বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০৪:৫৩ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
জিয়াউর রহমান বিষয়ক কিছু স্মৃতিচারণ

ডেক্স রিপোর্ট : আজ ৩০ মে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন তিনি।

করোনা ভাইরাসের মহামারির কারণে প্রতি বছরের মতো সর্বব্যাপী কর্মসূচি পালন করতে পারছে না দলটি। ভার্চুয়াল আলোচনা সভা, খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, বস্ত্র বিতরণ ও আর্থিক সহযোগিতাসহ কিছু সীমিত কর্মসূচি নিয়েছে দলটি।

রাষ্ট্রপতি জিয়া খালকাটা কর্মসূচি, সবুজ বিপ্লব, শিল্প উন্নয়ন এবং যুগোপযোগী ও আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বনির্ভর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। নারী সমাজের উন্নয়ন ও শিশুদের বিকাশে তার আগ্রহ জাতিকে নতুন দিকনির্দেশনা দেয়। তার সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দেশপ্রেম ছিল অতুলনীয়।

দেশকে যখন তিনি সামনের দিকে নিয়ে চলেছেন সেই সময়ে তার বিরুদ্ধে শুরু হয় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। ১৯৮১ সালের ২৯ মে তিনি এক সরকারি সফরে চট্টগ্রামে যান। ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে গভীর রাতে একদল সেনাসদস্য তাকে হত্যা করে। বিপথগামী সেনাসদস্যরা তার লাশ চট্টগ্রামের রাউজানের গভীর জঙ্গলে কবর দেয়। তিন দিন পর ঐ লাশ উদ্ধার করে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে এনে দাফন করা হয়।

জিয়াউর রহমান একজন মানুষ, রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে কেমন ছিলেন এবং তার হত্যাকাণ্ড পরবর্তীতে দেশ বিদেশে কেমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল সেই বিষয়ে বর্তমানের নতুন প্রজন্ম ও দেশবাসীর নিকট তুলে ধরার জন্য এই প্রতিবেদনের অবতারণা।

এক

‘১৯৭৭ সালের জুন মাসে অপ্রত্যাশিতভাবেই জানলাম যে লন্ডনের কমনওয়েলথ সম্মেলনে বাংলাদেশ দলের সদস্য হিসেবে আমাকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে এবং দুবাই থেকে আমাকে প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সহগামী হতে হবে। ১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে যথাক্রমে অটোয়া এবং কিংষ্টনের কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে আমি অংশ নিয়েছিলাম। হয়তো সেই অভিজ্ঞতা এবং লন্ডন ও কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের সঙ্গে আমার নীবিড় পরিচিতি পরপর তৃতীবারের মত বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে আমার অর্ন্তভুক্ত সম্ভব করেছিলো। প্রথম দুবার দলনেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

দুবাইয়ে প্লেনে আরোহনের পর প্রেসিডেন্ট জিয়া সম্মেলনের ব্রিফ নিয়ে প্লেনেই আমাদের সাথে বিশদ আলোচনা করেন। তারপর লন্ডন পৌছে সোজা দূতাবাসে গিয়ে বৈঠক হয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তারপর (রাত তখন দশটা) প্রেসিডেন্ট জিয়া লন্ডনে আমাদের হাইকমিশনার মি, ফতেহ আর আমাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয় সন্মদ্ধে অবগত করার জন্য তাঁর সঙ্গে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে যেতে বলেন। সেই বৈঠক রাত সাড়ে বারোটা অবধি চলার পর আমরা ছুটি পাই। আমাদের দুজনের সঙ্গে ওই বৈঠকের কারণ ছিলো প্রেসিডেন্টের শঙ্কা যে রাষ্টদূত হিসেবে আমাদের অবস্থান বিদেশে হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরীন বিবর্তন সন্মদ্ধে আমাদের স্পষ্ট ধারণা নাও থাকতে পারে।

১৯৭৭ সালে লন্ডন কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে সেই সময়কার রোডেশিয়া (বর্তমান জিম্বাবুয়ে) এবং দক্ষিন আফ্রিকা ছিলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে অটোয়া এবং কিংষ্টনের সম্মেলনে যারা অগ্রনী ভূমিকা রেখেছিলেন,যেমন শেখ মুজিব,হ্যারল্ড উইলসন,ইন্দিরা গান্ধি,ইয়াকুবু গাওয়ান,অস্ট্রেলিয়ার হুইটলাম আর নিউজিল্যাণ্ডের পিটার রাউলিং প্রমুখ নেতার অনুপস্থিতি এই কথাই আমাকে বার বার মনে করিয়ে দিলো যে রাজনীতি পরিবর্তনশীল। কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার আগ্রহ ছিলো অপরিসীম।

লন্ডনের মার্লবরো হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং ভারতের সেইসময়কার প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ন আলোচনা ছিলো সেই সম্মেলেনের একটি গুরুত্বপূর্ন অর্জন।

