সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ০৯:৩৮ পূর্বাহ্ন
ব্রেকিং নিউজ:
৩৫ বছরে ইনকিলাব

এ এম এম বাহাউদ্দীন :আলহামদুলিল্লাহ। দৈনিক ইনকিলাব ৩৫ বছরে পদার্পণ করল। প্রথমেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি মহান আল্লাহর প্রতি। এদিনে ইনকিলাবের সাংবাদিক-কর্মচারী, পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ী সকলকে অভিনন্দন। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে ইনকিলাব এতদূর এসেছে। সময়ের প্রয়োজনে ইনকিলাব প্রতিষ্ঠা করেন আমার আব্বা আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালের ৪ জুন। আমি মহান আল্লাহর প্রতি আবারো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এই জন্য যে, দীর্ঘপথ-পরিক্রমায় ইনকিলাব এখন শুধু একটি পত্রিকা নয়, লাখো মানুষের কণ্ঠস্বর।

ইনকিলাবের এই দীর্ঘ চলার পথ মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। চলার পথে নানান সঙ্কট ও বাধা এসেছে; কিন্তু দমে যায়নি। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং গণমানুষের স্বার্থের পক্ষে থেকেই স্বকীয়তা বজায় রেখে এগিয়ে চলছে নিরলসভাবে। ইনকিলাব যেমন দেশের তৌহিদী জনতাকে নতুন আলোর দিশা দেখিয়েছে; তেমনি সব শ্রেণীর মানুষ এবং পাঠকদের নিজ নিজ ধর্মীয় চেতনাকে শাণিত করেছে। তবে এটা ঠিক, ইনকিলাব সব সময় ইসলামবিদ্বেষীদের আস্ফালনের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করেছে রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই।

‘শুধু দেশ ও জনগণের পক্ষে’ শ্লোগান নিয়ে ইনকিলাব এগিয়ে চলছে। তখন প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রযুক্তি এখনকার মতো উন্নত ছিল না। তবুও প্রতিষ্ঠার সময়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ প্রযুক্তির মেশিন এনে ছাপাখানা করা হয়েছিল। ইনকিলাব প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ প্রকাশ করা হয়। সেখানে সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, আমানুল্লাহ কবীর, রিয়াজ ভাই (রিয়াজ উদ্দিন আহমদ)-এর মতো প্রখ্যাত সাংবাদিক কাজ করেছেন। অবশ্য রাজনৈতিক কারণে টেলিগ্রাফের প্রকাশনা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। সে অন্য প্রসঙ্গ।

বলছিলাম ইনকিলাব প্রতিষ্ঠার কথা। ইনকিলাব দেশের সংবাদপত্র শিল্পে নতুন ধারার সূচনা করেছে। দৈনিক পত্রিকায় সাহিত্য পাতা থাকলেও খেলাধুলার খবর খুব কমই গুরুত্ব পেতো। ক্রীড়াপ্রেমীদের জন্য দৈনিক ইনকিলাব ১৯৮০-এর দশকে পুরো পৃষ্ঠার ক্রীড়া বিভাগটি চালু করে। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়সূচি প্রকাশ এবং রমজান মাসে ইফতার-সেহরির সময়সূচি প্রকাশ করে। কয়েক বছর থেকে অন্যান্য পত্রিকা তা অনুসরণ করছে। ডে ইভেন্টকে বিভাগওয়ারি প্রকাশ যেমন- বাংলাদেশ, মহানগর, প্রতিদিন, আন্তর্জাতিক, ইসলামী জীবন, অভ্যন্তরীণ, বিনোদন প্রতিদিন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, মহিলা বিভাগ চালু করে। ইনকিলাব প্রথম কৃষকদের খবরাখবর প্রকাশের জন্য ক্ষেতখামার এবং চিকিৎসার খবরাখবর প্রচারের জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ চালু করে।
জন্মলগ্ন থেকেই দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিশ্ব রাজনীতি, সার্বভৌমত্ব, স্বকীয়তা যা কিছু দেশের মানুষ ও জনগণের জন্য মঙ্গলজনক, সে পথে থেকে সংবাদ পরিবেশন করছে ইনকিলাব। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিতি পেলেও ইনকিলাব সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্র এবং সব শ্রেণী-পেশার মানুষের পক্ষে থেকেছে অবিচল; খবর প্রচারে থেকেছে নিরপেক্ষ। ইনকিলাব প্রতিষ্ঠা হয় মূলত দেশ ও জনগণের সেবা করার প্রেরণা থেকে। নানান সঙ্কট ও বাধা-বিপত্তির মধ্যেও এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েক বছরে দেশে সংবাদপত্র তথা মিডিয়া জগতে বিপ্লব ঘটে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অসংখ্য পত্রিকা এবং অন্যান্য মিডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অধিকাংশ মিডিয়া কর্পোরেট হাউসের অধীনে পরিচালিত হওয়ায় তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা মজবুত। কিন্তু ইনকিলাব অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে কখনো ব্যবসা-বাণিজ্য ঢাল-তরবারি হিসেবে ব্যবহার করেনি; মানুষের অধিকার আদায়ের পক্ষে কথা বলেছে। প্রতিযোগিতার বাজারে এ জন্য বিভিন্ন সময় আর্থিক সঙ্কটে পড়তে হয়েছে; কিন্তু থেমে থাকেনি, সব বাধা অতিক্রম করে আপোষহীনভাবেই এগিয়ে চলেছে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এখন সাংবাদিকতা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এর মধ্যে অদৃশ্য করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সব কিছুকেই কঠিন করে তুলেছে। প্রতিকূলতার কারণে বিশ্বের প্রভাবশালী অনেক গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতা, আর্থ-সামাজিক টানাপেড়েন, সংবাদপত্রশিল্পে অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দোলাচলের মধ্যেই এগিয়ে যাচ্ছে ইনকিলাব। দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ আর গণমানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে ইনকিলাব এখন পাঠকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সকালে ইনকিলাব না পড়ে নাস্তার টেবিলে যেতে পারেন না এমন পাঠকের সংখ্যা দেশে কম নয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শক্তিশালী হওয়ায় মিডিয়া জগতে চলছে প্রতিযোগিতা। খবরের জন্য ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা নয়; অনলাইন মিডিয়ার বদৌলতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খবর পাচ্ছেন পাঠক। এজন্য ইনকিলাবের ডিজিটাল ভার্সন হয়ে যায় অত্যাবশকীয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাগজের প্রিন্ট পত্রিকার সঙ্গে প্রতিদিন অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করা হচ্ছে। আমাদের অনলাইনের খবর পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ সব গোলার্ধের দেশেই পাঠকদের কাছে সমানভাবে সমাদৃত হচ্ছে। একঝাঁক তরুণ, দক্ষ ও মেধাবী সংবাদকর্মীর পাশাপাশি নব্বই ঊর্ধ্বে বয়সী ভাষা সৈনিক জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুল গফুর, মাওলানা রূহুল আমীন খান, মোবায়েদুর রহমানের মতো প্রবীণ সাংবাদিকগণ কাজ করছেন ইনকিলাবে।

