বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১০:৪৩ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
৫ মাস পর মন্ত্রীর আদেশ বাস্তবায়ন হলো :সদ্য যোগদানকৃত এনবিআর চেয়ারম্যানের প্রশাসনিক উদ্যোগ :সিআইসির বিতর্কিত ডিজি বেলাল উদ্দিনকে অপসারণ

একুশে বার্তা ডেক্স :  অবশেষে ৫ মাস পর মন্ত্রীর আদেশ  বাস্তবায়ন করা  হলো। বিতর্কিত কর কমিশনার ও এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) মহাপরিচালক বেলাল উদ্দিনকে সরিয়ে দেয়া হলো এনবিআর থেকে। তার বিরুদ্ধে গত কয়েক বছর ক্ষমতার অপব্যবহার, সিআইসিকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ গুরুতর অভিযোগ ছিল।

এনবিআরের নতুন চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূইয়া বেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে রাজস্ব প্রশাসনের অধিকাংশ কর্মকর্তার ক্ষোভ ও অসন্তোষ কমাতে এই পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে।

এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত ২১ সেপ্টেম্বর বিতর্কিত এই কর্মকর্তাকে এনবিআর থেকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা কার্যকর হয়নি।

সোমবার বিসিএস (কাস্টমস ও ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশন এবং বিসিএস (ট্যাক্সেশন) অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা যৌথভাবে এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেন।

এ সময় তারা সিআইসির ডিজি বেলাল উদ্দিনের নজিরবিহীন ক্ষমতার অপব্যবহার, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, কর্মকর্তাদের অহেতুক হয়রানি, আয়কর-কাস্টমস কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ, ব্যক্তিগত ফোনকল রেকর্ড করে কর্মকর্তাদের হুমকি দেয়াসহ নানা অভিযোগ করেন।

অ্যাসোসিয়েশন নেতারা বেলাল উদ্দিনের বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অবিলম্বে তাকে অপসারণের দাবি জানান। এসব শুনে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূইয়া হতবাক হয়ে যান। এরপরই অর্থমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী বিতর্কিত এই কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিতে বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ।

তাকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্তকে এনবিআরের নতুন প্রশাসনের সময়োচিত পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন এনবিআরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বুধবার অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের কর অধিশাখা-২ থেকে বেলাল উদ্দিনের প্রত্যাহার আদেশ জারি করা হয়। একই আদেশে তাকে ঢাকা ট্যাক্সেস আপিলাত ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দিয়ে এনবিআরে সংযুক্ত করা হয়। বিকালে এ আদেশের কপি এনবিআরে পৌঁছলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তার অনৈতিক কর্মকাণ্ড তুলে ধরে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।

এনবিআর চেয়ারম্যানকে লেখা নির্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আই ওয়ান্ট দিজ অফিসার আউট অব এনবিআর। আই ইন্সট্রাক্টেট সেক্রেটারি চেয়ারম্যান, এনবিআর) ফর সাম অ্যাকশন হুইচ হি হেজ নট ইয়েট। হি শুড টক টু মি অ্যাবাউট ইট ইমিডিয়েটলি।’

অর্থাৎ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এই কর্মকর্তাকে এনবিআরের বাইরে দেখতে চাই। আমি তার বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সচিবকে (এনবিআর চেয়ারমান) নির্দেশ দিয়েছি, যা এখনো করা হয়নি। এ সম্পর্কে অবিলম্বে চেয়ারম্যান আমার সঙ্গে কথা বলতে হবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, একটি আবেদনের ওপর অর্থমন্ত্রী এই নির্দেশটি দিয়েছিলেন, তা জরুরি ভিত্তিতে পাঠানো হয় এনবিআরে। আবেদনে শিরোনাম ছিল, বেলাল উদ্দিনের দুর্নীতি, সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা, অদক্ষতা, সরকারবিরোধী কাজের বিহিতের আবেদন।