লন্ডন কমনওয়েলথ সম্মেলনের পর আমি আবুধাবি ফিরলাম ১৯৭৭ সালের ১৯জুন। সেই রাতেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো একদিনের সরকারী সফরে আবুধাবি এলেন। তখন রাত প্রায় এগারোটা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল হক টেলিফোনে জানালেন যে পরদিন ভুট্টোর সম্মানে শেখ যায়েদের মধ্যাহৃভোজসভায় ভুট্টো আমার সঙ্গে একান্তে একটি কথা বলতে চান। সেই মধ্যাহৃভোজে ভুট্টো আমাকে বলেছিলেন যে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ সমরাস্ত্র উৎপাদনের অর্থসাহায্যের জন্য যৌথভাবে আবেদন করলে আরব দেশগুলো থেকে সাড়া পাওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা রয়েছে এবং সেই লক্ষ্যে তিনি অচীরেই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাছে একটি বার্তা প্রেরণ করবেন। তারপরই ভুট্টোকে বিদায় সংবর্ধনা জানাতে সব রাষ্ট্রদূতের সাথে আমিও বিমানবন্দরে গেলাম। ‘নিজের প্রতি খেয়াল রেখো’ ( লুক আফ্টার ইয়োরসেলফ) ছিলো আমার সঙ্গে ভুট্টোর শেষ কথা। তার যাওয়ার পনের দিন পর ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাইয়ের সকালে আবুধাবিতে ভারতের রাষ্ট্রদূত হামেদ আনসারি (বর্তমানে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি) আমাকে জানালেন যে পাকিস্তানের সামরিক অভ্যুত্থানে ভুট্টোর পতন ঘটেছে। তার পরই ভুট্টো কারাগারে গেলেন। তাঁরপর হলো তাঁর বিচার আর ফাঁসি।

তবে সেই সামরিক অভ্যুত্থানের আগেই টেলিফোনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে আমি সমরাস্ত্র উৎপাদন সন্মন্ধে ভুট্টোর ভাবনাটির কথা বলেছিলাম। সামান্যক্ষণ চুপ থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়া আমাকে বলেছিলেন, “জানেন, ওই টাকা দিয়ে সে তৈরী করবে পারমানবিক বোমা আর আমি বানাবো ৩.৩ বোরের রাইফেল! আমি এর মধ্যে নেই। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানে পারমানবিক বোমার নির্মাতা আবদুল কাদেরের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তাতে ভুট্টোর ভুমিকা সন্মন্ধে জেনেছিলাম। পারমানবিক বোমা আর ভুট্টো সন্মন্ধে প্রেসিডেন্ট জিয়ার জুন ১৯৭৭ সালের কথাছিল অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।

আবুধাবিতে অবস্থানের সময় আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ঘটনা ছিলো সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাষ্ট্রীয় সফর। ১৯৭৮ সালের ৬ মার্চ থেকে ৮ মার্চ।

আবুধাবীতে ‘মাশরেফ’ প্রাসাদে শেখ যায়েদের মেহমান রাষ্ট্রপতি জিয়া। সফরের কর্মক্লান্ত দ্বিতীয় রাতের বেলা তখন বেশ গড়িয়েছে। শেখ জায়েদ প্রদত্ত নৈশভোজের শেষে আমরা ফিরেছি মাশরেফ প্রাসাদে রাষ্ট্রপতির কক্ষে। রাষ্ট্রাচারের চলতি নিয়মে রাষ্ট্রদূতকেই সবার শেষে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়। ‘আপনি কি খুব ক্লান্ত? বসুন কিছুক্ষণ’ বললেন রাষ্ট্রপতি জিয়া।

পরের বছরগুলোতে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে কর্মকেন্দ্রিক ঘনিষ্ঠতায় জেনেছিলাম,এটাই ছিলো তাঁর রীতি। বিদেশ সফরকালে রাষ্ট্রদূতদের দেশের ঘটনাবলি সন্মন্ধে নিজেই তিনি অবহিত করতে চাইতেন। করতেন খোলাখুলি মতবিনিময়। প্রশ্ন করতেন অনেক। তাঁর সঙ্গে এরকম অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে বহুবার। লন্ডনে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে,হল্যান্ড আর বেলজিয়ামে তাঁর আর বেগম জিয়ার রাষ্ট্রীয় সফরকালে, বৃটেনে তাঁর সরকারী সফরের সময় এবং জার্মানীতে তাঁর রাষ্ট্রীয় সফরে ইউরোপে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনে। সর্বশেষ ঢাকায়। তাঁর মৃত্যুর মাত্র কদিন আগে।

বেলজিয়ামের রাজার বাংলাদেশ সফরের সময়ে । আমি তখন ব্রাসেলসের রাষ্ট্রদূত।

আবুধাবীতে সেই রাতে, মনে আছে, চাকরি পূর্নগঠন এবং কর্মচারীদের বেতনের হার (Service Reorganization and pay scales of Government Servants) সন্মন্ধে তিনি জানতে চেয়েছিলেন আমার মতামত। বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধি এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্নতা অর্জনের জন্য তাঁর ধ্যানধারনা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন সেই রাতে। কথায় কথায় রাত তখন এগারোটা।