ইনকিলাব সব পাঠকের পত্রিকা। সম্পাদকীয় নীতির প্রশ্নে আপোষহীন থেকেই ‘খবর’ প্রচার করছে। প্রতিদিনের খবরে বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতি, সংস্কৃতি, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মতামত, বিশ্লেষণ, তথ্য-প্রযুক্তি, আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর খবরাখবর তুলে ধরেছে সব শ্রেণীর পাঠকের জন্য।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে চিন্তা-চেতনায়, কর্মে পরিবর্তিত বিশ্ব ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যা কিছু সত্য, সুন্দর, ভালো, মহৎ, জনকল্যাণকর এবং দেশ-জনগণের পক্ষে সেগুলো তুলে ধরছে ইনকিলাব। ইসলামী মূল্যবোধের ব্যাপারে আপস না করেও ইনকিলাব সব ধর্ম তথা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের অধিকার, মত-পথকে সমান গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামী চেতনা লালন করেও গোড়ামিকে প্রশ্রয় দেয়নি; ইনকিলাবই প্রথম জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করে। তবে এটা ঠিক আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে মাদরাসা শিক্ষাকে তাল মিলিয়ে চলতে বিষয়ভিত্তিক পাঠ্য পুস্তকে সংস্কার, আনার ক্ষেত্রে জনমত সৃষ্টিতে কাজ করছে নিরলসভাবে। এতে করে দেশের তথাকথিত কিছু প্রগতিশীল মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে ‘মাদরাসা জঙ্গি তৈরির কারখানা’ অপপ্রচার করে। ইনকিলাব তাদের মুখোশ খুলে দেয়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, অনেক মন্ত্রী, পুলিশ বাহিনীর প্রধানসহ বিশিষ্টজনেরা বক্তব্য দেন যে ‘জঙ্গির সঙ্গে মাদরাসা শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং ইংরেজি মাধ্যম ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে জঙ্গি বেশি। এতোসব প্রতিকূলতার মধ্যেও ইনকিলাব সত্যনিষ্ঠ খবরের পাশাপাশি বিজাতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে এবং ইসলামী আকিদায় সমাজ বিনির্মাণে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করেই ইনকিলাবের সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করি। দেশের সবচেয়ে কম বয়সী সম্পাদক হিসেবে তখন থেকেই দেশের বহু প্রবীণ সাংবাদিক, জ্ঞানী-গুণীজন, লেখক-বুদ্ধিজীবী-ইসলামী চিন্তাবিদ-পীর-মাশায়েখের সহযোগিতা লাভ করেছি। তাদের সহযোগিতা ইনকিলাবকে সামনে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সেই বিশিষ্টজনদের অনেকেই ইন্তেকাল করেছেন, অনেকেই এখনো বেঁচে রয়েছেন। যারা ইন্তেকাল করেছেন আল্লাহ তাদের বেহেস্ত নছিব করুন; যারা রয়েছেন তাদের সকলকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। পরিশেষে, আবারো ইনকিলাবে এখনো যারা কর্মরত রয়েছেন, তারাসহ পাঠক বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভাকাক্সক্ষীদের অভিনন্দন জানাই।

 

 

 

এই ওয়েবসাইটের যে কোনো লেখা বা ছবি পুনঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে ঋন স্বীকার বাঞ্চনীয় ।