রবিবার, ০৫ মে ২০২৪, ০৫:৪৩ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
এক যাত্রায় পৃথক ফল

মুনশী আবদুল মাননান : এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় না। দীর্ঘ বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এই সিদ্ধান্ত নির্ণীত হয়েছে। এক যাত্রায় ফল অভিন্ন হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশে এক যাত্রায় ফল এক হয় না, ক্ষেত্র বিশেষে হয় ভিন্ন। এটা বৈপরিত্য। এই বৈপরীত্যই যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠছে এবং ক্রমাগত তার বিস্তার ঘটছে। খালেদা জিয়ার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার কথাই ধরা যাক। এ মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে মতপার্থক্য ও বিতর্ক রয়েছে। । সে বিতর্কে আমরা যেতে চাইনে। দুই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা এই মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর কারাদন্ড হয়েছে। দন্ড ঘোষণার পর তাকে কারাগারে নেয়া হয়েছে। নাজিমুদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারের একটি নির্জন কক্ষে তাকে রাখা হয়েছে। একে তো জনমানবহীন বিশাল কারাগার, তার ওপর যে কক্ষটি নির্বাচন করা হয়েছে তা কারো থাকার জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত নয়। বলা হয়েছে, কক্ষটি অস্বাস্থ্যকর ও স্যাঁতস্যাঁতে। সেখানেই তিনি দন্ড ভোগ করছেন। অনেকেই বলছেন, দেশের তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দু’দুবারের সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা, দেশের বৃহত্তম দুটি দলের একটির চেয়ারপারসন এবং সবচেয়ে বড় বিরোধীদলীয় জোটের প্রধানকে এইভাবে সম্পূর্ণ নি:সঙ্গ অবস্থায় একটি কক্ষে রাখা মোটেই সমীচীন হয়নি। তাকে যদি নিতান্তই সাধারণ কয়েদী হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে তাকে নতুন কেন্দ্রীয় কারাগার কিংবা কাশিমপুর কারাগারে রাখা যেতে পারতো। সেখানে অন্তত তিনি একটু ভালো পরিবেশ পেতেন, অন্তত এতটা নি:সঙ্গ তাকে থাকতে হতো না। আসলে নাজিমুদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারে রেখে তাকে দন্ডের ওপরে বাড়তি দন্ড দেয়া হয়েছে। ৭৩ বছর বয়স্ক একজন মানুষকে এভাবে রেখে তার শারীরীক ও মানসিক অবস্থার ওপরে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ এমন খবরও আছে, সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে কারাগারে আছেন এমন ব্যক্তিরা কারাগারে বা হাসপাতালে জামাই আদর ভোগ করছেন।
যে ধরনের মামলা ও দন্ড তাতে বেগম খালেদা জিয়ার জামিন অনেক আগেই হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি। তার আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন, উচ্চ আদালতে তার জামিন নিয়ে যে উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে তা নজিরবিহীন। তার জামিন পাওয়া এখন সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছে। দুদকের পক্ষ থেকে সাজা বাড়ানোর জন্য লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়েছে। এই লিভ টু আপিল নিষ্পতি না হওয়া পর্যন্ত তার জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। লিভ টু আপিলের সিদ্ধান্ত তার পক্ষে গেলেও তিনি জামিন পাবেন কিনা তাতেও সন্দেহ আছে। জামিন পেলেও তৎক্ষনাৎ ছাড়া পাবেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তার বিরুদ্ধে আরো মামলা আছে। কোনো কোনো মামলায় গ্রেফতারী পরোয়ানা আছে। ওই সব মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তার কারাজীবন আরও প্রলম্বিত করা হতে পারে বলে অনেকেরই আশঙ্কা। বিস্ময়কর বৈপরীত্য হলো, অনেক বড় বড় দুর্নীতি মামলার অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে আছেন। তাদের মামলা থেমে আছে অথবা তারা জামিন নিয়ে মুক্ত জীবনযাপন করছেন। অনেকে দন্ডপ্রাপ্ত হয়েও জামিনে মুক্ত আছেন। বলা বাহুল্য, তারা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন দলের হোমরা-চোমরা বা সমর্থক। তাদের মধ্যে মন্ত্রী-এমপি পর্যন্ত আছেন।