যখন বিদায় নিতে যাব, বললেন, ‘বসুন, আরও একটু। আরও একটি কথা আছে। ঢাকায় একটি ব্যাপারে আমরা ভাবছি। আমাদের অঞ্চলের (Region) দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা আমরা কেন বাড়াতে পারি না? এই সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসেও দেখছি বাংলাদেশী, ভারতীয়,পাকিস্তানী এবং শ্রীলংকার অধিবাসীরা পারস্পরিক সহযোগিতায় এই দেশ আর এই অঞ্চলকে গড়ে তুলেছেন। এটা অত্যন্ত আনন্দদায়ক। সুদুরে এসে আমাদের অঞ্চলের অধিবাসীদের এই সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহযোগিতা নি:সন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু আমাদের নিজেদের অঞ্চলে কেন আমরা এই সহমর্মীতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছি? আমাদের এ ব্যাপারে কিছু করার প্রয়োজন রয়েছে। জিয়া থামলেন।

সহজ চিন্তা। সরল যুক্তি। অ-জটিল ভাবনা।কিন্তু ইতিহাসের সব মহান সাফল্যের গোড়াতেই রয়েছে অতিসাধারণ চিন্তাধারা। অসাধারণ জন্ম নেয় সাধারণকেই কেন্দ্র করে। অসাধারণের সৃষ্টি সাধারণের সম্পৃক্তিতে। তার পরের বছরগুলোতে দক্ষিন এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে,তা আজ ইতিহাসেরই অঙ্গ।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সফর সংযুক্ত আরব আমিরাত আর বাংলাদেশের সম্পর্ককে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেল। মনে পড়ে, প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিমান আবুধাবী ছাড়ার পর বিমানবন্দরেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী খলিফা সোয়েদি আমাকে জানালেন যে তাঁর সরকার স্বত:প্রবৃত্ত হয়ে বাংলাদেশকে ৬ মিলিয়ন ডলারের অনুদান মঞ্জুর করেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়া বাংলাদেশে পৌঁছেই যেন সেই খবরটি পান, সেটাই ছিলো তাঁদের ইচ্ছে।

– ফারুক চৌধুরী
{(প্রাক্তন পররাষ্ট্রসচিব,উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য, আওয়ামী লীগ)
জীবনের বালুকা বেলায়,পৃষ্ঠা নম্বর ২৮০,২৮১,২৮২,২৮৩।}

দুই

৩০ মে থেকে ৩রা জুন যে লাখ লাখ জনতা শুধু ঢাকা নগরীতেই নয়, গোটা বাংলাদেশে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছে, তার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, আমাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি (জিয়াউর রহমান) বাংলাদেশের মানুষের কত কাছাকাছি এবং প্রাণপ্রিয় ছিলেন। এটা বলতে যদি কেউ কুণ্ঠাবোধ করেন, এটা তার মানসিক দৈন্য এবং তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব বলে আমি মনে করি। এই যে লাখ লাখ জনতার স্রোত কেন এসেছিল, এই লাশটির পাশে, কেন এসেছিল জানাজায় ও গায়েবি জানাজায়? এসেছিল একটি মাত্র কারণে—সাবেক রাষ্ট্রপতির সততার প্রতি অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাতে।

ওই যে কোটি কোটি মানুষের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলে এসেছিলাম এবং যে কথা বলে আমরা বিশ্ববিবেকের সমর্থন পেয়েছিলাম এবং তাকেই আমরা সংবিধানে গৃহীত করেছি।

যেখানে আমরা বলেছিলাম, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা এবং সেই কথাই এই সংবিধানে আমরা রেখেছি। তারই সেই বক্তব্য—সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি মুক্তিযুদ্ধের যে প্রতিশ্রুতি ৩০ লাখ শহীদের রক্তে লেখা যে অঙ্গীকার—আজকে মরহুম জিয়াউর রহমান পালন করে যাননি যদি কেউ বলেন, তাহলে সত্যের অপলাপ হবে। আমি কীভাবে এ পার্লামেন্টে এলাম, কীভাবে আমি এখানে কথা বলছি? এটা সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ এবং বাংলাদেশে সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এভাবে চলছে।

রাষ্ট্রপতিকে কখন হত্যা করা হলো? ১৯৮০-তে নয়, ১৯৮১ সালের মে মাসে যখন রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, যখন রাষ্ট্রপতি দৃঢ় প্রত্যয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করলেন, যখন শোষণহীন সমাজব্যবস্থার কথা বলতে চাইলেন, দক্ষিণ এশিয়া, পৃথিবীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে গেলেন, সিরিয়ায় গেলেন, যখন আর সেই মুহূর্তে তার ওপর আঘাত এলো।

সুতরাং আজকে নতুনভাবে আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে, এই আক্রমণ কিসের আক্রমণ। কারা এই আক্রমণ করেছে? তাদের উদ্দেশ্য কী?

