মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ০৫:৩০ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
কারাগারে খালেদা জিয়া এবং আমজনতার ভাবনা

মাহমুদ হোসেন : দেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকা ছুঁয়ে ধীরে বয়ে চলেছে কালের সাক্ষী স্রোতস্বিনী বুড়িগঙ্গা। সে সাথে সারাদেশে স্বাভাবিক ভাবেই বয়ে চলেছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-তিস্তাসহ সব নদ-নদী। কোনো নদীতে ঢেউ-তরঙ্গ ওঠেনি। দেশের বিস্তৃত উপক‚লের কোথাও সাগর ফুলে ফেঁপে ওঠার কথা জানা যায়নি। কোনো রাজপথে দেখা যায়নি জনতার বাঁধভাঙ্গা মিছিল। আকাশ-বাতাস কাঁপানো কোনো স্লোগান ওঠেনি রাজধানী, বিভাগীয় বা কোনো জেলা শহরে। এদিকে শীতকে বিদায় জানিয়ে হাজির হয়ে গেছে ফুল্ল বসন্ত। প্রকৃতি সৌন্দর্যময়ী হয়ে উঠেছে। আনন্দ উপচে পড়ছে সুখে থাকা মানুষগুলোর হৃদয়-মনে। অন্যদিকে পুরনো, বর্তমানে পরিত্যাক্ত নির্জন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দন্ড ভোগ করেছেন বেগম খালেদা জিয়া। রাজনীতি করার পরিণতিতে সত্তরোর্ধ বছরে স্বামীহারা-সন্তানহারা-ক্ষমতাহারা দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্যে এবারের বসন্তে পুরস্কার জুটেছে এ কারাদন্ড। সবাই জানেন, তার নামে আরো প্রায় ডজন তিনেক মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার এ কারাদন্ড নিয়ে দেশের কিছু জ্ঞানী-গুণী উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা করেছেন, করছেন। আমরা সাধারণ মানুষ এসব উচ্চাঙ্গের কথা বুঝে উঠতে পারি না। তাই আমরা আমাদের, মানে আমজনতার পর্যায় থেকে বিষয়টি দেখতে পারি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বেগম খালেদা জিয়ার কারাদন্ডর বিষয়টি দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে এক আলোচিত বিষয়। সাধারণ পর্যায়ের মানুষের এক বড় অংশই এ খবরে সত্যিই বিস্মিত। তবে সে বিস্ময় তার জেল হয়েছে বলে নয়- সত্যিই তাকে জেলে যেতে হয়েছে বলে। যারা আমজনতা পর্যায়ের মানুষ, যাদের রাজনীতির পান্ডিতিক জ্ঞানগম্যি নেই, যারা কথার ফুলঝুরি ছড়িয়ে টকশোগুলো আমোদিত করার ক্ষমতা রাখে না, যারা রাজনৈতিক বিশ্লেষক নন, খালেদা জিয়া ও বিএনপির নাম শুনেই খিস্তি-খেউড় করার জন্য যাদের জিভ সর্বদা সুড়সুড় করে না- সেই সাধারণ মানুষ সাদা চোখেই যে কোনো বিষয়কে দেখতে অভ্যস্ত- তারা দেখছে যে, বেগম খালেদা জিয়া এই যে জেলে ঢুকেছেন, তা এক ঐতিহাসিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তিনি অচিরেই জামিন পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে বসন্ত দিন দেখতে পাবেন নাকি আরো অনেকদিন বা বাকি জীবনই তার কারাগারেই কাটবে, তা আমজনতা তা জানে না।
বাংলাদেশের মানুষ গত ৪৭ বছরে বহু বিস্ময়কর ঘটনা দেখেছে। যেমন বেগম খালেদা জিয়ার বিরদ্ধে সাবেক সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আমলে বেশ কিছু দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়েছিল তেমনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও সম্ভবত ১৪টি দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে তিনি ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই তার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সব মামলাই আদালতে খারিজ হয়ে যায়। অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা কোনো মামলা খারিজ তো হয়ইনি, বরং সেগুলো আরো গতি পায়। এটি এক বিস্ময়কর ঘটনা। আর সাম্প্রতিক বিস্ময়কর ঘটনা হলো বেগম খালেদা জিয়ার কারাদÐ। বাংলাদেশে আইন-আদালতকে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করার কথা মাঝেমধ্যে শোনা যায়। যদিও অন্তরালের ইশারায় এসব ঘটে তবে কখনো কখনো তা গোপন থাকে না। কিন্তু তাতে সে ব্যবহার বন্ধ হয় না। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সে সরকারই আইন-আদালতকে ব্যবহার করে বা করার চেষ্টা করে। এটি একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে।
