শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৯:৩৩ অপরাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
আবার গ্যাসের দাম বাড়ছে : বাজারে শঙ্কা, ফের বাড়বে পণ্যের দাম, গণ শুনানিকে তোয়াক্কা করছে না কর্তৃপক্ষ

নিউজ ডেক্স : গ্যাসের দাম বাড়াতে চলছে গণশুনানি। দাম বাড়াতে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি। দাম বাড়ছে এটা প্রায় নিশ্চিত। কী পরিমাণ বাড়বে সেটা জানা যাবে বিইআরসি’র ঘোষণায়। অবশ্য গণশুনানিতে অংশ নিয়ে বিভিন্ন অংশীজনেরা দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন, এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে। গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বাড়লে নিত্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যমূল্য আরেক দফা বাড়বে। এতে দুর্ভোগে পড়বে সাধারণ মানুষ।

করোনার কারণে সাধারণ মানুষের আয় কমে গেছে। পাশাপাশি বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। এ অবস্থায় আবার পণ্যমূল্য বাড়লে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলবে।

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী সমাজ। তারা বলছেন, প্রতি ঘনমিটারে গড়ে ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর যে প্রক্রিয়া চলছে, তাতে জনজীবন, সমাজ ও অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। বিতরণ কোম্পানিগুলো এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) পৃথকভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানি আজই শেষ হচ্ছে। কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম ১১৬ থেকে ১১৭ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। তবে বিইআরসি’র কারিগরি কমিটি মনে করে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেছেন দেশের শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, গ্যাসের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচও বাড়বে, যা শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। মহামারিকালীন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো ব্যাহত হবে। দেশের বাজারে তরলকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ভর্তুকি সামলাতে আরেক দফা গ্যাসের দাম বাড়াতে কোম্পানিগুলোর এই প্রস্তাব। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বাড়ায় দেশের বাজারে দাম সমন্বয় করার অজুহাত দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। সঙ্গে রয়েছে তাদের পরিচালনা ব্যয় ও উন্নয়নের নামে বিভিন্ন বাহানা।

শুনানিতে অংশ নিয়ে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, বিতরণ কোম্পানিগুলো অতীতে একবারে গ্যাসের দাম এত বৃদ্ধির প্রস্তাব করেনি। এমনিতেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে সব শ্রেণির ভোক্তা ও শিল্পোদ্যোক্তারা নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে শিল্পোদ্যোক্তাদের মুনাফার মার্জিন কমিয়ে পণ্য রপ্তানি করছে। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়লে বিদ্যুতের দামও বেড়ে যাবে। একদিকে গ্যাসনির্ভর শিল্পগুলোর ব্যয় বেড়ে যাবে, একইসঙ্গে বিদ্যুতের দাম বেড়ে গেলে পণ্যের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। এতে পণ্যমূল্য আরও বেড়ে যাবে। এতে সাধারণের দুর্ভোগ যেমন বাড়বে, তেমনি উদ্যোক্তারাও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে। দেশের বেশির ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো গ্যাসের উপর নির্ভরশীল।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, এই ধরনের প্রস্তাব নিতান্তই অবাস্তব। ক’দিন আগেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। পরিবহনে অরাজকতা তৈরি হয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ালে একই যুক্তিতে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোও দাম বাড়ানোর  চাপ দেবে। তাই এখনই গ্যাসের দাম বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত হবে না।

শুনানিতে অংশ নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সিনিয়র সহ-সভাপতি কামরান রহমান গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এতে ব্যবসার টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। গ্যাসের দাম আবার বাড়ানো হলে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। পরিবহন খরচ বাড়বে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা দেখছি না। এর ফলে শিল্পোন্নয়নে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিপক্ষে তাদের অবস্থান। গ্যাসের দাম বাড়লে এই শিল্পকে বাঁচানো যাবে না। গ্যাসের মূল্য নির্ধারণে দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা দরকার।

ভূ-তত্ত্ববিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে গণশুনানির প্রয়োজন দেখছি না। দেশে গ্যাস অনুসন্ধান করতে হবে। কেন এলএনজি’র দিকে দৌড়াচ্ছি। এলএনজি’র উপর নির্ভর হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা ভুল পথে হাঁটছি। দেশে গ্যাস শেষ হয়ে যায়নি। বাংলাদেশে মাত্র এক-তৃতীয়াংশে গ্যাস অনুসন্ধান হয়েছে। গ্যাস উৎপাদনের উপর জোর দেন তিনি। বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম শুনানিতে বলেন, সিস্টেম লস কমাতে হবে।

গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে বর্তমান দাম বহাল রাখার আহ্বান জানিয়েছেন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)- এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। প্রস্তাবের গণশুনানিতে ক্যাবের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনার মূল্যায়ন ও ভোক্তার পক্ষে সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সুপারিশগুলো হলো-(১) গ্যাসের বিদ্যমান মূল্যহার বহাল রেখে সব পর্যায়ের ট্যাক্স-ভ্যাট, অযৌক্তিক (লুণ্ঠনমূলক) ব্যয় কমিয়ে গ্যাসে আর্থিক ঘাটতি কমানোর সুপারিশ। (২) গ্যাস চুরি ও পরিমাপে কারচুপি এবং অস্বাভাবিক ব্যয়ে চাহিদার অতিরিক্ত সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছ থেকে অর্থলুণ্ঠন হচ্ছে। তার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলাসহ গ্যাস সরবরাহে নিয়োজিত সব কোম্পানির নিজ নজি পরিচালনা বোর্ডকে অভিযুক্ত করা হলো। এ অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মুনাফা মার্জিন রহিত করে ব্রেক-ইভেনে চলার প্রস্তাব করা হয়। (৩) গ্যাস খাতে সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য অংশীজনদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করা হয় ক্যাবের পক্ষ থেকে। (৪) এর আগে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিইআরসি’র আদেশাবলী পালন না করার দায়ে এবং গ্যাস খাত বিপর্যস্ত করার জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট লাইসেন্সধারীদের বিরুদ্ধে বিইআরসি আইনের ৪৩ ধারা এবং ৪৬ ধারায় ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করা হলো। (৫) গ্যাস সেবাকে স্বার্থ সংঘাত মুক্ত করার লক্ষ্যে, সেবা দেয়া লাইসেন্সধারীদের পরিচালনা বোর্ডকে আমলা মুক্ত করার প্রস্তাব করা হলো। শুনানিতে সুপারিশ উল্লেখ ও প্রস্তাবনার বিষয়ে মূল্যায়ন ও অসামঞ্জস্যতা তুলে ধরেন ক্যাব উপদেষ্টা। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে আপত্তি রইলো। মুঠোফোন গ্রাহক সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার মহামারির মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। মানুষ দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে। এরমধ্যে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব মানি না। এটা প্রত্যাখান করলাম।

বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, বিভিন্ন জিনিসের দাম বৃদ্ধির কারণ মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো শিল্প কারখানায় ১১৭ ভাগ এবং গৃহস্থালিতে ১১৬ ভাগ গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করছে। তবে কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ক্ষেত্রে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে। এবার মূল্য নির্ধারণে অবিবেচক হবে না। মূল্যহার সুবিবেচনা, সুনিদিষ্ট ভারসম্যপূন্য সিদ্ধান্ত দেয়া হবে। বাস্তবতার নিরিখে হবে ঘোষণা, কোনো অমানবিক সিদ্ধান্ত দেয়া হবে না।

এ প্রস্তাব অনুসারে, আবাসিক গ্যাসের দাম দুই চুলার মাসিক বিল হবে ২ হাজার ১০০ টাকা, যা বর্তমানে ৯৭৫ টাকা এবং এক চুলার বিল হবে ২ হাজার টাকা, যা বর্তমানে ৯২৫ টাকা। আর শিল্পে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম বর্তমানে ১০ টাকা ৭০ পয়সা, যা বাড়িয়ে ২৩ টাকা ২৪ পয়সা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যবহারের গ্যাস শিল্প-কারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, তার দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ৩০ টাকা, যা বর্তমানে ১৩ টাকা ৮৫ পয়সা।

গণশুনানির পর অংশীজনদের দাবি-মতামত-মূল্যায়ন শেষে দাম সমন্বয়ের ঘোষণা দেয়া হবে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে গৃহস্থালি, শিল্পসহ সব শ্রেণির গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে। তবে তা কতটুকু বাড়ানো হবে তা মূল্যায়ন ও শুনানি শেষে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে জানানো হবে। শুনানি শেষে ৯০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্তসহ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে বিইআরসি’র। সব মিলিয়ে জুনে গ্যাসের দাম বাড়ানো হতে পারে।

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।