মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ০২:২৯ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
প্রতিদিন আত্মহত্যা করে ২৯ জনের বেশি

একুশে বার্তা ডেক্স : পরশু সারারাত জেগে আমার পাণ্ডুলিপি পড়ে শোনালাম, তুই এত মুগ্ধ হচ্ছিলি যে আমার লজ্জা আর গর্ব মিলেমিশে লাফানো শুরু করেছিল। শেষটা বাকি ছিল লেখা, তুই আর আমি কত অ্যাঙ্গেল থেকে ভাবলাম কিভাবে আরও ইন্টারেস্টিং করা যায়। তো একদিন পরই কি হলো এমন? বল? বল? নাহলে কোনও দিন আর তোকে মনে করব না। করব না।’

গত ১৫ জানুয়ারি আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া সন্তানের উদ্দেশে ফেসবুকে কবি রাহিমা আফরোজ মুন্নীর এমন আবেগঘন পোস্ট চোখ ভিজিয়েছে অনেকের। ওইদিন ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন মুন্নীর ২০ বছরের মেয়ে চিত্রশিল্পী আফ্রিদা তানজিম মাহি। একটি বৃত্তিতে আগামী মাসে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সবকিছু ঠিকঠিক ছিল মেয়েটির। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে গ্যালারি কলাকেন্দ্রে চলছিল তার প্রথম চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। সব কিছু এত সাজানো গোছানো থাকার পরও মাহির এভাবে চলে যাওয়া মানতে পারছেন না তার মা। কখনও অভিমান, কখনও রাগ আবার কখনও মমতা ভরা পোস্ট লিখে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করছেন তিনি।

শুধু মাহি নয়, এভাবে জীবনের মায়া ছেড়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন বিভিন্ন বয়সীরা। কিন্তু এমন মৃত্যুতে ভেঙে পড়ছেন স্বজনরা।

গত ২১ জানুয়ারি সাতক্ষীরার সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোস্তফা লুতফুল্লাহর একমাত্র ছেলে অনিক আজিজ (২৬) নিজেদের ফ্ল্যাটে ইন্টারনেটের তার দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। এরপর ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর সবুজবাগে এক গৃহবধু পারিবারিক অশান্তির জের ধরে প্রথমে দেড় বছরের মেয়েকে হত্যা করেন। তারপর নিজেও ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘প্রিভেনটিং সুইসাইড: অ্যা সোর্স ফর মিডিয়া প্রফেশনালস ২০১৭’-এ বলা হয়,  প্রতি বছর বিশ্বে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে একটি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে এই সংখ্যা প্রতি ২০ সেকেন্ডে একজনে পৌঁছুবে। একই প্রকাশনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যা আরও বলছে, গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ৬০ শতাংশ  বেড়েছে। বিশ্বে বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানসিক চাপ, হতাশা, অবসাদ ও  হেনস্থার শিকার হয়ে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। আবার আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও পারিবারিক সংকটের কারণেও অনেকে আত্মহত্যা করে।

যুক্তরাষ্ট্রের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট সাইকোলজি টুডেতে প্রকাশিত ‘সুইসাইড: ওয়ান অব অ্যাডিকশনস হিডেন রিস্ক’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা আত্মহত্যা করেন তাদের তিনজনের মধ্যে একজন মাদকাসক্তের কারণে এই পথ বেছে নেন। আর ৭৫ শতাংশ মাদকাসক্তই আত্মহত্যার চিন্তা করেন।

দেশে আত্মহত্যার ঘটনার তথ্য রাখে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। ওই তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশে আত্মহত্যা করেন ১০ হাজার ৭৪৯ জন। আর ২০১৭ সালে নভেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ২৫৬ জন। বছর শেষে এই সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই বেড়েছে। ডিএমপির গত দুই বছরের এই হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৯ জনের বেশি আত্মহত্যা করছেন। এসব আত্মহত্যার বেশিরভাগই ফাঁসিতে ঝুলে। এছাড়া বিষপান ও আগুনে পুড়ে আত্মহননের ঘটনা ঘটছে।

কেন এই আত্মহত্যার প্রবণতা? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রধান ড. মো. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘আত্মহত্যার অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে একটি হলো- মানসিক চাপ। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু মানসিক চাপ থাকে। চাপটা বেশি হয়ে গেলে কারও কারও মনে হয়, তিনি আর সমস্যার সমাধান করতে পারছেন না। পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না। তখন জীবন থেকে পালানো বা আত্মহত্যার পথটাই তার কাছে সহজ মনে হয়।’

ড. মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘বিষন্নতায় যারা ভোগেন তাদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে। কারণ জীবন নিয়ে তাদের মধ্যে প্রচণ্ড নেতিবাচক ধারণা কাজ করে।’ সাম্প্রতিক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানান, ছেলেবেলা থেকে যাদের নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না তাদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা কাজ করে।

তিনি বলেন, ‘কারো মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা গেলে দ্রুত তাকে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, সব ধরনের সংকট থেকেই বেরিয়ে আসা সম্ভব।’

মো. কামরুজ্জামানের বলেন, ‘আগের মতো সামাজিক বন্ধন এখন নেই। আত্মহত্যা প্রতিরোধে ওই বন্ধন ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারকেও উদ্যোগী হতে হবে।’

দেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করে ‘স্কুল ফর সোস্যাল এন্টারপ্রিনারস’। সংস্থাটির সভাপতি শেখ মোহাম্মদ ইউসুফও মনে করেন, আত্মহত্যা রোধে সামাজিক বন্ধন ফিরিয়ে আনা জরুরি। তিনি বলেন, ‘এখন সবাই ঘরমুখী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও জীবনমুখী নয়। ফলে লেখাপড়া শেষে অনেকে বিষয় অনুযায়ী কাজের সুযোগ পান না। আবার অনেক পরিবার সন্তানের পছন্দ কিংবা মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের পছন্দ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

তার মতে, এখনকার তরুণরা অনেক ধরনের সাংগঠনিক কাজে অংশগ্রহণ করে। কেউ কেউ আবার বুঝতে পারে না কি করবে। যারা বুঝতে পারে না, তাদেরকে কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। জীবনের কোন পরিস্থিতিতে কেউ যাতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আত্মহননের পথ বেছে না নেয় সেদিকে সবার নজর রাখতে হবে মনে করেন শেখ মোহাম্মদ ইউসুফ।সমকাল

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।