তাদের উদ্দেশ্য যাই হোক, দেশের কোনো মঙ্গল কামনা নয়, মানুষের মঙ্গল কামনা নয়, একটা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই এই হত্যা। হত্যা করা হয়েছিল একটা স্টাবলিশমেন্টকে নষ্ট করার জন্য, স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করার জন্য। স্থিতিশীলতা নষ্ট করে কারা লাভবান হয় — লাভবান হয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্র, লাভবান হয় সাম্প্রদায়িক শক্তি, লাভবান হয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলার জনগণ, দুঃখী মানুষরা, দেশের আপামর জনগণ। যে গণতন্ত্রকে মূল্যায়নের জন্য মরুহম রাষ্ট্রপতির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা, লাখ লাখ মানুষের আশা-ভরসা, তা আপনার (স্পিকারের) শোক প্রস্তাবে প্রতিফলিত হয়েছে।”

– গণতন্ত্রী পার্টির সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (সিলেট-২) সংসদে আনীত শোক প্রস্তাবে তার দল ও নিজের পক্ষ থেকে / ৩ জুন ১৯৮১

তিন

মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেবের ওপর আপনি যে শোক প্রস্তাব এনেছেন, তার প্রতি আমি আমার ব্যক্তিগত এবং দলের তরফ থেকে একাত্মতা ঘোষণা করছি। মরহুম জিয়াউর রহমানের মৃত্যু আকস্মিক এবং মর্মান্তিক। কিন্তু এই যে বর্তমান পরিস্থিতি, এটা বোধ হয় আমাদের কারও আশঙ্কার বাইরে ছিল না।

গত কিছুদিন ধরেই দেশে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, সে সম্পর্কে আমরা আশঙ্কা ব্যক্ত করেছি। এমনকি স্বয়ং রাষ্ট্রপতিও তার বক্তব্যে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সম্পর্কে তার মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। কেবল মতামতই তিনি ব্যক্ত করেননি, এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য কার্যক্রম গ্রহণের কথাও তিনি ঘোষণা করেছিলেন। যখন গোটা দেশ এবং জাতি, বিরোধী দল তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা অনুসারে এবং স্বয়ং রাষ্ট্রপতি তার চিন্তা অনুসারে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার চিন্তা করেছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে এই ঘটনা ঘটে গেল।

সবশেষে আমি একটি কথা বলতে চাই, আমাদের দেশের এসব হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন আমরা করতে পারিনি। আর করতে পারিনি বলে বারবার ষড়যন্ত্র ঘুরে-ফিরে আসছে। আজকেও বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে আমরা হারিয়েছি। দেশে গত কিছুদিনের ক্যু, কাউন্টার ক্যু—এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ দেশের মুক্তিযোদ্ধারা এবং এই মুক্তিযোদ্ধাদের ইলিমিনেট করার প্রসেস আমরা খুব গভীরভাবে লক্ষ করেছি।

আজকে আমরা জানতে চাই, এই ষড়যন্ত্র কোথায় কোন জায়গায় নিহিত রয়েছে, কোন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত আজকে আমার দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনষ্ট করার জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করার জন্য, মুক্তিযোদ্ধারা বীর উত্তম জিয়াউর এবং তার সাথী মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করার জন্য কোন ষড়যন্ত্র এর মধ্যে কাজ করছে?

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয়। তাকে সেভাবেই আমি দেখেছি, তাকে সেভাবেই আমি সম্মান করেছি। তার সঙ্গে তার যে কীর্তি, সেই কীর্তি অমর এবং অক্ষুণ্ন থাকুক—এটা কামনা করি॥”

– বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন দলীয় সংসদ সদস্য এ এস এম রাশেদ খান মেনন (বাকেরগঞ্জ-৯) সংসদে আনীত শোক প্রস্তাবে তার দল ও নিজের পক্ষ থেকে / ৩ জুন, ১৯৮১

চার

স্মৃতির আয়নায় মহান নেতা জিয়াউর রহমান

অনেকের প্রিয় ব্যাক্তিত্ব, আদর্শ, মহানায়ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর সাথে আমার কিছু প্রত্যক্ষ স্মৃতি, কিছু স্মরণীয় মূহুর্ত আছে। যেমনঃ আমি যখন ঢাবি’র ছাত্র তখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার সেই বহুল আলোচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন- যা আমরা প্রতিবাদ করতে গিয়েই জিয়ার অনূসারী হয়ে গিয়েছিলাম। বঙ্গভবনে কৃতি ছাত্রদের সংবর্ধনা, হিজবুল বাহার জাহাজে ভ্রমন…… তাঁর সফরসংগী হয়ে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় যাওয়া ইত্যাদি।

হিজবুল বাহার ভ্রমণ যাত্রায় আমাদের সাথে শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতারা। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী, তৎকালীন পানি সম্পদ মন্ত্রী এস এ বারী এটি, পরিকল্পনা মন্ত্রী ড. ফসিউদ্দিন মাহতাব, ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধূরীর নাম মনে আছে। সাংবাদিকদের মধ্যে কবি আল মাহামুদ, আখতার উল আলম, আহমেদ হুমায়ুন, শাহাদাত চৌধূরী, হেদায়েত হোসাইন মোর্শেদ এর কথা মনে আছে। শিল্পীদের মধ্যে আপেল মাহমুদ, আঞ্জুমান আরা বেগম, শবনম মুস্তারী অন্যতম। আমাদের ছাত্রদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তখনকার তরুন শিক্ষক ডক্টর খন্দকার মোশারফ হোসেন। তবে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সামনে আমরা, আমাদের সংগী সকলেই ছেলেমানুষ এবং ‘একান্ত বাধ্যগত গুড বয়’- অন্যদিকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাদের সেই রূপকথার রাজা।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতেন। তার আমলে নিয়মিতভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান অর্জনকারীদের বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ করা হত। পরবর্তীতে সর্বস্তরের মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদেরও সম্বর্ধনায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজে উপস্থিত থেকে মেধাবীদেরকে সম্বর্ধনা দিতেন এবং ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেম বোধকে জাগ্রত করার চেষ্টা করতেন।

