন ত্রাহি ত্রাহি। আমি তার স্কুলে যতবার গিয়েছি ততবার অনুতাপে দগ্ধ হয়েছি। তাকে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাকে জীবনের সবচেয়ে খারাপ সিদ্ধান্ত হিসেবে মানি। স্কুলটিকে মনে হয়, বিরাট একটা মানব-খোঁয়াড়। মানুষে গিজগিজ, তবু কেউ যেন কাউকে চেনে না। এখানে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে শিক্ষকদের আচরণ নীরস, রূঢ়। শিক্ষকরা হাসিমুখে কথা বলতে জানেন না।

আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠান যত ভালো বলে স্বীকৃত, তার শিক্ষকরা তত বেশি ক্লান্ত। ছাত্র-শিক্ষকের অবাস্তব অনুপাতের কারণে বৃহদাকৃতির অধিক সংখ্যক ক্লাস, পরীক্ষা ও অন্যান্য কাজে শিক্ষকরা গলদঘর্ম। আছে প্রশাসন ও পরিচালনা পরিষদের চাপানো নানা উটকো কাজ। আরও আছে প্রাইভেট টিউশনির বাণিজ্যিক বলয়, অর্থের অন্ধ মোহ। ফলে অধিকাংশ শিক্ষক পরিশ্রান্ত, পেশাগত ব্রত থেকে বহু দূরে বেনিয়া সমাজের বাসিন্দা। যান্ত্রিক ও কৃত্রিম জীবনচেতনার এই শিক্ষকদের কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করার থাকে না।

অরিত্রির মৃত্যুর জন্য প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরা দায়ী হলে তার বাবা-মা দায় এড়ান কীভাবে? নবম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়া কি ঠিক হয়েছে? সবাই কেন তার সন্তানকে ক্লাসে ফার্স্ট দেখতে চান? কেন ভিকারুননিসা-আইডিয়াল-নটর ডেমে সন্তানদের পড়াতে না পারলে জীবন বৃথা ভাবতে হবে? কেন তথাকথিত ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য লাখ লাখ টাকা অন্যায় পথে ঢালতে হবে? আমাদের সমাজ চরমভাবে ফলবাদী। পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই ফল সব সময়, সবার জন্য সুপকস্ফ হওয়া চাই। এখানে কোনো কারণে কেউ ফল খারাপ করলে তাকে বিফল ভাবা হয়। অরিত্রিকে ভালো ফলের জন্য মরিয়া হয়ে নকল করতে বাধ্য করেছিল আসলে আমাদের সমাজ। পরীক্ষায় ফেল করলে মুখ দেখানো যাবে না, স্কুলও দেবে টিসি। অরিত্রির করুণ পরিণতির জন্য সমাজ তাই দায় এড়াতে পারে না। দায়মুক্ত নয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। এই সমাজ তো এই সবকই দিচ্ছে- যেভাবেই পার, যে পথেই হোক, নিজের লাভটা বুঝে নাও। সাফল্যটা বড়; পথটা নয়। কাজেই অরিত্রি পাসকেই বড় করে দেখেছে; পাসের পথকে নয়।

মানুষের জীবন ছোট এবং একটাই। তাই জীবন মহামূল্য। জীবনের মূল্য সম্পর্কে সচেতন করাও শিক্ষার অংশ। তাই শিক্ষার্থীদের সুস্থ মনোজগৎ সৃষ্টির জন্য উন্নত বিশ্বে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে মনোবিদ, কাউন্সেলিং টিম থাকেন। সহপাঠ্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষাজীবনকে আনন্দঘন করা হয়। সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত করে শিক্ষার্থীদের মাঝে দায়িত্ববোধ জন্মানো হয়। আমাদের দেশে এসবের বালাই নেই। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে জীবন বিকাশের বদলে আছে জীবনপীড়ক সব উপাদান। জীবনকে ভালোবাসতে শেখানো, জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করার কাজটি পরিবারের অন্যতম কর্তব্য। বেঁচে থাকা বা বড় হওয়াটা যে শুধু নিজের জন্য নয়- আমাদের দেশে এটা কয়টা পরিবারে শিক্ষা দেওয়া হয়?

একটি বিষয় বলতেই হচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এত নিষ্ঠুর, এত কঠোর হবে কেন? প্রতিষ্ঠানপ্রধানই-বা এমন অনড় হবেন কেন? মেয়েটি ভুল স্বীকার করেছে, তার বাবা-মা মাথা নত করেছেন। তারপরও অধ্যক্ষের ক্ষমাহীন থাকাটা অমানবিক মনে হয়। ক্ষমা ও উদারতাকে বাদ দিলে শিক্ষায় থাকেটা আর কী? মেয়েটিকে ভুল শোধরানোর সুযোগ না দেওয়াটা যে কত বড় ভুল ছিল- তার প্রমাণ অরিত্রির করুণ পরিণতি। প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার কারণে অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ কঠোর অবস্থান নিতেই পারেন। কিন্তু সেই কঠোরতারও একটা নমনীয় দিক থাকতে পারত। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-

দণ্ডিতের সাথে দণ্ড দাতা / কাঁদে যবে সমান আঘাতে / সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।
অরিত্রি এই সহানুভূতিটুকু থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলেই সে আর ধরিত্রীর বুকে নেই। সহযোগী অধ্যাপক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা/ লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ, লক্ষ্মীপুর

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।