শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০১:৩০ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
স্বপ্নিলের জন্য শোকগাথা

সাইফুল আলম  :২ জানুয়ারি ২০২০ একটি শোকাবহ দিন। সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নুর একমাত্র পুত্রসন্তান স্বপ্নিল আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। ২১ বছরের তরতাজা যুবক। নান্নু দীর্ঘদিন যুগান্তরে আমার সহকর্মী ছিলেন। যুগান্তর পরিবারেরই অংশ ছিল নান্নুর পরিবার। বহু হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার আমরা সহযাত্রী। পুত্রের হৃদয়বিদারক এই মৃত্যুতে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ অসীম। এই লেখা বেদনাহত স্বজনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাত্র-

স্বপ্নিল ক্ষমা করো বাবাকে। যে বাবা সাংবাদিক হিসেবে অনেক করুণ কাহিনীর প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। কত মৃত্যুর কত খবর দিয়েছেন। কিন্তু নিজের সন্তানের এমন মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক মৃত্যু তিনি কি কল্পনা করেছেন? ভেবেছেন কি কোনোদিন? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন? কত অসহায় বাবা? ছেলে জ্বলছে আগুনে, তার কিছুই করার নেই। এ কেমন ভবিতব্য? এ কেমন অদৃষ্ট লিখন? এও কি মানা সম্ভব?

বাবার হৃদয় কতটা পাষাণ হলে এ দৃশ্য সহ্য করা যায়? সহ্য কি হয়? পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মৃত্যুও হয়, মেনে নিতে হয়?

স্বপ্নিল, বাবাকে ক্ষমা করো। ক্ষমা করো আমাদের।

স্বপ্নিল, পৃথিবীর সব বাবা-মায়ের কাছে তাদের সন্তান হচ্ছে আত্ম-প্রতিমা, আত্ম-প্রতিকৃতি। তাই প্রাচীন বাঙালি কবির লেখা এই কবিতা- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।’ সন্তানের জন্য এটা শুধু বাঙালি জনক-জননীর অন্তরের প্রার্থনা নয়, পৃথিবীর সব জনক-জননীর অন্তরের প্রার্থনা। বাবা-মায়েদের সারা জীবনের যে স্বপ্ন, যে পাওয়া, না-পাওয়া, যে অপূর্ণতা-অসম্পূর্ণতার বলয়, তা সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে সন্তানের অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে। মা-বাবার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে ওঠে সন্তানের বিকাশের মধ্য দিয়েই।

তোমার স্নেহময়ী মা এবং বাবা কী গভীর ভালোবাসায় তোমার নাম রেখেছিলেন- স্বপ্নিল! জীবনের সব স্বপ্ন তোমার মধ্য দিয়ে বাস্তব হয়ে উঠবে- তারা সেই স্বপ্নের পরবর্তী অধ্যায় হয়তো রচনার স্বপ্ন দেখছিলেন। হয়তো তারা তোমার মধ্য দিয়ে শাশ্বত জীবনের প্রবহমানতাকে বইয়ে দিতে চাইছিলেন- তাদের সেই সুগভীর চাওয়াকে অসমাপ্ত রেখে তুমি চলে গেলে- দাউ দাউ আগুনে দগ্ধ হয়ে। তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন আর অস্তিত্বকে নিঃস্ব করে দিয়ে।

পৃথিবীর সব মানুষের মনের অনির্বাপিত প্রশ্ন ‘আমরা কোথা থেকে এলাম, কী করে এলাম এই পৃথিবীতে আর চলে যাবই বা কোথায়?’ এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জ্ঞানে নেই, স্মৃতিতে নেই। অস্তিত্বের পরিণতি দিয়ে আমরা এটা উপলব্ধি করি যে, একজন মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় আমরা পৃথিবীতে এসেছি, তার ইচ্ছায়ই আমরা চলে যাব।

মানুষের মনের সেই অনির্বাপিত প্রশ্নকে বাংলা ভাষার মহান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিশুর মুখে উচ্চারিত করিয়েছিলেন, ‘মা আমাকে তুমি কোথায় কুড়িয়ে পেলে? এলাম আমি কোথা থেকে?’ তিনি লিখেছেন, মা’র মুখে সে প্রশ্নের উত্তর- ‘মা শুনে কয়, হেসে-কেঁদে/ খোকারে তার বুকে বেঁধে/ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।’ সেই মনের মাঝারের ইচ্ছা, বুকে বাঁধা অস্তিত্বের সর্বস্বই তো তোমরা- মা-বাবার কাছে।

স্বপ্নিল, তুমি হয়তো জানো না, তোমার বাবা কত রক্তচক্ষু, লোভ-প্রলোভন উপেক্ষা করে প্রচণ্ড সাহসে তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন। কত কত ‘বিখ্যাত’ সব সন্ত্রাসী তার জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিতে চেয়েছে কিন্তু আমাদের নির্ভীক সহকর্মী ভয়ে সরে দাঁড়াননি সত্যের সন্ধান থেকে, পালিয়ে যাননি সন্ত্রাসীদের ভয়ে কিংবা আপসও করেননি।

অবিচল থেকেছে সত্য প্রতিষ্ঠায়। তাই তুমি যখন অগ্নিদগ্ধ হয়ে জ্বলছিলে তখনও তিনি তার জীবনপণ করেই তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। হয়তো মাথায় আঘাত পেয়ে আহত না হলে তারও পরিণতি হতো তোমার সঙ্গে একই আগুনে পুড়ে যাওয়ার। তা হয়নি, হয়তো এটাই তার জন্য স্রষ্টার রচিত নিয়তি।

২.

মর্ত্যরে কোনো এক রাজাধিরাজকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল- ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারি বস্তু কী?’ উত্তরে সেই নৃপতি বলেছিলেন- ‘পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ!’

স্বপ্নিল, তোমার জনক- আমাদের প্রিয় সহকর্মী, আমার অনুজপ্রতিম মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নুর কাঁধে তোমার লাশ তার সারা জীবনের সেই ভার- তা আমাদের কোনো সান্ত্বনা, সহানুভূতি বাক্যেই হালকা হয়ে যাবে না।

আমরা বিশ্বাস করি, অমর্ত্য অনন্তলোকে স্রষ্টার সৃষ্ট প্রাণ তারই অস্তিত্বে বিলীন হয়। আমাদের সবারই প্রত্যাবর্তন তার কাছে।

স্বপ্নিল, প্রিয় সন্তান আমাদের, সেই অনন্তলোকে তুমি স্রষ্টার অপরিসীম আশীর্বাদে সিক্ত থেকো। তুমি ক্ষমা করো বাবাকে। ক্ষমা করো আমাদের।

সাইফুল আলম : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক. যুগান্তর

 

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।