মেধাবীদের সাথে নিয়ে হিজবুল বাহার জাহাজে করে বার কয়েক সমুদ্রভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেই সমুদ্রভ্রমণে সঙ্গী করা হত দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের, যাদের সংস্পর্শে এসে নবীন মেধাবীরা অনেক কিছু জানতে পারবে।

হিজবুল বাহারে তিনি নিজেও নবীন মেধাবীদের সংগে নিজের ভাবনাগুলো শেয়ার করতেন। আমাদের ভাবনাগুলোও গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং অনূধাবন করতেন। আজ আমি আমার মহা নায়কের সাথে হিজবুল বাহার ভ্রমনের স্মৃতিচারণ করবো।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয়ে তিনবার ভ্রমনে গিয়েছিলেন। একবার গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম থেকে সুন্দরবন। দুইবার চট্টগ্রাম-সিংগাপুর-ইন্দোনেশিয়া।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় আমারও সেই সফরে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমাদের সাথে তিনি ৫ দিন-রাত এক সঙ্গে থেকে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সম্পদ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করেছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন আজকের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরাই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। হিজবুল বাহারে যাত্রী বহন সংখ্যা ছিল দুই হাজার। এই যাত্রীদের মধ্যে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, সাংস্কৃতিক কর্মী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ছিলেন।

১৭ জানুয়ারি, ১৯৮১ইং দুপুর ১২ টার সময় হিজবুল বাহার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমরা যাত্রা করি। সুন্দর বনের সঙ্গম স্থলের অদুরে হিরণ পয়েন্ট হয়ে আমরা যাচ্ছি সিংগাপুর-ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে।

সন্ধ্যা ৭ টা। জাহাজের তৃতীয় তলায় সবাই জমায়েত হয়েছেন। সেখানেই রাষ্ট্রপতি জিয়া ছাত্র-ছাত্রীদের সাক্ষাৎ দেবেন। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় নিরাপত্তা রক্ষীদের কর্ডন ভেদ করে রাষ্ট্রপতি এগিয়ে আসছেন। সমবেত সবাই দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্ভাষণ জানালেন।

তিনি হাতের ইশারায় আমাদের বসতে বললেন। আমরা বসা মাত্রই বিএনপি মহাসচিব ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী মাইকটি রাষ্ট্রপতির সামনে এগিয়ে দিলেন। চোখে তাঁর রহস্যঘেড়া বিখ্যাত কালো চশমায় দেশের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী দলটাকে কয়েকমূহুর্ত অবলোকন করে রাষ্ট্রপতি তাঁর স্বভাবসূলভ সৌজন্য প্রকাশ করে বক্তৃতা শুরু করলেন।

ভরাট কন্ঠে বললেন-“শোন ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের বাংলাদেশের ডাঙা থেকে উত্তাল বে অব বেঙ্গলের মধ্যখানে নিয়ে এসেছি। সমুদ্র হল অন্তহীন পানির বিস্তার ও উদ্দাম বাতাসের লীলাক্ষেত্র। সমুদ্রে এলে মানুষের হৃদয় সমুদ্রেরমত বিশাল, উদার ও উদ্দাম সাহসী হয়ে উঠতে বাধ্য। আমি কি ঠিক বলিনি?”

আমাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সরাসরি প্রশ্ন করলেন রাষ্ট্রপতি জিয়া। কেউ কোনো কথা বললো না। ক্ষণকাল বিরতি দিয়ে তিনি নিজেই তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করলেন- “আমি ঠিকই বলেছি। তোমার আমার বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সংকীর্ণতা ও কুপমন্ডুকতাকে পরিহার করে সমুদ্রের মত উদার ও ঝড়ো হাওয়ার মতো সাহসী হতে হবে।“

“আমি তোমাদের কাছে এখন যে কথা বলবো তা আমাদের জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক তাগিদ। এই তাগিদকে স্মরণীয় করার জন্য আমি একটা পরিবেশ খুঁজছিলাম। আমরা এখন বঙ্গপসাগরের মাঝে। এই উপসাগরেই রয়েছে দশ কোটি মানুষের উদরপূর্তির প্রয়োজনেরও অতিরিক্ত আহার্য ও মূল ভূমি ভেঙ্গে আসা বিপুল পলিমাটির বিশাল দ্বীপদেশ যা আগামী দু-তিন প্রজন্মান্তরে মধ্যেই ভেসে উঠবে। যা বাংলাদেশের মানচিত্রে নতুন বিন্দু সংযোজনের তাগিদ দেবে। মনে রেখো, আমাদের বর্তমান দারিদ্র, ক্ষুধা ও অসহায়তা আমাদের উদ্যমহীনতারই আল্লাহ প্রদত্ত শাস্তিমাত্র। এর জন্য আমরাই দায়ী বেশী।“