বেগম খালেদা জিয়ার কারাদÐ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই দেয়া হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়াতেই তাকে মোকাবেলা করতে হবে। তার পক্ষের আইনজীবীরা সে জন্য আছেন। তারা অবশ্য কত যে অসহায় তা প্রকাশও করেন না, লজ্জায় স্বীকারও করেন না। ১২ দিন পর ১৯ ফেব্রæয়ারি তারা রায়ের নকল পেয়েছেন। আশা করা যায়, এখন তারা পূর্ণ শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির লড়াইয়ে। আপিলে কী হবে কেউ বলতে পারে না। হয়ত তা হতে চলেছে এক অন্তহীন লড়াই। তাকে বা তার দলকে সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই এগোতে হবে।
কে বা কারা আছেন আজ বেগম খালেদা জিয়ার সাথে তার এ মহাদুর্দিনে? তার একমাত্র ছেলে এ সময় তার পাশে দাঁড়াতে পারেননি। পারবেনও না, যদিও বর্তমানে তিনিই দলীয় প্রধান। বেগম খালেদা জিয়ার কারাদন্ড হওয়ার পর এখন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হয়েছেন তিনি। তিনি এবং স্থায়ী কমিটির সদস্যরা এখন দল চালাবেন। তবে বাস্তবতা হলো, অনেকদিন থেকেই তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে আছেন। এ জীবনে আর দেশে ফিরতে পারবেন কিনা তা কেউ বলতে পারে না। তাছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তারও দশ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। তার নামে আরো মামলা আছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে বসে রাজনীতি করার তার কোনো সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে অন্তত নেই। তার অনুরাগীরা মনে করেন, সুপরিকল্পিতভাবেই এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তারেক জিয়ার মুক্তাবস্থায় দেশে ফেরার প্রশ্নই আসে না, যদিও শৃঙ্খলিত অবস্থায় তাকে ফিরিয়ে আনার জোর চেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলছে। ইরানের বিপ্লবী নেতা ইমাম খোমেনি ফ্রান্সে বসে ইরানের ইসলামী বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, পতন ঘটেছিল মহাক্ষমতাশালী শাহের। অবশ্য তারেক রহমান ইমাম খোমেনি নন, সে কারিশমাও তার নেই, আর বাংলাদেশও ইরান নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ইমাম খোমেনির অনুসারীদের মধ্যে তার নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য ছিল প্রশ্নহীন, আর বিএনপি নেতাদের একাংশ তা যত ক্ষুদ্রই হোক তারেক রহমানের বিরোধী। এটা তারেক রহমান ও বিএনপি উভয়ের জন্যই দুর্ভাগ্য। এখন এ মহাসংকটে যদি তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হয়।
বাকি রইল তার দল বিএনপি। হ্যাঁ, দলের নেতা-কর্মীরাই তার এখন বড় ভরসা। বেগম খালেদা জিয়া দলের সবাইকে শান্ত থাকার আবেদন জানিয়েছেন। তারা এখন পর্যন্ত তা মেনে চলেছেন। তাই বিএনপি অনুসারীরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেননি, আর সরকারও আশ মিটিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের হাজতে ভরার সুযোগ পায়নি। তা বলে তাদের গ্রেফতার বন্ধ হয়নি। সব জেলাতেই তাদের ধরপাকড় করা হচ্ছে। এমনিতেই অতিরিক্ত সংখ্যক বন্দীতে ঠাসা কারাগারগুলোতে ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই রব ধ্বনিত হয়ে চলেছে। সে অবস্থায় বিএনপির বন্দী নেতা-কর্মীদের ভিড় পরিস্থিতিকে আরো সঙ্গিন করে তুলেছে। দেশের ইতিহাসে এত গ্রেফতার কখনো দেখেনি কেউ।
বেগম খালেদা জিয়া আপাতত সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছেন। আরো পরিষ্কার করে বললে বলতে হয়, তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। বিএনপিতে যারা নেতৃত্বের উচ্চ পর্যায়ে আছেন দলের দায়িত্ব এখন তাদের হাতে। নেত্রীর মুক্তিই এখন নেতাদের প্রধান অভীষ্ট। তবে আইনের সে পথ কতটা সহজগম্য ও দ্রæত হবে তা বলা মুশকিল। অনেকেই মনে করেন, দীর্ঘ পরিকল্পনায়, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে আজ তার জন্য এ অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে। তার আইনজীবীরা বিপদ অবশ্যম্ভাবী বা বিপদ হতে পারে জেনেও তার জন্য আইনি সুরক্ষার কোনো পথ বের করতে পারেননি। মামলার রায়ের কপি পেতে তাদের ১২ দিন লেগেছে। এখন বর্তমান আইনি প্রক্রিয়ায় কতদিন পেরোবে, তা কে জানে?
