বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০২:০১ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
দুদক : প্রতিবন্ধকতা পদে পদে : বিলম্বিত দুর্নীতির বিচার :  উচ্চ আদালতে মাত্র ১টি বেন্ঞ

নিউজ ডেক্স : দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)র দায়ের করা অন্তত সাড়ে ৯০০-এর বেশি মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে ঢিমেতালে। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশসহ বিভিন্ন কারণে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়ে থাকা এসব মামলা সারবত্তা হারাচ্ছে দিন দিন। এর মধ্যে হাইপ্রোফাইল মামলার বিচার কার্যক্রম চালু রাখার প্রশ্নে অনেকটা অসহায়ত্ব্ই প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

আইনজ্ঞদের মতে, নিজস্ব প্রসিকিউশন টিম না থাকাই দুদকের আইনী লড়াইয়ের একটি প্রতিবন্ধকতা। এটি দুদকের কর্মক্ষমতার ঘাটতিরই প্রতিফলন বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশন বাদী হয়ে দায়েরকৃত ৩ হাজারের বেশি মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। গত জানুয়ারি হিসেবে অনুযায়ী, ঢাকার আদালতগুলোতে বিচার চলছে ৬৪২টি মামলার। জেলা ও বিভাগীয় আদালতে বিচার চলছে ১৮৬৩ মামলা। বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময় দায়েরকৃত মামলার মধ্যে বিচারাধীন রয়েছে ১২০০টির বেশি। এর মধ্যে ঢাকার আদালতে ৩৯০টি। দেশের অন্যান্য আদালতে বিচার চলছে ৮৭৪টির মতো মামলা।

হাইকোর্টে দুদকের বিরুদ্ধে রিট রয়েছে ১২৭৯টির মতো। মিস কেস (বিবিধ মামলা) হয়েছে ৯০৮টি। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে ১৮৫টি। বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছেÑ ৯৩১টি মামলা।
যদিও দুদকের এ পরিসংখ্যার স্থির নয়। প্রতিদিনই যোগ-বিয়োগ হচ্ছে মামলার সংখ্যার। কমিশন প্রতিষ্ঠার দেড় যুগেও একটি সেন্ট্রাল ডাটাবেজ প্রণীত না হওয়ায় মামলার বিচার, তদন্ত-অনুসন্ধান ইত্যাদি, কোনটি কোন্ পর্যায়ে রয়েছেÑ সেই তথ্য খোদ কমিশনের হাতেই নেই।

পদে পদে চ্যালেঞ্জ : অভিজ্ঞ তদন্ত কর্মকর্তাদের মতে, অভিযুক্তপক্ষ দুদকের প্রতিটি পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করছেন। অভিযোগ যাচাই-বাছাই, অনুসন্ধান, প্রতিবেদন দাখিল, সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি, দুদকের আইনগত এখতিয়ার, বিধি, সম্পদ বিবরণী গ্রহণ, তদন্ত প্রতিবেদন, চার্জশিট অনুমোদন, চার্জশিট দাখিল, চার্জশিট আমলে নেয়া, মামলা স্থানান্তর, বিচারক নিয়োগ, অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ, চার্জ গঠন, সাক্ষ্য গ্রহণ, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি গ্রহণ, বিচার আদালতের এখতিয়ার, রায়, রায়ের বিরুদ্ধে আপিলÑ এমন প্রতিটি পর্যায়ে আইনি বাধার সম্মুখীন হতে হয় দুদককে।

একটি অভিযোগকে চার্জশীট আকারে আদালতে দাখিল করতে সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তাকে পদে পদে রিট, মিস কেস ও আপিল মোকাবিলা করতে হয়। ফলে মূল বিচার পর্যন্ত উঠতেই দুদকের লেগে যায় বহু বছর। এসময়ের মধ্যে ঘটে সরকার পরিবর্তন। পরিবর্তন ঘটে দুদকের শীর্ষ পদে। এছাড়া রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ, নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের অগ্রাধিকার, আগ্রহ-অনাগ্রহ, মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তার বদলি, পদোন্নতি অবসর গ্রহণও দুদকের মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে থাকার অন্যতম করণ।
বিচার প্রক্রিয়ায় আদালতেও রয়েছে কঠিন বাস্তবতা। বিচার আদালতের শুনানির দীর্ঘ মুলতবি, মামলা জট, আদালত ও বিচারক পরিবর্তন, দুদকের প্রসিকিউশনে পরিবর্তন, উচ্চ আদালতে পূর্ববর্তী বেঞ্চ ভেঙে যাওয়া, নতুন বেঞ্চে কার্যতালিকায় মামলা ওঠানোর মতো অবধারিত প্রতিবন্ধকতা তো রয়েছেই।

