রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৩:২৩ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখন সময়ের ব্যাপার

১৯৭১ ও ১৯৭৫-এর খুনিরা শক্তিশালী দেশের রাজধানীতে নিরাপদে রয়েছে ও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে দেশের সরকার বা সাধারণ মানুষ কিছু বলছে না ও তাদের সঙ্গে একত্রে বসবাসও করছে। এ কারণে সেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিন্দুমাত্র লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে তারা মনে করেন না। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চে জঘন্য গণহত্যাকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়ার দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক, মানবিক ও আইনের শাসনের দৃষ্টিতে সঠিক বলে মনে হয়।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যত মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে, বিশ্বের আর কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এত মানুষের জীবন দিতে হয়েছে বলে মনে হয় না। একমাত্র ভিয়েতনাম ছাড়া আর কোথাও এত বেশি সংখ্যক মানব সন্তানকে জীবন দিতে হয়নি। আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম চলেছিল মাত্র ৯ মাস। আর ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলেছিল বছরের পর বছর। সেই হিসাবে বিচার করলে অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোক নিহত হয়েছে। শুধু নিহত নয়, যেভাবে অবলা নারী ও অবিবাহিত যুবতীদের গণধর্ষণ করা হয়েছে, তা ইতিহাসে বিরল। ধর্ষণ ছিল হানাদারবাহিনীর এক ধরনের কৌশল। এই জঘন্য কৌশলের মাধ্যমে তারা মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার জনগণের জাতিসত্তাকে ধ্বংস করবার পরিকল্পনা নিয়ে, এ দেশে অগণিত জারজ সন্তান পয়দা করে বাঙালিত্বকে ধ্বংস করতে চেয়েছে। একই সঙ্গে ধর্মভীরু মুসলমানদের ওপর এ ধরনের নৃশংস-বর্বর বিধর্মী আচরণ করে ভয়ভীতির সৃষ্টি করে বাংলার জনগণের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রাখতে চেয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল অগণিত ধর্ষণের কারণে জন্মানো জারজ সন্তানের মাধ্যমে পাকিস্তান বাঙালি মিলে এক মিশ্র জাতিসত্তার সৃষ্টি হবে এবং এতে বাঙালিত্বের সক্রিয় বৈশিষ্ট্য বিঘ্নিত করা যাবে।

এ ছাড়া যদি ধ্বংসযজ্ঞের কথা বলা হয়, তাহলে তারা পূর্ব বাংলাকে সত্য সত্যই শ্মশানে পরিণত করেছিল। রাস্তাঘাট, হাটবাজার, দোকানপাট, ব্রিজ, কালভার্ট, বাড়িঘর, দালানকোঠা, খাদ্যগুদাম, ক্ষেতের ফসল, ব্যাংকে সংরক্ষিত সোনা ও মুদ্রা সবকিছুই তারা হয় ধ্বংস, না হয় লুটপাট করেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংরক্ষিত সোনা ও বিদেশি মুদ্রা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, জাতির বিবেক বুদ্ধিজীবীদের তারা দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দুইদিন আগে নির্মমভাবে হত্যা করে, তারা জাতিকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও সেই স্বাধীন দেশ পরিচালনা করবার মতো মেধাসম্পন্ন লোকদের, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই হত্যা করা। তাই রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের সহযোগিতায় তারা কাজটি করতে সক্ষম হয়েছিল। এমন কোনো শহর নেই, যেখানে তারা অগণিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেনি। শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, প্রকৌশলী ও শিল্প-সংস্কৃতি সচেতন ব্যক্তিদের নির্মমভাবে হত্যা করে তারা সত্য সত্যই এক মহাশূন্যতা সৃষ্টি করে, যা পূরণ করতে জাতিকে আজো সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

অনেকে অনেক কথা বললেও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে ৩০ লাখেরও বেশি লোককে যে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথম দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ রাতেই অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে কম হলেও ১ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটায়। এদের অনেকেরই ডেড বডি পাওয়া যায়নি। এরপর সুদীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে এমন কোনো জেলা-উপজেলা ছিল না, যেখানে সেনাবাহিনী তার ক্যাম্প করে দেশব্যাপী নির্যাতন চালায়নি। প্রত্যেক ক্যাম্পের ১-২ কি.মির মধ্যে ছিল বধ্যভ‚মি। এ ছাড়া ক্যাম্পে ধরে এনে হত্যা করে কয়েক লাখ লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে বিশেষ করে গ্রামবাংলার হাটের দিন যখন গ্রামের লোক উপজেলা বা মহকুমা পর্যায়ে ব্যবসাকেন্দ্রে হাজির হয়েছে, তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা কেড়ে নিয়ে আটক রেখে রাতে হত্যা করেছে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে হত্যা করে নদীতেও ফেলে দেয়া হয়েছে অথবা কাছের বধ্যভ‚মিতে মাটির তলে পুঁতে ফেলা হয়েছে। যখন হানাদারবাহিনী চলার পথে নদীর ঘাটে ফেরি বা লঞ্চে যাদের পেয়েছে, তাদের হত্যা করেছে। এমন কি বিয়েবাড়িতে হাজির হয়ে উপস্থিত অতিথিদের ট্রাকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। গ্রামবাংলায় হানাদারবাহিনী বিহারিদের সহযোগিতায় একেক এলাকায় একেক দিন অপারেশন চালিয়েছে, অগণিত মানুষকে হত্যা করেছে এবং মহিলাদের ধরে নিয়ে রাতভর গণধর্ষণ করেছে। এভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে, এমনও উপজেলা ও জেলা রয়েছে যেখানে এই ৯ মাসে ১৫-২০ হাজার লোক হত্যা করা হয়েছে। এই হানাদার বাহিনী যেদিন আলফাডাঙ্গায় অপারেশন করে, সেদিন তার কাছেই মাত্র ১/২ কি.মি দূরে আমরা মাত্র কয়েকটা রাইফেল নিয়ে প্রায় গুলিশূন্য অবস্থায় অবস্থান করছিলাম, সেদিন তাদের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব ছিল না, তারা লঞ্চের ওপর এলএনজি ফিট করে বারাশিয়া নদী দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। সেনাবাহিনী ও বিহারি মিলে দুটি লঞ্চে প্রায় ১৫০ সশস্ত্র লোক একটার পর একটা গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছিল এবং যাকে যেখানে পেয়েছিল, তাকে সেখানেই গুলি করে হত্যা করেছিল। এক আলফাডাঙ্গা বাজারেই তারা প্রায় ৩৫ জনকে হত্যা করে। আমার বেশ মনে আছে, বাজারে ঢুকতেই একটা কলুবাড়িতে (তেলের ঘানি) এক বৃদ্ধকে যার বয়স ৫০-৬০ এর কম নয়, তাকে নির্মমভাবে মাথায় গুলি করায় খুলি উড়ে গিয়ে মগজ বের হওয়া অবস্থায়ই হুক্কা হাতে সে মাটিতে পড়েছিল। যে গরু ঘানি টানছিল, তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। একটু দূরে জেলেপাড়ায় ১০-১২ জন লোককে দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা ডিসের ভেতর গুলি করে মারা হয়েছে। তার মধ্যে একজন মহিলা ছিল, যার পেটে ৯ মাসের বাচ্চা। এ ধরনের নির্মমভাবে গোয়ালন্দ ও রাজবাড়ী শহরে ৯ মাসে প্রায় ১৪ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