“আমাদের ভিটা ভাঙা পলি যেখানেই জমুক তা তালপট্টি কিংবা নিঝুম দ্বীপ এই মাটি আমাদের। দশ কোটি মানুষ সাহসী হলে আমাদের মাটি ও সমুদ্র-তরঙ্গে কোন ষড়যন্তকারী নিশান উড়িয়ে পাড়ি জমাতে জাহাজ ভাসাবে না।“

“মনে রেখো, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত চলছে। আমরা দশ কোটি মানুষ একতাবদ্ধ নই বলে শত্রুরা, পররাজ্য লোলুপ রাক্ষসেরা আমাদের পর্বপুরুষদের এই স্বাধীন জলাধিকারে আনাগোনা শুরু করেছে। তোমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়ে, দেশের দরিদ্র পিতামাতার সর্বশেষ আশার প্রদীপ, তোমাদের ওপর ভরসা করে আছে সারাদেশ, সারা জাতি। তোমরাই হলে বাংলাদেশের হাজার বছরের পরাধীনতার কলঙ্ক মোচনকারী প্রত্যাশার আনন্দ-নিঃশ্বাস। ইতিহাসের ধারায় দৃষ্টিপাত করলেও তোমরা জানবে এই সমুদ্র ছিল আমাদের আদিমতম পর্বপুরুষদের নৌশক্তির স্বাধীন বিচরণভূমি।

এমনকি বৌদ্ধযুগে পাল রাজাদের অদম্য রণপোতগুলো এই জলাধিকারে কাউকেই অনধিকার প্রবেশ করতে দেননি। এদেশেই জন্ম নিয়েছেন ঈশা খা, তীতুমীর,হাজী শরিয়ত উল্ল্যাদেরমত সাহসী সন্তান। সন্দেহ নেই আমাদের সেসব পর্বপুরুষগণ ছিলেন যথার্থই শৌর্যবীর্যের অধিকারী। তখন আমাদের সেসব পর্বপুরুষ ছিলেন সংখ্যায় নগণ্য। কিন্তু আমরা সারাটা উপমহাদেশ আর আসমুদ্র হিমাচল শাসন করেছি। বলো, করিনি কি?”

রাষ্ট্রপতি তাঁর সামনে উপবিষ্ট শত শত ছাত্রদের মধ্যে হঠাতই আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন-“তুমি দাড়াও……”-আমি ভয়ে থতমত! কিংকর্তব্যবিমূর!! পাথরেরমত শক্ত হয়ে গেলাম!!! কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে দাড়ালাম।

তিনি আবার বললেন-“কি আমাদের পূর্বপূরুষ কি আসমুদ্র হিমাচল শাসন করেননি?”

আমি মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলাম-“জ্বী স্যার করেছেন”।

আমার উত্তরের সাথে সাথে তিনি অনেকটা হুংকার দিয়ে বললেন-“আলবৎ করেছি।“

……এবার মহান নেতা সমবেতদের উপর এক দৃষ্টিতে কিযেনো দেখলেন……তিনি সমবেত সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন- “তোমাদের মধ্যে কেউ কি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলে?” প্রায় দুই হাজার ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে মোট ৬ জন হাত তুললেন-যাদের মধ্যে আমিও একজন।

আমাদের সংগী ছাত্রদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র ছিলেন- এনামুল করিম শহীদ,গোলাম হোসেন, মিয়া শহিদ হোসাইন, গোলাম সরওয়ার মিলন, কাজী আসাদ- তারা সবাই ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা নেতাকর্মী এবং আমার থেকে সবাই অনেক সিনিয়র।

মহানায়ক আমাকে কাছে ডাকলেন এবং সকলের উদ্দেশ্য বললেন আমার ব্যাক্তিগত একটা বিষয় বললেন….. (মেধাবী ছাত্রদের সম্বর্ধনায় আমিও আমন্ত্রিত হয়ে কয়েকবছর পূর্বে যখন বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম সেই সময় প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীদের সংক্ষিপ্ত বায়োডাটা দেয়া হয়েছিল এবং এই সফরের জন্য মনোনীত ছাত্র ছাত্রীদের বায়োডাটায়ও আমার কিশোর মুক্তিযোদ্ধা বিষয়টা উল্লেখ করা হয়েছিল। আমি অবাক হলাম-আমারমত একজন সাধারন মানুষের ছোট্ট বায়োডাটাও কত মনোযোগ দিয়ে তিনি পড়েছেন এবং মনে রেখেছেন!)

রাষ্ট্রপতি আমাকে ইংগীত করে উল্লাস প্রকাশ করে হাসলেন। তারপর নরম কন্ঠে জিজ্ঞেশ করলেন- “তুমি কি আমাদের সেই পূর্বপূরুষ বীরদের কারো নাম জানো?”