গত ২৭ মার্চ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার শুনানির দিন ছিল। ওই দিন বেগম খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির করানোর কথা থাকলেও করা হয়নি। কারা কর্তৃপক্ষ সেদিন আদালতকে জানায়, বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ। তাই তাকে হাজির করা যায়নি। এই প্রথম জানা গেলো যে, তিনি অসুস্থ। গত ৫ এপ্রিল একই মামলার শুনানির দিন ছিল এবং বেগম খালেদা জিয়াকে যথারীতি হাজির করানোর কথা ছিল। সেদিনও তাকে হাজির করা হয়নি। কারা কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া শারীরীকভাবে অসুস্থ। তিনি আর্থাইটিস রোগে ভুগছেন। একারণে তাকে হাজির করা সম্ভব হয়নি। বেগম খালেদা জিয়া যে বেশ বড় রকমে অসুস্থ, দ্বিতীয়বার তার হাজির না করানো থেকে সেটা প্রতীয়মান হয়। অথচ তার অসুস্থতা নিয়ে সরকারী মহল থেকে এক ধরনের ধু¤্রজাল সৃষ্টি করা হয়। তিনি যে অসুস্থ, প্রথমে তা স্বীকারই করা হয় না। বলা হয়, তিনি অসুস্থ নন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এও পর্যন্ত বলেন যে, ‘খালেদা জিয়া সুস্থ আছেন। বলা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়টিকে একটা বির্তকের বিষয়বস্ততে পরিণত করা হয়। এ নিয়ে বিএনপির তরফে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আলোচনা যখন জোরালো হয়ে ওঠে তখন সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চারজন ডাক্তারকে নিয়ে একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা ১ এপ্রিল বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। বোর্ডের প্রধান ডা: মো: শাসুজ্জামান শাহীন বিবিসিকে অত:পর বলেন : ‘আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে হয়তো ৫০ কিংবা ৬০ গজ দূরে বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন। সেখান থেকে আমাদের কাছে আসতে তার অনেকক্ষণ সময় লেগেছে। দুইজন তাকে ধরে ধরে আনতে হয়েছে। আমরা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি ঘাড়ে, বাঁ-হাতে ও পায়ে ব্যথা অনুভব করছেন। তার হাত ঝিমঝিম করে। তিনি আগে যেসব ওষুধ সেবন করতেন তার সাথে আরোও কিছু ওষুধ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রক্ত ও এক্সরে পরীক্ষা করতে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাকে ব্যায়াম করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সর্বোপরি তিনি অসুস্থ, তবে গুরুতর নয়।’
মেডিক্যাল বোর্ডপ্রধানের এই বক্তব্যের পর সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ। ৫০ বা ৬০ গজ পথ হাটা সাহায্যকারী ছাড়া তার পক্ষে যদি সম্ভব না হয়, তবে বুঝে নিতে হবে তিনি কতটা অসুস্থ, কতটা দুর্বল। জানা গেছে, মেডিক্যাল বোর্ডের ব্যবস্থাপত্র তিনি তাৎক্ষনিকভাবে গ্রহণ করেননি। তিনি তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওই ব্যবস্থাপত্রে দেয়া ওষুধ সেবন করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। এটাই তার পক্ষে স্বাভাবিক। সরকারের পক্ষ থেকে পরে জানানো হয়েছে, তার ব্যক্তিগত চিকিৎসককে কারাগারে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হতে পারে। এই অনুমতি দেয়ার কাজটি আগে হলে তার চিকিৎসা দ্রæতায়িত হতো, সন্দেহ নেই। আগেই বিএনপির পক্ষ থেকে তাকে দ্রæত জামিনে মুক্তি ও চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ দানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কিছুটা আগে ভাগেই বলেছিলেন, প্রয়োজনে চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো হবে। সেটা অবশ্য ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি। এটা নতুন কোনো চাল কিনা তা নিয়ে দলের নেতাদের সন্দেহ আছে। মোট কথা, বেগম খালেদা জিয়ার দন্ডের পর পরিত্যাক্ত কারাগারের একটি নিকৃষ্ট ধরনের কক্ষে রাখা, জামিনে গড়িমসি, জামিন বাতিলের আবেদন, লিভু টু আপিল দায়ের এবং তার অসুস্থতা নিয়ে এযাবৎ যা কিছু হয়েছে তা স্বাভাবিকভাবে নেয়নি বিএনপি এবং সাধারণ মানুষ। পাবলিক পারসেপশন বলে একটি কথা আছে। এক্ষেত্রে পাবলিক পারসেপশন সরকারের পক্ষে যায়নি। সাধারণ মানুষের অভিমত, বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে যে আচরণ ও ব্যবহার করা হয়েছে বা হচ্ছে তা অমানবিক এবং সেটা তার প্রাপ্য নয়। এ আচরণ ও ব্যবহারের পেছনে সরকারের হাত রয়েছে এবং এর দায় সরকার এগিয়ে যেতে পারে না।
এটা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, সেনা সমর্থিত এক-এগারো সরকারের সময়ে দুদক বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাসহ চারটি দুর্নীতি মামলা দায়ের করে। অনুরূপভাবে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করে১৫টি মামলা। এছাড়া দু’দলের বেশ কিছু শীর্ষ নেতা ও দু’দলের সমর্থক অনেক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেও মামলা করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই তরফের প্রায় সমুদয় মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে বা নিষ্পত্তি করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বিএনপির চেয়ারপারসনসহ এর নেতৃবৃন্দ ও সমর্থক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দায়ারকৃত সব মামলাই রয়ে গেছে। তদন্ত ও বিচারের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে এসব মামলা। স্বাধীন দুদক যে মোটেই স্বাধীন নয়, সরকারের অঙ্গুলি হেলনে যে সে চলে, এটা তার প্রমাণ বহন করে। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বর্তমান সরকারের আমলে বিএনপির চেয়ারপারসনসহ দলের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় কোর্টে হাজিরা দিতেই প্রাণান্ত হতে হচ্ছে তাদের। এরপর গ্রেফতার, জামিন বাতিল, ফের গ্রেফতার ইত্যাদি হয়রানি তো আছেই।
সকলেই অবহিত যে, ক্ষমতার রাজনীতিতে বিএনপির প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিএনপি। যখনই যে দল ক্ষমতায় আসে বা থাকে তখনই সে দল প্রতিপক্ষ দলকে মাঠছাড়া এমনকি দেশুছাড়াও করতে চায়। প্রতিপক্ষ দমন-পীড়নে এমন কোনো পন্থা নেই যা তারা অনুসরণ করে না। এ ব্যাপারে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগ এক কাঠি সরেস। বিগত প্রায় সাড়ে নয় বছরে আওয়ামী লীগ ও সরকারের আচরণ পর্যালোচনা করলেই এ কথার সত্যতা প্রতিপন্ন হবে। আওয়ামী লীগ সব সময় গণতন্ত্রের কথা বলে, গণতান্ত্রিক দল হিসাবে নিজেকে পরিচয় দেয়। অথচ গণতন্ত্রে বিরোধী দলের জন্য যে স্পেস দেয়ার কথা, রাজনীতি চর্চার যে অধিকার স্বীকার করার কথা সে স্পেস দেয় না, সে অধিকারও স্বীকার করে না। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর সরকারের আচরণ আরো অগণতান্ত্রিক আরো নিষ্ঠুর রূপ নিয়েছে। আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি যাতে ক্ষমতার আসতে না পারে তার জন্য যা কিছু করা দরকার ও সম্ভব তার সবকিছুই করছে সরকার। এ কাজে দুদক সরকারের একটা বড় লাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুদকে অসংখ্য দুর্নীতির অভিযোগ ও মামলা রয়েছে। দুদক তার মধ্য থেকে বেছে বেছে বিএনপি খুঁজছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা, জিয়া চ্যারিটেবিল ট্রাস্ট মামলার বিচারিক কার্যক্রম দ্রæত শেষ করার জন্য দুদক কী না করেছে ও করছে! জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় হওয়ার পর দুদক ওঠেপড়ে