রাজবাড়ীতে কলেজপাড়ায় একটা কুয়া ছিল। প্রতিদিন সেখানে তারা মানুষকে ধরে নিয়ে ওই কুয়ায় ফেলে দিত। স্থানীয় বিহারিরা এ কাজটা করত। ওই কুয়াটার ওপর এখন একটা দালান নির্মাণ হয়েছে। এখনো অনুসন্ধান করলে, ওখানে কয়েকশ কঙ্কাল পাওয়া যাবে। রাতের বেলা ট্রাক ভরে মানুষ নিয়ে গুলি করে হত্যা করে শ্রীপুর বধ্যভ‚মিতে পুঁতে দেয়া হতো। মৃতদেহগুলো খুঁজে বের করার কারো সাহস ছিল না। অপরদিকে গোয়ালন্দ বাজারে নদীতে বস্তাভর্তি লাশ ফেলে দেয়া হতো। যারা বলেন- ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়নি, শহীদ হয়েছে মাত্র কয়েক লাখ মানুষ। হয় যুদ্ধ সম্পর্কে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না আর তা না হলে তাদের পাকিস্তানপন্থি হানাদার বাহিনীর অপরাধকে খাটো করে দেখানোর জন্য তারা ওইরূপ বলে থাকেন। বিশ্বে সবচেয়ে বড় জেনোসাইড হচ্ছে- ১৯৭১ সালের এ গণহত্যা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বহু লোক মারা গেছে। তবে এত অল্প সময়ে, এত সীমিত জায়গায় এত বেশি লোক আর কোথাও মারা গেছে বলে মনে হয় না। এ জন্য এটাকে ‘ওয়ার্ল্ড জেনোসাইড অব হিস্ট্রি’ বলে অভিহিত করা যেতে পারে। এক দিনে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে যত লোককে হত্যা করা হয়েছে, তার হিসাব নিলে, দিন হিসাবে বা ঘণ্টার বিবেচনায় পৃথিবীর জঘন্যতম গণহত্যা ঘটেছে এ বাংলাদেশে। তাই এ দিবসটি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃতি লাভের আবেদন অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। এটা দুঃখজনক, ১৯৭১ সালের গণহত্যার ব্যাপারে বিশ্ব বিবেক সঠিকভাবে জাগ্রত হতে পারেনি। বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাকে জাগ্রত হতে দেয়নি। এমনকি ওই হত্যাকাণ্ড যারা সংঘটিত করেছে, সেই পাকিস্তানি বর্বর হানাদারবাহিনী বা বাংলাদেশের সহযোগীদের বিচার প্রক্রিয়া জাতিসংঘ এখনো শুরু করতে পারেনি। বরং বাংলাদেশ কর্তৃক গৃহীত যে বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক আদালতে শুরু করা হয়েছে, তার কার্যক্রম চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে।

অনেক দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধীর বিচারকার্য শুরু করেছে। ইতোমধ্যে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের দন্ড কার্যকর করা হয়েছে। যারা পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, তাদেরও বিচার করা এখন সময়ের দাবি। বিশ্বের বড় বড় রাজধানীতে আজো ১৯৭১ ও ১৯৭৫-এর খুনিরা এখনো আশ্রয় ও প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছেন। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর সম্ভব হয়নি। খুনিরা শক্তিশালী দেশের রাজধানীতে নিরাপদে রয়েছে ও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে দেশের সরকার বা সাধারণ মানুষ কিছু বলছে না ও তাদের সঙ্গে একত্রে বসবাসও করছে। এ কারণে সেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিন্দুমাত্র লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে তারা মনে করেন না। তাই ১৯৭১ এর ২৫ মার্চে জঘন্য গণহত্যাকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়ার দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক, মানবিক ও আইনের শাসনের দৃষ্টিতে সঠিক বলে মনে হয়।

ডা. এস এ মালেক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।