এতে বলা হয়, সিআইসির ডিজি বেলাল উদ্দিনের ক্ষমতার অপব্যবহার আর দুর্নীতি সবাইকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তিনি একজন অদক্ষ, অকর্ম কর্মকর্তা। নিজেকে এনবিআরের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে গণ্য করেন। এনবিআরে মেম্বার থাকা সত্ত্বেও তাদের কোনো সম্মান নেই। এই ডিজি নিজেকে অত্যন্ত ক্ষমতাধর মনে করেন। কাউকেই তোয়াক্কা করেন না। অফিসে বসে অর্থমন্ত্রীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও গালিগালাজ করেন। এরপর বেলাল উদ্দিনের দুর্নীতিসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়। জানা গেছে, রাজস্ব আদায়ে মনোনিবেশের পরিবর্তে বেলাল উদ্দিন আয়কর ও কাস্টমস উভয় ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাতে দিনভর ব্যস্ত থাকতেন। কোন কর্মকর্তা কোথায় অবস্থান করছেন, কার কার সঙ্গে আলাপ করছেন, ফোনে কারা কথা বলছেন- এসব মনিটরিং করতেন। নিজস্ব কায়দায় ক্যাডার কর্মকর্তাদের লাল, হলুদ ও সবুজ ক্যাটাগরিতে বিভাজন করতেন।

শুধু কর্মকর্তাদেরই নয়, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একইভাবে ক্যাটাগরি ভাগ করতেন। এ ক্যাটাগরির ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদায়ন করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগ করতেন। তার এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক কর্মকর্তাই একাধিকবার প্রকাশ্য ও গোপনে বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যেসব কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতেন- তাদের লাল শ্রেণিতে ফেলে পদোন্নতিতে হস্তক্ষেপ, পদায়নের সময় ঢাকার বাইরে পোস্টিং দিতে ভূমিকা রেখেছেন।

ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা বলেন, যেসব কর্মকর্তা তার কথামতো চলত না তাদের ফোনকল রেকর্ড করতেন বেলাল উদ্দিন। পরে এই ফোনালাপের বিষয়বস্তু নিয়ে কর্মকর্তাকে ডেকে জেরা করতেন। আয়কর ক্যাডারের কর্মকর্তা হলেও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতেন তিনি। যদিও এসব দেখার এখতিয়ার তার নেই। তার কুপরামর্শের কারণে অনেক কর্মকর্তার পদোন্নতি আটকে গেছে। অনেককে শাস্তিমূলক বদলিও করা হয়েছে। এ ধরনের অত্যাচার সইতে না পেরে সবশেষ কাস্টমস ও আয়কর ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা একযোগে তার স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ড নতুন চেয়ারম্যানের কাছে তুলে ধরেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, চেয়ারম্যানের পরে এনবিআরের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদ হচ্ছে সদস্য। কিন্তু সদস্যদের পাশ কাটিয়ে তিনি নিজেই একটি প্রশাসন গড়ে তোলেন। যেখানে রাজস্ব আদায়ে পারদর্শিতার চেয়ে তার চাটুকারদের ভালো ভালো পোস্টিং দিতে সুপারিশ করতেন। আর যারা তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে তাদের লাল শ্রেণিতে ফেলে ঢাকার বাইরে শাস্তিমূলক বদলি করেন। সৎ, দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তারা তার রোষানলে পড়েছেন বেশি। একজন কমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তা হয়ে আরেকজন কমিশনার পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন। অনেক সিনিয়র সদস্য-কমিশনারও তার রোষানল থেকে রেহাই পাননি। এ ছাড়া এনবিআরে শক্তিশালী জনসংযোগ বিভাগ থাকলেও সিআইসির কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রতিদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর মনিটরিং করাতেন। এতে কর্মকর্তারা কর ফাঁকি উদ্ঘাটনের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করার সময় পেতেন না।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদকে ইতিবাচক-নেতিবাচক হিসেবে নিজস্ব কায়দায় ব্যাখ্যা দিতেন। গঠনমূলক সংবাদ প্রকাশ করায় অনেক সাংবাদিককে ডেকে নিয়ে ভর্ৎসনাও করেছেন। একই সঙ্গে সংবাদপত্রের মালিকদের ফোন দিয়ে সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করারও হুমকি দিয়েছেন। সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিনি প্রতিনিয়ত সংশ্লিষ্টদের হুমকি-ধমকি দিতেন এমন অভিযোগও আছে।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।