শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৬:২৯ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
‘দেশের মোট আয়ের ৮৬ ভাগ আসে এনবিআর থেকে’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে উপাচার্যের সভাপতিত্বে ‘উন্নয়নে রাজস্ব’ বিষয়ে ২৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত একটি সেমিনারে উপস্থিত একজন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এনবিআরের চেয়ারম্যানকে প্রশ্ন করলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করি, কিন্তু আমি যখন বাড়ি যাই, আমার বয়স্ক পিতা জিজ্ঞাসা করেন, আচ্ছা বাবা, কথায় কথায় অনেকে বলেন, জনগণের টাকায় সরকার চলে, উন্নয়ন হয়। এটা কেমনে হয়; আমি তো ট্যাক্স দিই না, ট্যাক্স নম্বরও নেই। প্রশ্নকারী অধ্যাপক এরকম সাধারণের প্রশ্নের কী জবাব হতে পারে, তা জানতে চান। ওই শিক্ষকের মতো এমন প্রশ্নের অবতারণা প্রায় নজরে আসে। অন্যদিকে কোনো কোনো সভা-সমাবেশে সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ করে বলা হয়, আপনার বেতন ও সুযোগ-সুবিধা জনগণের টাকায় হয়; সেটি মাথায় রেখে সরকারি সেবা উন্নত করতে হবে। একদা, একজন ব্যক্তি হঠাৎ লেখকের অফিসে আসলেন। ভেতরে একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা চলায় তাকে কিছুক্ষণ অতিথি কক্ষে বসতে হয়েছিল। ভেতরে প্রবেশ করে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, লেখকের বেতন তার টাকাতে হয়। বুঝলাম তিনি বিরক্ত হয়েছেন। পরে জানতে পারলাম, যে কাজের জন্য এসেছেন, সেটি লেখকের দপ্তর সংক্রান্ত নয়; আর দেরিটা অনিচ্ছাকৃত। তা ছাড়া তিনি কোনো পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিলেন না। কর সংক্রান্ত দায়িত্ববোধের এই প্রশ্নের উত্তরটা সহজ করে দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেশের মোট অর্থ আয়ের প্রায় ৮৬ ভাগ অবদান রাখে। এর মধ্যে বৃহৎ অংশ আসে ভ্যাট থেকে, যার হার প্রায় ৩৭%। বাকি ৬৩ ভাগ আসে আয়কর ও কাস্টমস থেকে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ভ্যাট সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ১,২৪,৪২৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ভ্যাটের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১,৫৯,১০০ কোটি টাকা। এই যে বিপুল রাজস্ব আহরণ, তা আসছে কোথা থেকে? বৃহৎ অর্থে, এই টাকা জনগণের দেওয়া কর। কোনো ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণ টের পান, কোনো ক্ষেত্রে পান না। এর মূল কারণ হচ্ছে, ভ্যাট একটা পরোক্ষ কর ব্যবস্থা। প্রায় প্রতিটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভ্যাট প্রযোজ্য হয়। যিনি ভোক্তা, তিনি নির্ধারিত হারে কর দিচ্ছেন। একজন সাধারণ লোকও কোনো না কোনোভাবে একজন সেবা বা পণ্যের ক্রেতা বা ভোক্তা। এমনকি দৈনন্দিন যেসব কেনাকাটা করেন, তাতেও তিনি পরোক্ষভাবে কর দিয়ে যাচ্ছেন। ধরা যাক, গ্রামে বসবাসকারী একজন সাধারণ ব্যক্তি প্রায় প্রতিদিন বাজারে যাচ্ছেন, তিনি সেখান থেকে যা কিছু কিনছেন, সেটাতে তিনি কর দিচ্ছেন। খাবার-দাবারের একটি অংশ, পোশাক, তৈজসপত্র, যাতায়াতসহ নানা পণ্য ও সেবা কিনছেন। তিনি যে ঘরে বসবাস করছেন, সেই ঘরের টিন, ঘর বানানোর নানা উপকরণ (যেমন ইট, রড, সিমেন্ট ও তারকাটা), ইলেকট্রিক ফ্যান, বিদ্যুতের জন্যও খরচ করছেন। উৎপাদনকারী বা সেবাদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট এর অংশ যোগ করে বিক্রয় করছেন। শহরের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও অন্যরাও একইভাবে পরোক্ষভাবে ভ্যাট হিসেবে কর দিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ ভোক্তা শ্রেণির কাছ থেকে আহরণকৃত করের অংশ মিলে এত বিপুল পরিমাণ ভ্যাট সংগ্রহ করে এনবিআর। এই করের অংশে প্রত্যেক নাগরিকের অবদান রয়েছে। এমনটি একজন প্রান্তিক শ্রেণির ব্যক্তিও অন্তর্ভুক্ত। সরকারের যত ব্যয় রয়েছে, তাতে এই করের টাকায় সংস্থান মিলে। এই করের টাকায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি ও অন্যান্য সুবিধাদি প্রদান করা হয়। সরকারের যত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড রয়েছে, তাতেও এই করের ভূমিকা রয়েছে। নগরের যত চাকচিক্য, সুযোগ ও সেবা দেখা যায়, তার সবগুলোতে এই করের টাকা যুক্ত আছে। এমনকি গ্রামেগঞ্জে যে রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য গ্রামীণ অবকাঠামো রয়েছে তাও করের টাকায় হচ্ছে। মোদ্দাকথা, জনগণ থেকে আহরণকৃত কর হচ্ছে দেশের সব কর্মকাণ্ডের চালিকাশক্তি। কর যত বেশি আহরিত হবে, উন্নয়নের জন্য তত বেশি অর্থ ব্যয় করা যাবে। জনগণের ব্যয় থেকে সরকারের আয় হয়; আবার সরকারের ব্যয় থেকেও প্রকারান্তরে জনগণের আয় হচ্ছে বা তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা তৈরি হচ্ছে। এভাবে কর এবং ব্যক্তির ও সামষ্টিক কল্যাণ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

