রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫:০০ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
‘বেবি লীগ’ তাহলে হচ্ছে না!

ডেক্স প্রতিবেদন : বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ব্যস্ততম মুরাদপুর। গত ২৪ ডিসেম্বর রোববার তখন সকাল সাড়ে ৭টা। যাত্রী ছাউনীর পাশে একটি মিনিবাস অপেক্ষা করছে। ব্যাংক কর্মীদের নিয়মিত ভাড়ায় চালিত মিনিবাসটি যাবে নাজিরহাট। আরও কয়েকজনের জন্য অপেক্ষা। এই ফাঁকে খোঁশ-গল্পের সময় এক ব্যাংক কর্মকর্তা বললেন, ‘ভাই, ছাত্রলীগের স্কুল কমিটি গঠন করা তো আর হচ্ছে না।
মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ‘না’ করে দিয়েছেন’। আরেকজন বললেন, ‘চিন্তাটা বেশ ভালই। সময় থাকতে নেতাদের বোধোদয় হলো’। তখন একজন মহিলা ব্যাংক কর্মকর্তা জানতে চাইলেন, ‘এই যে ছাত্রলীগের স্কুল কমিটি গঠনের কথাটা বলা হয়, তার নাম কী ঠিক করা হয়েছিল? সেটার কী বাংলাদেশ বেবী লীগ নাম দেয়া হতো? কারণ স্কুল ও কেজি স্কুলে যারা পড়াশোনা করে তারা বয়সের হিসাবে শিশুই তো’। ভদ্রমহিলার কথায় গাড়ির আরোহীদের মাঝে হাসির রোল পড়ে গেল। ‘শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতি’ শ্লোগানধারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সুদীর্ঘ পথচলায় এবারই প্রথম আওয়ামী লীগের এই অঙ্গ সংগঠনের নেতারা স্কুল কমিটি গঠন করার উদ্যোগটি গ্রহণ করতে যাচ্ছিলেন। এ নিয়ে গত এক মাস ধরে রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষের মাঝে প্রকাশ্যে এবং আড়ালে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছিল।
বিশেষত দেশের সাধারণ অভিভাবক মহলে এ ব্যাপারে সীমাহীন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করে আসছিল। দেশের শিশু-কিশোরদের পাঠশালা স্কুলগুলোর শিক্ষার পরিবেশ বিষিয়ে এমনকি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে এমনটি শঙ্কা ব্যক্ত করা হয় সচেতন বিভিন্ন মহল থেকে। কেননা স্কুল পড়–য়া ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী একজন কোমলমতি শিশু-কিশোর, কিশোরীর পক্ষে ‘ছাত্র রাজনীতি’র খাতায় নাম লিখানো এবং শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি করা আদৌ কী সম্ভব? বিশ্বের কোন দেশে শিশু-ছাত্র রাজনীতির কী কোনো নজির আছে? নাকি বাংলাদেশই সেই ‘নজির’ স্থাপন করতে চায়!
অবশেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য থেকে সাধারণ জনমনে স্বস্তির উদ্রেক হলো। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের স্কুল কমিটি গঠনের বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে সাফ বলেছেন, তার কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রলীগের স্কুল কমিটি করার ঘোষণার সমালোচনা করে বলেছেন, স্কুল কমিটির ধারণাটাই সঠিক হয়নি। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি থাকবে। কিন্তু তাই বলে স্কুল পর্যায়ের কমিটি করার দরকার নেই। গত শনিবার বাংলা একাডেমিতে ছাত্রলীগের উদ্যোগে এক আলোচনা সভায় ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘স্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি করে এখন অহেতুক সমালোচনা ডেকে আনার দরকার নেই। স্কুলের ছেলে-মেয়েরা পিঠে বই পুস্তকের বোঝা নিয়ে যেন মরুভূমির পথ বেয়ে চলছে। বাচ্চাগুলোকে দেখলে এমনই মনে হয়। তারপর আবার রাজনীতির আরেক বোঝা? দরকার নেই এসবের’।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। যা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পূর্বসূরী ছাত্র সংগঠন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ব্যাপকতা, বিস্তৃতি লাভ করে। দিন দিন জনপ্রিয়তাও অর্জন করে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাস গৌরব, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যমন্ডিত। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত দেশ ও জনগণের স্বার্থরক্ষায় প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। শুধুই তাই নয়; ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ জাতীয় নেতৃত্বের আসনে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন এবং আজও করছেন।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে তৎকালীন তাগড়া-তরুণ নেতা শেখ মুজিবের প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতায় এক ঝাঁক মেধাবী ও প্রগতিশীল ভাবাদর্শের ছাত্রনেতাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সভার মধ্য দিয়ে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ছাত্রলীগের প্রথম আহŸায়ক ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। ছাত্রলীগ সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করার পর এর সভাপতি মনোনীত হন দবিরুল ইসলাম। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন খালেক নেওয়াজ খান।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ এর শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থান এবং এগারো দফা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্বাধীকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান যুদ্ধে ছাত্রলীগ মুজিব বাহিনী গঠন করে এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বাংলাদেশের ভূমিকা পালন করে।
অন্যদিকে শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুতির বিভিন্ন ঘটনা-অঘটনের কারণে সারাদেশে ছাত্রলীগের নেতিবাচক কর্মকান্ড জনমনে প্রবল সমালোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অভিযোগ রয়েছে অনেক। দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা ক্যাম্পাস দখল, গ্রæপিং, চাঁদবাজি, দখলবাজি, ভূমিদখল, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, এমনকি নিজ দলীয় নেতা-কর্মীকে খুন, যৌন সন্ত্রাসসহ হরেক অভিযোগের আঙ্গুল ছাত্রলীগের দিকেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সেই দুর্ধর্ষ ছাত্রলীগ নেতা-ক্যাডার জসিমউদ্দিন মানিক ১শ’ জন ছাত্রীকে ধর্ষণের ‘সেঞ্চুরি উৎসব’ পালনের ঘটনাবলীতে আজও গা-শিউড়ে ওঠে। এসব কর্মকান্ড আজ ছাত্রলীগের ইমেজ বিনষ্ট শুধু নয়; সংগঠনটিকে সম্পদে নাকি আপদে পরিণত করেছে তা নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতারাও চিন্তিত।
এই প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগের স্কুল কমিটি গঠনের পদক্ষেপ থেকে পিছিয়ে আসার বিষয়টি সাধারণ জনগণের কাছে প্রশংসা এবং স্বস্তির সাথেই উচ্চারিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপকালে তারা বলেছেন, ওবায়দুল কাদের অবশেষে বিষয়টি পরিস্কার করে বক্তব্য দেয়াটা হয়েছে সময়োচিত এবং সুচিন্তিত। তবে সেই সঙ্গে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কোনো কোন স্থানীয় নেতা বা ক্যাডারের ছত্রছায়ায় ইতোমধ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো ‘পিতা মুজিব সংগঠন’সহ হরেক বাহারী নামের যেসব সংগঠন-সমিতি গড়ে উঠেছে সেগুলোকে থামাতে এখনই দলের নীতি-নির্ধারকদের উদ্যোগী হওয়া উচিৎ হবে। অন্যথায় এহেন নামের মওসুমী সংগঠনের জোয়ার বাড়তেই থাকবে। ইনকিলাব

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।