আমি বললাম- “জানি। রাজা মহীপাল, বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁ……”

রাষ্ট্রপতি আমার জবাবে চমৎকৃত হয়ে বললেন, “ইউ আর রাইট মাই সান। তুমি কি ইতিহাসের ছাত্র?”

“নো, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি পাব্লিক এডমিনেস্ট্রেশনের ছাত্র।“

রাষ্ট্রপতি জিয়া খুশীতে স্বভাব সূলভ দুইহাত উঁচুকরে হাততালি দিলেন। সাথে সাথে পুরো জাহাজ জুড়ে সবাই হাততালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দিত করলেন এবং রাষ্ট্রপতির ইংগীতে আমি বসে পরলাম।

ভাষণ আবার শুরু হলো…… “প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্বজাতির মধ্যে মেধারও অভাব নেই। এই ছেলেটির কথাই ধরা যাক না। সে লোক প্রশাসনের ছাত্র কিন্তু আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য বিশয়েও সচেতন। এরাই জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে। শোন ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের সান্নিধ্য পেয়ে খুবই খুশি। ৫ দিন ও ৫ রাত আমরা এই দরিয়ায় নোনা বাতাসে দম ফেলতে এসেছি। এখন এই জাহাজটিই হল বাংলাদেশ। আর আমি হলাম তোমাদের ক্যাপ্টেন।“

“আমি চাই আমাদের দেশের প্রতিভাবান ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা চাক্ষুস পরিচয় ও বন্ধুত্বের আদান-প্রদান হোক। চেনা-জানা থাকলে পারস্পরিক আত্মীয়তা রচিত হয়। হয় না কি?”

সবাই আমরা এক সাথে জবাব দিলাম-“ইয়েস মিস্টার প্রেসিডেন্ট।“

১৯৮১ থেকে ২০২০ দেখতে দেখতে বহু বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু আজো আমি ভুলতে পারিনি হিজবুল বাহারে রাষ্ট্রপতি জিয়া, আমার মহানায়কের দেয়া সেই আবেগময় বক্তৃতা। হয়ত কোনদিন ভুলতে পারব না।

শহীদ জিয়াউর রহমানের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা নিশ্চয়ই তিনি তাঁকে জান্নাতবাসী করবেন এবং তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(গত ত্রিশ বছরে এই স্মৃতি বহুবার রোমন্থন করেছি তাই এবার সংক্ষিপ্ত ভাবে উপস্থাপন করেছি)

– হুমায়ুন কবির

পাঁচ

“… ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়েছে। সকালে অনুষ্ঠানের শুরুতে কুমিল্লার ৪৪ ব্রিগেডের অধিনায়ক কর্নেল জিয়াউর রহমান সুদূর কুমিল্লা থেকে এসে তার বসার স্থান পঞ্চম সারিতে খুঁজে পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধের ফোর্স কমান্ডার পঞ্চম সারিতে বসবেন এবং তাও আবার অনেক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগীদের পেছনে, বিষয়টি হজম করা কষ্টসাধ্য ছিলো যে কোন বিচারে।

সেখানে উপস্থিত সেনাবাহিনীর অনেকেই ঘটনাটিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি এবং ব্যাবস্থাপনায় যারা নিয়োজিত ছিলেন, তাদের সঙ্গে এ নিয়ে এক পর্যায়ে বিবাদ চরমে ওঠে।

শেষমেষ জিয়াউর রহমান বিষয়টিকে হালকা করেন এবং সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈনিকদের জন্যে নির্দিষ্ট করা স্থানের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে তিনি বললেন, ‘আমি আমার লোকদের সঙ্গে বসেই অনুষ্ঠান উপভোগ করবো।’

এ ঘটনার আপাত: পরিসমাপ্তি এখানেই থেমে থাকলো। তবে তার রেশ বোধকরি রয়ে গেলো আরও বৃহত ভবিষ্যত ঘটনাপ্রবাহের জন্যে॥”

– মেজর নাসির উদ্দিন / গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ॥ [ আগামী প্রকাশনী – নভেম্বর, ১৯৯৭ । পৃ: ৩৫]

ছয়

“… ‘৭৩ সালে বিজয় দিবসের প্যারেডে তখনকার ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া গাড়িতেই বসেছিলেন। কারণ মন্ত্রী এমপিদের পেছনের সারিতে তাঁর আসন নির্দিষ্ট থাকায় তিনি সেখানে বসতে রাজি হননি॥”

♦– মিজানুর রহমান চৌধুরী (রাজনীতিবিদ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী) / রাজনীতির তিনকাল ॥ [ হাফেজা মাহমুদা ফাউন্ডেশন – ফেব্রুয়ারি, ২০০১ । পৃ: ১৪৭

সাত

‘জিয়াউর রহমানকে নানাভাবে ছোট্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের স্মৃতিকথা নিয়ে লেখা একটি বইয়ে ভূমিকায় বইয়ের সম্পাদক শাহরিয়ার কবির উল্লেখ করেছেন, মেজর রফিকুল ইসলামের বিশাল গ্রন্থের কোথাও জিয়াউর রহমান নামে একজন সেক্টর কমান্ডার যে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তার কোনো বিবরণ পাওয়া যায়না, যদিও জিয়ার রণকুশলতা সম্পর্কে ভারতের ইষ্ট্রার্ণ কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল অরোরা যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন।