এদিকে গত ২০ ও ২১ ফেব্রæয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার মূল ইতিহাস প্রকাশ করে দৈনিক ইনকিলাবে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এর লেখক হচ্ছেন শামসুল আলম। তিনি সহকারী সচিব হিসেবে ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীর অফিসে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জানিয়েছেন, মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়ার নামে একটি এতিমখানা বানানোর জন্য তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লে. কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান কুয়েতের আমিরের কাছ থেকে ১২ লাখ ৫৫ হাজার ডলারের একটি ফান্ড আনেন। তিনি বলেন, ঐ টাকার কিছুই খরচ হয়নি, কেউ আত্মসাৎও করেনি। সব টাকা ব্যাংকে আছে, এতদিনে তা বহু পরিমাণে বেড়েছে। তার মতে, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাটি বস্তুনিষ্ঠ হয়নি, বরং বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মামলাটি করা হয়েছে। এখানে লেখক একটি মজার বিষয়ের অবতারণা করেছেন, কেউ অভিযোগ করল যে তার পকেট থেকে টাকা চুরি গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে খুঁজে দেখা গেল যে তার কোনো পকেটই নেই। শামসুল আলম মোক্ষম প্রশ্নটি করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর তো এতিম তহবিলই ছিল না, তাহলে টাকা তছরূপ হল কী করে? যাই হোক, আদালত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বেগম খালেদা জিয়ার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে দন্ড দিয়েছেন। এখন শুধু উচ্চ আদালতের এখতিয়ার তার ব্যাপারে নতুন সিদ্ধান্ত নেয়ার।
এদিকে ১৯ ফেব্রæয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ের কপি পাওয়ার পর ২০ ফেব্রæয়ারি এ মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। ২২ ফেব্রæয়ারি আপিল আবেদনের গ্রহণযোগ্যতার উপর শুনানির পর আপিল আবেদন গ্রহণ করে হাইকোর্ট। অন্যদিকে বিচারিক আদালতকে ১৫ দিনের মধ্যে নথি হাইকোর্টে পাঠাতে বলা হয়েছে। আর আজ ২৫ ফেব্রæয়ারি তার জামিনের ব্যাপারে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া জামিন পাবেন কিনা এটা আদালত হয়ত আজই জানা যেতে পারে।
উল্লেখ্য যে, বেগম খালেদা জিয়ার দন্ড আওয়ামী লীগের সর্বপর্যায়ে ব্যাপক খুশি ও সন্তুষ্টির কারণ হয়েছে। দেশে-বিদেশের আওয়ামী অনুসারী বুদ্ধিজীবী-কলামিস্টরা এ দন্ডপ্রদানকে আইনের শাসন ও সাবেক ক্ষমতাধরকেও যে আইন ছাড় দেয় না, আর সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কত আন্তরিক, তারই প্রমাণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছেন। হায়, এ দেশে খালেদা জিয়া আজ এরশাদের চেয়েও নিকৃষ্ট দুর্নীতিবাজ বলে প্রমাণিত! একের পর এক দুর্নীতির মামলায় যেখানে এরশাদ খালাস পাচ্ছেন, আর যে টাকা তছরূপই হয়নি তা আত্মসাতের মামলায় দন্ড পান বেগম খালেদা জিয়া।
সাধারণ মানুষ পন্ডিত নয়। রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণের ক্ষমতা তাদের নেই। তবে তাদের কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটে গেছে। এখন সামনে কী ঘটতে পারে তা বোধহয় আর অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাময় নয়। দীর্ঘ আইনি লড়াই, কারাগারে বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থান প্রলম্বিত হওয়া, আরো মামলায় গতি সঞ্চারিত হওয়াসহ নতুন Ðডলাভ, নির্বাচনের আগে বিএনপিতে সম্ভাব্য ভাঙ্গন প্রয়াস, নির্বাচন হলে তাতে বিএনপির অনুজ্জ্বল অংশগ্রহণ ইত্যাদি নানা কিছুই হতে পারে। আর এ সবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি আরো জটিল-কুটিল ও সম্প্রীতিহীন হয়ে উঠতে চলেছে বলে সচেতন সাধারণ মানুষের ধারণা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।