দুদকের প্রসিকিউশন সেলে কাজ করেন, এমন একজন কর্মকর্তা জানান, উচ্চ আদালতে দুদকের মামলা নিষ্পত্তির জন্য বেঞ্চ স্বল্পতাও বড় একটি কারণ। দেখা গেল, বিচার আদালতে চলমান একটি মামলার বিরুদ্ধে হাইকোর্ট একটি অন্তর্বর্তীকালীন স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। স্থগিতাদেশের মেয়াদবৃদ্ধির জন্য অভিযুক্তপক্ষ একটি আবেদন দিলেন বেঞ্চে। কিন্তু সেটি সহজে শুনানিতে আসে না। উক্ত কর্মকর্তা জানান, হাইকোর্টে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলার শুনানি করতে পারে- এমন একটি মাত্র বেঞ্চ রয়েছে। ফলে দুদকের ঝুলে থাকা মামলার স্তূপ ক্রমেই বাড়ছেই।

চ্যালেঞ্জ কোনো প্রতিবন্ধকতা নয় : দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের চূড়ান্ত ব্যবস্থা হচ্ছে মামলা ঠুঁকে দেয়া। দুদক মামলা দায়ের করে। এ মামলা চলে বহু বছর। কিন্তু এ মামলার শেষ পরিণতি কি?
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দুদকের মামলায় চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে একজন দুর্নীতিবাজও কারাগারে নেই। মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রেফতার হয়ে কারাভোগ করলেও আপিল বিভাগের বহাল রাখা শাস্তির প্রেক্ষিতে কেউ কারাভোগ করছেÑ এমন একটি দৃষ্টান্তও নেই দুদকের হাতে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে দুদকের আইনজীবী খোরশেদ আলম খান বলেন, চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কেউ কারাগারে আছে কি নাÑ এটি প্রসিকিউশনের দেখার বিষয় নয়। প্রসিকিউশনের দায়িত্ব আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া। অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করবে আদালত। আর দুদকের দায়িত্ব হলো আসামিকে আইনের হাতে সোপর্দ করা।

মামলার বিচার স্থগিত থাকার কারণ কি-জানতে চাইলে দুদকের এ আইনজীবী বলেন, অনুসন্ধান থেকে শুরু করে রায় প্রদান পর্যন্ত প্রতিটি স্টেজে দুদকের কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে। কিন্তু এটিকে আমি প্রতিবন্ধকতা বলতে রাজি নই। অভিযুক্ত পক্ষের আইনগত অধিকার রয়েছে চ্যালেঞ্জ করার। যেখানে দুদক ঠেকে যাবে, সেখান থেকে আইনি লড়াই করে বেরিয়ে আসাই দুদকের কাজ।

অভাব নিজস্ব প্রসিকিউশনের : নিজস্ব আইনজীবী ক্যাডার না থাকাই দুদকের আইনি লড়াইয়ে প্রধান প্রতিবন্ধকতা বলে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেলের কাজ হলো রাষ্ট্রের পক্ষে মামলা পরিচালনা করা। অন্যদিকে আইনের অধ্যাপকের কাজ হলো আইন শেখানো। অ্যাটর্নি জেনারেলের কাজ অধ্যাপককে দিয়ে হয় না। এ পার্থক্যটিই আমাদের রাষ্ট্র বুঝতে পারল না। দুদক কিছু জুডিশিয়াল ক্যাডারকে ডেপুটেশনে নিয়োগ দেয়। তারা হয়তো ভালো বিচার করতে পারেন। আইনজীবী হিসেবে তারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। আইনি লড়াইয়ের জন্য আইনজীবী প্রয়োজন। এটি ভাড়াটে আইনজীবী দিয়ে হবে না। নিজস্ব আইনজীবী না থাকাই আমার কাছে দুদকের প্রধান প্রতিবন্ধকতা বলে মনে হয়।

কর্মক্ষমতায় ঘাটতি : ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যাওয়া মূলত দুদকের কর্মক্ষমতা বা ক্যাপাসিটির ঘাটতির প্রতিফলন। আমরা সব সময় বলে আসছি, দুদকের উচিত কার্যক্রমের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা। মামলার মেরিট বিবেচনায় গুরুত্ব দেয়া উচিত। নির্দোষ আসামি যাতে হয়রানির শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ্য রেখে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া উচিত। দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য হলেও একটি-দুটি বিষয়ে কাজ করতে হবে। না হলে প্রতিষ্ঠানটির ওপর মানুষের প্রত্যাশাও কমতে থাকবে।সূত্র :  ইনকিলাব

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।