ভ্যাট আহরণ করতে গিয়ে আরেকটি প্রশ্ন প্রায় শোনা যায়। আমি কেন কর দেব? আমাকে সরকার এর বিনিময়ে কী দিচ্ছে? ভ্যাট ব্যবস্থায়, আইন অনুসারে একজন বিক্রেতা বা সরবরাহকারী ভ্যাট আদায় করে থাকেন এবং নির্ধারিত সময়ে সংগৃহীত ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা দেন। বিক্রেতা আইন দ্বারা নির্ধারিত ফরমে একটি চালান ইস্যু করবেন। এখানে দুটি পক্ষ—ক্রেতা বা জনগণ; অন্যটি বিক্রেতা বা ব্যবসায়ী। জনগণের সুবিধা সম্পর্কে প্রথমে কিছুটা ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। গ্রাম বা শহরে যেসব নাগরিক সুবিধা বা সেবা প্রদান করা হয়, তা জনগণ সরাসরি ভোগ করে থাকেন। রাস্তাঘাট, যাতায়াত, গ্যাস-বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থানসহ নানা ধরনের ভৌত সুবিধাদি কোনো না কোনোভাবে পেয়ে থাকেন। যেমন, তিনি কর দিচ্ছেন, তেমনি তিনি এসব সুবিধাদির ভাগীদার। এ ছাড়া সম্প্রতি দেশে যেসব বড় বড় উন্নয়ন স্তম্ভ রয়েছে বা চলমান আছে, তাও এই করের টাকায় জোগান হচ্ছে। এর সুফলও সবার জন্য উন্মুক্ত। যেমন, পদ্মা সেতু তৈরির ফলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল উন্নতি হয়েছে। ঢাকা ও দক্ষিণ অঞ্চলের সঙ্গে যাতায়াত পূর্বের তুলনায় অনেক কম সময়ে নেমে এসেছে। এই সেতুর সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক আন্তঃসংযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্ণফুলী টানেল, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রেল সংযোগ, ঢাকায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালসহ আরও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বর্তমানে দৃশ্যমান হয়েছে। জনগণ এর মধ্যে এসবের সুবিধাদি পেতে শুরু করেছেন। ব্যক্তি পর্যায়ে ইএফডিতে ভ্যাট প্রদানকালে ইস্যুকৃত চালানের ওপর প্রতি মাসে ১০১টি লটারি প্রদান করা হয়। প্রথম পুরস্কার এক লাখ টাকা এবং সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা। ক্রেতারা ভ্যাট দিয়ে এই আর্থিক প্রণোদনা পাচ্ছেন। অন্যদিকে বিক্রেতারা সাধারণ জনগণের সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত নানা ধরনের সুবিধা ভোগ করে থাকেন, যা তাদের বিনিয়োগকৃত পুঁজিকে নিরাপদ রাখে ও তা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক প্রদত্ত নিরাপত্তা ব্যবসায়ীদের জন্য একধরনের প্রাপ্তি, যা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। তা ছাড়া পুরো ভ্যাট ব্যবস্থাটি আইন ও বিধিমালা দ্বারা পরিচালিত। কর দেওয়া ও তা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া নাগরিক দায়িত্ব।

