বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০৫:২১ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ৩২ ধারা ; সঙ্কটে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা

একুশে বার্তা ডেক্স : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় বিনা অনুমতিতে ডিজিটাল উপায়ে গোপনীয় তথ্য সংগ্রহের কাজকে গুপ্তচরবৃত্তি হিসেবে আখ্যায়িত করায় হুমকির মুখে পড়েছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। শুধু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নয়, পুরো সাংবাদিকতা পেশাই সঙ্কটের মুখোমুখি বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেক সাংবাদিক। তাদের মতে, সাংবাদিকতা মানেই কম-বেশি অনুসন্ধান করতে হয় সাংবাদিকদের। পাশাপাশি প্রচলিত গণমাধ্যম ছাড়া সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমেও স্বাধীন মত ও তথ্য প্রকাশের সুযোগ রহিত হবে গত ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া খসড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাসহ বিভিন্ন ধারার কারণে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোনো সংস্থার কোনো ধরনের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরণ করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে কম্পিউটার গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।’
এই ধারার কারণে উদ্বেগ-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সাংবাদিকদের মধ্যে। বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের মধ্যে। অনেকেই সাংবাদিকদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে লিখেছেন নিজের ও পরিবারের লোকদের বিপদে ফেলতে না চাইলে মাথা থেকে ঝেরে ফেলুন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চিন্তা। অবশ্য অনেক অনুসন্ধানী সাংবাদিক ৩২ ধারার প্রতিবাদ করে একই সাথে এ আইন অমান্য করে সরকারের ভাষায় গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ফেসবুকসহ বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে অনেক সাংবাদিক ‘আমি গুপ্তচর’ পোস্টার সেঁটে প্রতিবাদ করছেন। তারা ফেসবুকে ‘আমি গুপ্তচর’ হ্যাশট্যাগ আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রতিবাদকারী এসব সাংবাদিক লিখেছেন, সরকারের ভাষায় যাকে গুপ্তচর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে সেই গুপ্তচরবৃত্তি আগেও করেছি এবং ভবিষ্যতেও করে যাবো। কারণ সাংবাদিকতা করতে গিয়ে যে অনুসন্ধান আমাদেরকে করতে হয়, যেসব তথ্য যে প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করতে হয় তা যদি গুপ্তচরবৃত্তি হয় তাহলে আমরাও গুপ্তচর। আমরা এ গুপ্তচরবৃত্তি করেই যাব।
মশিউর রহমান রুবেল নামে একজন সাংবাদিক ফেসবুকে ডিজিটাল আইনের প্রতিবাদ করে লিখেছেন, রুটিরুজির আন্দোলন ছেড়ে এবার পেশা বাঁচানোর আন্দোলনে নামতে হবে সাংবাদিকদের। আরেকটি পোস্টে তিনি লিখেছেন, সাংবাদিকতা করি, অনুসন্ধান করি অনিয়ম ও দুর্নীতির। ফলে আমাকে যেতে হয় সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে, অনেক নথিপত্র জোগাড় করতে হয়Ñ যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভাষায়, এখন আমি গুপ্তচর!
সাংবাদিক মাজহার মিলন লিখেছেন, আমি গুপ্তচর। এ দেশে অসাধুরাই সবচেয়ে শক্তিশালী। গোপনীয়তার সংস্কৃতি চর্চায় কঠোর অবস্থান তাদেরই। কোনটা গোপনীয় আর কোনটা পাবলিক বা ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট সেই ব্যাখ্যা কে দেবে? অসাধুদের মুখোশ উন্মোচনের উপায় তাহলে কী? অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দিন কি শেষ হয়ে এলো? গণমাধ্যম আর সাংবাদিকতার টুঁটি চেপে ধরতে এই আইনের ব্যবহার হবে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে?
মাসুদ রায়হান পলাশ লিখেছেন, আমি গোপন ক্যামেরা দিয়ে ডিডিও ধারণ করব। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অপরাধমূলক গোপন তথ্য প্রকাশ করব। আমাকে ২০ লাখ টাকা জরিমানাসহ ১৪ বছরের জেল দিন।
আমি গুপ্তচর
অনেক সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন, সরকারের ভাষায় এখন যা গুপ্তচরবৃত্তি সেই অপরাধ অনেক আগে থেকেই আমরা করেছি সাংবাদিকতা করতে গিয়ে। ভবিষ্যতেও এই গুপ্তচারবৃত্তি চালিয়ে যাব।
অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করে লিখেছেন, সাংবাদিকতা একটি বৃত্তের মধ্যে আটকা পড়তে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের ভাষ্যের বাইরে কিছু হয়তো প্রকাশ করা যাবে না আর। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের ফলে সাংবাদিকতা এখন ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। অনেকে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন পেজ ও ভিডিও চ্যানেল খুলে বিকল্প ও স্বাধীন সাংবাদিকতায় নিয়োজিত করেছেন নিজেদের। তারা তাদের পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল থেকে সংগৃহীত তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করে তা প্রতিনিয়ত প্রচার ও প্রকাশ করছেন ওয়েবসাইটে। এভাবে খুলে গেছে তথ্য সংগ্রহ ও সূত্রের বিশাল এক ভাণ্ডার। ব্যক্তিপর্যায়ে অপেশাদার এসব লোকজনের প্রকাশিত ও প্রচারিত তথ্য ও ছবিও প্রায়ই খবর হচ্ছে মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে। প্রায়ই এসব সূত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে তা যদি সংশোধন না করা হয় তাহলে মূল ধারার সাংবাদিকতার পাশপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিকল্প ধারার এ সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সুযোগ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৩২ ধারাসহ মোট ১৫টি ধারায় উল্লিখিত অপরাধকে অজামিনযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
কয়েক বছর ধরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার কারণে হয়রানি, মামলা ও গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন অনেক সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষ। তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলনের পর ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮’-এর খসড়া গত ২৯ জানুয়ারি অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। কিন্তু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে ৩২ ধারা যুক্ত করা হয়েছে তা আগের তুলনায় আরো ভয়ঙ্কর কালাকানুন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে গণমাধ্যমের জন্য। ফলে আইনটির খসড়া অনুমোদনের সাথে সাথে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করা হয়েছে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে। ৩২ ধারাকে ৫৭ ধারার চেয়েও নিকৃষ্ট, ভয়ঙ্কর হিসেবে আখ্যায়িত করে সাংবাদিক ও বিশেজ্ঞরা বলেছেন, স্বাধীন মত প্রকাশের পথ আগের তুলনায় আরো সঙ্কুচিত হবে এ কালাকানুন পাস হলে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ছিল, ‘(১) কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’
এ ধারায় অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান ছিল। অপর দিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী কেউ গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত হলে ১৪ বছরের জেল এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করা হলেও তা মূলত নতুন করে আরো কঠোরভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে নতুন প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শনমূলক তথ্য প্রেরণ করেন, ব্যক্তিকে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ করতে পারে এমন তথ্য প্রকাশ করেন, মিথ্যা জানা থাকার পর কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য তথ্য প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, তাহলে এটা অপরাধ হবে। প্রথম দফায় এ অপরাধের শাস্তি হবে তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দান। এসব অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত করার জন্য ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ করে, তাহলে সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড, ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড একসঙ্গে দেয়া হবে।
৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা বিভিন্ন শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়, তাহলে তা অপরাধ হবে। এ অপরাধের জন্য সাত বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার বা বারবার এ অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। নয়া দিগন্ত

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।