লেগেছে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচার শেষ করার জন্য। এই মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে অসুস্থতার কারণে কারা কর্তৃপক্ষ আদালতে হাজির করতে না পারায় দুদকের প্রধান আইনজীবী মোশাররফ হোসেন আদালতের কাছে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মামলার কার্যক্রম পরিচালনায় জন্য আবেদন করার অগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ভারতের একটি মামলার নজিরও উল্লেখ করেছেন। দুদকের প্রধান আইনজীবীর ‘দায়িত্বশীলতা’র এই পরাকাষ্ঠা দেখে অনেকেরই হয়তো তাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করবে, তবে তারা তা দিতে পারবে না এ কারণে যে, এতটা দায়িত্বশীলতা তিনি বা দুদকের কোনো আইনজীবীই অতীতে দেখাতে পারেননি। কথায় বলে, গরজ বড় বালাই। এখানেও হয়তো সেটাই সত্য।
নির্বাচন সামনে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। সে কথা দলের নেতৃবৃন্দ লাগাতারই বলে আসছেন। হঠাতই একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে দলের কান্ডারি বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ায়। তার মুক্তি আন্দোলন, নির্বাচন, মামলা, গ্রেফতার ইত্যাদি নিয়ে দলের নেতাকর্মীরা রীতিমত নাকাল অবস্থায় পড়েছেন। তাদের একটি মাত্র সান্ত¦না, বেগম খালেদা জিয়ার শান্তিপূর্ণ মুক্তি আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সহানুভুতি ও সমর্থন। এতে সরকার কিছুটা বিচলিত বটে, তবে দমনপীড়নে ও বাক্যবাণ নিক্ষেপে ক্ষান্ত নয়। এই পটভূমিতে সরকারের হাত শক্তিশালী করতে দুদকও মাঠে নেমে পড়েছে। সন্দেহজনক লেনদেন, অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বিএনপির শীর্ষ নয় নেতাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে একযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দিয়েছে। নেতারা হচ্ছেন : ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম খান, আবদুল আওয়াল মিন্টু, তাবিদ আওয়াল, এম মোর্শেদ খান, ফয়সাল, মোর্শেদ খান এবং হাবিব উন নবী খান সোহেল। দুদকের অভিযোগ, বিএনপির এসব নেতার ব্যাংক থেকে ৩০ দিনে ১২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। দুদক একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে অভিযোগ পেয়েছে, নাশকতা সৃষ্টির জন্যই এ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ওই গোয়েন্দা সংস্থার আরো অভিযোগ, বিএনপির এই সব নেতাসহ আরো কিছু নেতা বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজসে বিগত দশকে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। দুদক যে ভেবে-চিন্তে, পরিকল্পনা মাফিক বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থপাচার ও সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে, সেটা বুঝতে বাকী থাকে না। কেনা জানে, যাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে তাদের অনেকেই দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী। এক মাসে তাদের লেনদেনের যে হিসাব দেয়া হয়েছে সেটা বড় কোনো অংক নয়। এই লেনদেনের হিসাবের সঙ্গে ১০ বছরে তারা বিদেশে অর্থপাচার করেছেন এ অভিযোগও আনা হয়েছে। ১০ বছর কম সময় নয়। এতদিন দুদক কি ঘুমিয়ে ছিল? এতদিন তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামেনি কেন? আসলে এইসব নেতাসহ আরো বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতা এখন বিএনপির সব কিছু পরিচালনা করছেন। তাদের উড়োতাড়া করলে কিংবা আটকে দিতে পারলে দলটির সমূহ ক্ষতি হবে। এই ক্ষতিতে সাকুল্য লাভ সরকারের। বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করতে পারলে তার চেয়ে বড় লাভ আর কিছুতে নেই। বিকল্পে বিশৃংখল, অসংগঠিত এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বিচক্ষণ নেতৃত্বশূন্য বিএনপি নির্বাচনে এলেও লাভ; জয় কেউ আটকাতে পারবেনা। দুদক এই জয়ে সহায়ক ভূমিকা রাখতে চায়। অথচ এই ১০ বছর হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে, হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। শেয়ার বাজার লুট হয়েছে, ব্যাংকগুলো ফোকলা হয়ে গেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শত, শত, হাজার-হাজার কোটি টাকা মেরে খেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পর্যন্ত টাকা বেহাত হয়ে গেছে। এসব অনিয়ম, দুর্নীতি ও পাচারের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই তদন্ত শেষ হয়নি। ব্যতিক্রম হিসাবে দুয়েকটির তদন্ত শেষ হলেও তার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। বিচার ও সাজা তো আরো পরের কথা।
সম্প্রতি জাতিসংঘের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক কমিটি (সিইএসসিআর) বাংলাদেশের দুর্নীতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কমিটির পর্যবেক্ষণে দারিদ্রবিমোচন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যেতে অগ্রগতি অর্জনের প্রশংসা করা হয়েছে। তবে দুর্নীতির প্রবণতা ও তার ব্যাপ্তি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে কমিটি বলেছে, দুর্নীতি সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার খর্ব করেছে। প্রান্তিক ও পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী এর চরম শিকার হচ্ছে। ‘পর্যবেক্ষণে দুদকের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, টিআইবি, সুজন প্রভৃতি সংগঠন বরাবরই দুর্নীতি ও দৃর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাদের পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেনে এতদিন যা বলা হয়েছে সিইএসসিআর’র পর্যবেক্ষণেও তাই উঠে এসেছে। দুদকের ভূমিকা নিয়েও একইভাবে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। দুদক যদি সত্যি সত্যিই স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতো, সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাস্তবায়নের ঠিকাদারি না নিতো তাহলে দুর্নীতি এতটা বিস্তৃত ও ক্ষতিকারক হতে পারতো না।
এক যাত্রায় পৃথক ফল আরো নানা ক্ষেত্রে হচ্ছে। আইনের ক্ষেত্রে, বিচারের ক্ষেত্রে, শাসনের ক্ষেত্রে সেটা বিশেষভাবে দৃশ্যগ্রাহ্য। আইন এক; কিন্তু তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। সরকারী দলের জন্য আইন একভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিরোধী দলের জন্য প্রয়োগ করা হচ্ছে আরেকভাবে। সরকারী দল যখন যেখানে ইচ্ছা সমাবেশ ও জনসভা করতে পারছে। বিরোধীদল পারছেনা। পুলিশের অনুমতি সরকারী দলের জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। অথচ বিরোধী দলকে পুলিশ অনুমতি দিচ্ছে না। বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ সকলের জন্য সমান নয়। বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি খুব ভালোভাবেই গড়ে উঠেছে। পুলিশ ও প্রশাসন নিরপেক্ষ নয়; স্পষ্ট পক্ষপাতদুষ্ট। সরকারী দলের কেউ খুন হলে তদন্তের আগেই বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপিয়ে দমন-পীড়ন চালানো হয়। গণগ্রেফতারের তান্ডব চলে। পক্ষান্তরে বিরোধী দলের কেউ খুন হলে পুলিশ আসামীই খুঁজে পায় না। সরকারী দলের অস্ত্রধারী ক্যাডারদের সন্ত্রাস, দৌরাত্ম্য পুলিশ দেখেও দেখে না। আইনের শাসন ও মানবাধিকার বিষয়ে দেশী-বিদেশী সংগঠনগুলো লাগাতার অসন্তোষ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। আইনের শাসন ও মানবাধিকার অনিশ্চিত থাকার কারণে রাষ্ট্র ও সমাজ ক্রমাগত অধ:পাতের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, কে জানে! ইনকিলাব

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।