এর সঙ্গে আরেকটি সাধারণ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, মানুষ কীভাবে বুঝবে যে তার দেওয়া ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে? এর সহজ উত্তর হলো, প্রতিটি পণ্য বা সেবা সরবরাহকালে বিক্রেতা যে মূসক-৬.৩ চালান দেন সেটি বুঝে নিতে হবে।

ভ্যাট গরিবের জন্য বোঝা কি না? বলা হয়, এই কর ধনী-গরিবের পার্থক্য করতে পারে না। একজন ধনীকে যা দিতে হয়, তা একজন গরিবকেও দিতে হয়। তাই এই কর গরিবের জন্য অনেকটা বাড়তি কষ্টের কারণ। আগেই বলা হয়েছে যে, ভ্যাট একটি পরোক্ষ কর ব্যবস্থা। একই সঙ্গে এটি ভোক্তা কর। যিনি যত ব্যয় করবেন বা ভোগ করবেন, তিনি তত ভ্যাট দেবেন। সমাজে কারা বেশি ভোগ করেন, নিশ্চয়ই ধনীরা। একজন গরিব কম ভোগ করেন, তাই তাকে কম ভ্যাট দিতে হয়। দ্বিতীয়ত, গরিবের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্য ও সেবাকে ভ্যাটমুক্ত করা হয়েছে। যেমন, চাল, ডাল, আটা, ময়দা, সুজিসহ প্রাথমিক কৃষিজাত পণ্য, মাছ, মাংস, সবজি, জীবন-রক্ষাকারী ওষুধ ইত্যাদিতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

ভ্যাট ব্যবস্থাকে আরও ব্যবসাবান্ধব, জনবান্ধব এবং করবান্ধব করার ওপর এনবিআর প্রতিনিয়ত জোর দিচ্ছে। এজন্য বিভিন্ন সময়ে অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়। সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে আরও জনসচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। এর অংশ হিসেবে ১০ ডিসেম্বর ‘ভ্যাট দিবস’ ও ১০-১৫ ডিসেম্বর ‘ভ্যাট সপ্তাহ’ উদযাপন করছে। জনগণ ভ্যাট সম্পর্কে যত বেশি জানবে, তত বেশি করভীতি দূর হবে এবং স্বেচ্ছায় আইন পরিপালন বেড়ে যাবে। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বা উপদেশের জন্য যে কেউ সংশ্লিষ্ট এলাকার ভ্যাট কমিশনারেটের হেল্পডেস্ক বা করদাতা সেবা ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এনবিআর সবার সহযোগিতা নিয়ে আরও হয়রানিমুক্ত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে অনুকূল ভ্যাট আহরণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়।

লেখক: এনবিআরের সদস্য: ভ্যাট বাস্তবায়ন ও আইটি হিসেবে কর্মরত। লেখাটি ভ্যাট দিবস ২০২৩ উপলক্ষে এনবিআর কর্তৃক প্রকাশিত ম্যাগাজিন থেকে অনুদিত।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।