রফিকুল ইসলামের বইটি ছাপা হয়েছে জিয়ার মৃত্যুর পর। শাহরিয়ার কবিরের মন্তব্য হলো, মেজর রফিকুল ইসলাম তাঁর স্মৃতিকথার অন্য সব প্রসঙ্গ উত্থাপনের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিলেও জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে যে তিনি কাল ও প্রেক্ষিতের সুযোগ গ্রহন করেছেন- একথা অনিচ্ছা সত্ত্বেয় বলতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে বিভাজনের রাজনীতির বিয়োগান্ত শিকার হয়েছেন যে কয়েকজন, জিয়াউর রহমান তাঁদের একজন।

জিয়া শেখ মুজিবকে নেতা মানতেন এবং সব সময় তাঁর সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলতেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাকে যথেষ্ট সম্মান দেয়নি। আমরা বীরের সম্মান দিতে জানি না।

কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে বাংলাদেশের একজন মাত্র মুক্তিযোদ্ধার ছবি আছে, বুকের ওপর দু-হাত আড়াআড়ি করে দাঁড়ানো। তিনি জিয়াউর রহমান।‘

-{মহিউদ্দীন আহমদ/বিএনপি:সময়-অসময় (প্রথমা প্রকাশন, ফেব্রুয়ারী’২০১৬ পৃষ্ঠা-১৭৪-১৭৫)}

আট

অতীতের অনেক কথাই মনে পড়ছে। আপনার (জিয়া) সাথে আমার অনেক স্মৃতি আছে, অনেক মিল আছে।

আপনি যুদ্ধের সময় যে ঘড়িটা ব্যবহার করতেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও সে ঘড়িটা হাতে আছে। আমি আমার বাবার দেয়া বাড়িতেই আছি, বাবার কেনা আসবাবপত্রই ব্যবহার করছি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনিও এক কাপড়ে ছিলেন, আমিও এক কাপড়েই ছিলাম। তখন যুদ্ধ করা, হানাদারদের আঘাত করা, দেশের স্বাধীনতা অর্জন করা ছাড়া অন্য কোন ব্যাপার আমাদের মাথায় ছিল না। সে সময় ভাবীদের কি অবস্থা হবে, তারা কোথায় থাকবে, ভারতে চলে আসবে কিনা – এসব ব্যাপার নিয়ে যখন কথা বলছিলেন তখন আমি আপনার সামনে ছিলাম।

আপনি তাদেরকে বলেছিলেন – ‘তারা কোথায় থাকবে, কি করবে সে বিষয়ে ভাববার অবকাশ নেই। তাদেরকে তাদের মত করে সেভ থাকতে বলো।’

… মনে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা। war time friend-এর কথা।

পরে আমি শুনেছি সে সময় জেনারেল জিয়ার মিলিটারী সেক্রেটারী ছিলেন কর্নেল অলি।

চট্টগ্রামে আমি আক্রান্ত হয়েছি এবং আমার অবস্থা সংটাপন্ন – এ খবর শুনে জেনারেল জিয়া বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি কর্নেল অলিকে নির্দেশ দেন সরাসরি মেডিকেল থেকে খবরাখবর নেয়ার জন্য এবং যতক্ষণ পর্যন্ত অপারেশন successful হওয়ার খবর পাননি ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি জেগে ছিলেন।

… বেশ কিছুদিন পর জিয়াউর রহমান নিহত হলেন। জেনারেল জিয়া মারা গেলেন শুক্রবার রাতে। বৃহস্পতিবার রাতে আমরা চট্টগ্রাম ক্লাবে বসে তাস খেলছিলাম । দেখি কর্নেল (যে জিয়াউর রহমানকে গুলি করে। তার নাম ঠিক মনে করতে পারছিনা) আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন – ‘মোশাররফ ভাই, আজ তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি, সুখবর আছে আপনাকে পরে জানাব’।

আমি মনে করলাম তার হয়ত প্রমোশন হবে, ভালো কোন জায়গায় পোস্টিং হবে হয়ত। আমি উৎসাহিত হয়ে আর কোন প্রশ্ন করলাম না।

… আমি ঘরে ফিরে এসে চুপচাপ বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। জিয়া বিএনপি করে, আমি আওয়ামী লীগের কর্মী সেটা বড় কথা নয়। জেনারেল জিয়া আমার যুদ্ধ কালীন বন্ধু। আমরা জীবনবাজি রেখে একদিন যুদ্ধ করেছি। তার মৃত্যুর খবর আমাকে বিশাল এক শুণ্যতার সাগরে ঠেলে দিল॥”

– ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন / ফেলে আসা দিনগুলি॥ [তৃপ্তি প্রকাশ কুঠি – জুন, ২০১১। পৃ: ১৪৯ – ১৭২]

(জিয়া বিষয়ক এই তথ্য সমৃদ্ধ লেখাগুলো সংগ্রহ করেছেন প্রথিতযশা সাংবাদিক মুজতবা খন্দকার।/ঘাটাইল ডটকম/একুশে বার্তা

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।